মোঃ হাসান আলী, (রাঙামাটি,প্রতিনিধি):
প্রতিবছরের ন্যায় এবারও সৌদি আরব সরকার কোরবানির দুম্বার মাংস বাংলাদেশে উপহার হিসেবে পাঠিয়েছে। এ মাংস দেশের গরীব, অসহায়, এতিমখানা ও মাদ্রাসাগুলোর মধ্যে বিতরণের জন্য নির্দেশনা থাকলেও রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলায় এর যথাযথ বণ্টন নিয়ে উঠেছে গুরুতর অনিয়ম ও অভিযোগ। প্রশ্ন উঠেছে—যাদের জন্য এই মাংস বরাদ্দ ছিল, তারা কি প্রকৃতপক্ষে পেয়েছেন, নাকি বিতর্কিত প্রেসক্লাবকে ভাগ দিয়ে উপজেলা পরিষদেই ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন?
বাঘাইছড়ি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর মোঃ জিহাদ জানান, নির্ধারিত তালিকা অনুযায়ী এ মাংস বিতরণের নির্দেশ থাকে এতিমখানা, মাদ্রাসা ও অসহায় পরিবারগুলোর মধ্যে। তিনি বলেন, “গতকাল (২৯শে অক্টোবর) আমরা প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে একটি করে কার্টুন দিয়েছি এবং তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের মাদ্রাসা ও দুস্থদের মধ্যে মাংস বিতরণের নির্দেশ দিয়েছি।”
তিনি আরও জানান, রাঙামাটি জেলা থেকে বাঘাইছড়ির জন্য মোট ২২ কার্টুন দুম্বার মাংস গাড়িতে তোলা হয়েছিল। কিন্তু উপজেলা পরিষদে পৌঁছানোর আগেই পথিমধ্যে একটি কার্টুন উধাও হয়ে যায়। জানা যায়, ওই বরাদ্দের মধ্যে বাঘাইছড়ি প্রেসক্লাবে ১ কার্টুন বা প্রায় ৭-৮ প্যাকেট মাংস দেয়া হয়েছে। বিষয়টি প্রেসক্লাব সভাপতি আব্দুল মাবুদ (বিজয় টিভি প্রতিনিধি), কোষাধ্যক্ষ মহিউদ্দিন (বাংলাদেশ বেতার, রাঙামাটি) এর সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। প্রেসক্লাবের মাংস উপজেলা পরিষদ থেকে রিসিভ করেন সাধারণ সম্পাদক মোঃ আনোয়ার হোসেন। তবে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। কিন্তু ভিন্ন একটি সূত্রে জানা যায়, বাঘাইছড়ি প্রেসক্লাবে ২ কার্টুন মাংস ভাগ দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে বাঘাইছড়ির মোট ৮টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে মারিশ্যা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আপন চাকমা, খেদারমারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিল্টু চাকমা এবং সারোয়াতলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অতুল বিহারী চাকমা জানান, তাঁদের প্রত্যেক ইউনিয়নকে একটি করে কার্টুন দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ ইউনিয়ন পর্যায়ে বিতরণ হয়েছে মোট ৮ কার্টুন মাংস।
এছাড়া বাঘাইছড়ি উপজেলায় প্রায় ১০-১২টি এতিমখানা ও মাদ্রাসা রয়েছে। কয়েকটি এতিমখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁরা প্রত্যেকে ২ প্যাকেট করে মাংস পেয়েছেন। সেই হিসেবে সব এতিমখানায় মিলে মোট ২০-২৪ প্যাকেট বা আনুমানিক ৩ কার্টুন দুম্বার মাংস বিতরণ করা হয়েছে।
উপজেলা পরিষদ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বাঘাইছড়ির জন্য মোট ২২ কার্টুন দুম্বার মাংস বরাদ্দ ছিল। প্রতিটি কার্টুনে ৮ প্যাকেট করে প্রতি প্যাকেটে প্রায় ৩ কেজি হিসেবে একেক কার্টুনে প্রায় ২৫ কেজি মাংস থাকে। অর্থাৎ পুরো বরাদ্দে প্রায় ৫৫০ কেজি মাংস থাকার কথা।
হিসাব অনুযায়ী- প্রেসক্লাব পেয়েছে ১ কার্টুন,
ইউনিয়ন পরিষদগুলো পেয়েছে ৮ কার্টুন, এতিমখানা ও মাদ্রাসাগুলো পেয়েছে ৩ কার্টুন, পথে উধাও হয়ে গেছে ১ কার্টুন। সব মিলিয়ে ১২ কার্টুন মাংসের তথ্য পাওয়া গেছে, বাকি ১০ কার্টুন দুম্বার মাংসের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। তবে পথে উধাও হয়ে যাওয়া ১ কার্টুন কারা নিয়েছে তার সঠিক কোন তথ্য কর্তৃপক্ষ জানাননি। এখন প্রশ্ন উঠেছে—“অবশিষ্ট ১০ কার্টুন দুম্বার মাংস গেল কোথায়?”
এ বিষয়ে জানতে আজ (৩০ অক্টোবর) সকালে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আমেনা মারজানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সরাসরি কোনো মন্তব্য না করে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সুপ্তশ্রী সাহার (পিআইও) সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। পরে তাঁর কার্যালয়ে গেলে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে পাওয়া যায়নি। একাধিকবার ফোন করেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।
এদিকে ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ পেলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। সৈয়দ মোঃ ইয়াছিন নুর মন্তব্য করেন, “এই কাজটা যারা করেছে, তাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করছি। প্রয়োজনে ব্যবস্থা নিতে হলে আমি আছি আপনার পাশে।”
মোক্তার হোসেন সোহেল লিখেন, “কয়জন নিরিহ মানুষ পেয়েছে, PIO-কে এর হিসাব দিতে হবে।”
রেজাউল করিম বলেন, “দেশের সবচেয়ে অসহায় মানুষদের মাংস খেয়ে ফেলে এলাকার কিছু পাতি নেতা। এখন মনে হয় তারাই দেশের আসল গরিব।”
আর খোরশেদ সিএইচটি মন্তব্য করেন, “কর্তৃপক্ষের সুন্দর চেহারার আড়ালের চরিত্র উন্মোচনে দুম্বার মাংস বেশ কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে।”
হাবিব আল হাসান নামের আরেক ইউজার মন্তব্য করেন,”ওরে যন্ত্রণারে,, আরো কতো কি শুনার বাকি আছে?”
স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “এতিম ও গরীবদের প্রাপ্য মাংস প্রেসক্লাবের নামে ভাগ দেওয়া অনৈতিক ও লজ্জাজনক। সাংবাদিকতার নামে কেউ যদি ব্যক্তিগত সুবিধা নেয়, তা পুরো সাংবাদিক সমাজের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে।”
সামাজিক সচেতন মহল বলছে, পূর্বের ইউএনও শিরিন আক্তার নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি করে এখান থেকে বদলি হয়েছেন। বর্তমান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আমেনা মারজানের ওপর জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস ছিল যে তিনি সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে জনগণের জন্য কাজ করবেন। কিন্তু এতিম ও গরীবদের প্রাপ্য দুম্বার মাংস ভাগ-বাটোয়ারার ঘটনায় জনগণ হতবাক। তাঁরা বলেন, এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মাধ্যমে প্রশাসনের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তাই এ বিষয়ে অবিলম্বে সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।







