সুলতান মাহমুদ, দিনাজপুর :
দিনাজপুরে আমন ধান কর্তনের উৎসব আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে। দিগন্তজোড়া সোনালি ধানের মাঠে এখন কৃষকের মুখে ফুটে উঠেছে আনন্দের হাসি।
সদরের সুন্দরবন ইউনিয়নের কালিকাপুর গ্রামে বুধবার (১২ নভেম্বর) দুপুরে জেলা প্রশাসক রফিকুল ইসলাম প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে এই শস্য কর্তন উৎসবের উদ্বোধন করেন।
উদ্বোধনের আগে মাঠেই ছিল উৎসবের আমেজ। নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি করা হয় ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা ও নানা ঐতিহ্যবাহী খাবার। অতিথিদের আপ্যায়নে ব্যস্ত কৃষাণীরা। ধানের শীষ দোলানো মাঠজুড়ে যেন কৃষকের পরিশ্রম ও আনন্দের এক অনন্য সংমিশ্রণ।
জেলা প্রশাসক রফিকুল ইসলাম কৃষকদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে নিজ হাতে ব্রি-৫১ জাতের ধান কেটে উদ্বোধন করেন শস্য কর্তন কর্মসূচির। মাথায় টুপি, ঘাড়ে গামছা, হাতে কাস্তে—নিজের শৈশবের কৃষিকাজের স্মৃতি স্মরণ করে তিনি বলেন, আমার বাবা ছিলেন কৃষক। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে ধান কাটা, মাড়াইয়ের কাজে অংশ নিয়েছি। আজ আবার সেই দিনগুলোর স্মৃতি ফিরে পেলাম।
এ সময় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ আফজাল হোসেন ও দিনাজপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহীন সুলতানা, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মাসুম তুষারসহ উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষক-কৃষাণীরা উপস্থিত ছিলেন।
কালিকাপুর গ্রামের চাষি কেশব চন্দ্র রায় বলেন,বাবার জমিতে ব্রি-৫১ জাতের ধান চাষ করেছি। ধানের শীষ লম্বা ও ভারী হয়েছে। এক বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা খরচ হয়েছে, আশা করছি প্রায় ২২-২৩ মণ ধান ঘরে তুলতে পারব। এতে প্রায় ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা লাভ হবে আশা করছি।
একই গ্রামের কৃষক আব্দুল লতিফ জানান,
এক একর জমিতে এই জাতের ধান চাষ করেছি। বীজতলা থেকে কাটা পর্যন্ত ১২৫ থেকে ১৩০ দিনের মধ্যে ফসল ঘরে তোলা যায়। কৃষি অফিসারের পরামর্শে আধুনিক কৃষি অ্যাপ ব্যবহার করে স্বল্প সারেই ভালো ফলন পেয়েছি।
কৃষক হামিদুর রহমান বলেন, ব্রি-৫১ ধানটি আগাম জাত হওয়ায় ধান কাটার পরপরই একই জমিতে আলু চাষের প্রস্তুতি নিচ্ছি। এতে একই জমি থেকে দুই মৌসুমে ফসল ঘরে তুলতে পারব।
দিনাজপুর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মাসুম তুষার জানান, ব্রি-৫১ ধান জাতটি আগাম ও উচ্চফলনশীল। এ জাতের ধান চাষে কম খরচে বেশি ফলন পাওয়া যায়। এতে কৃষকরা দ্রুত জমি ফাঁকা করে রবি মৌসুমের ফসল আবাদ করতে পারেন। ফলে কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ আফজাল হোসেন বলেন, দিনাজপুর জেলায় চলতি মৌসুমে ২ লাখ ৬০ হাজার ৮৬২ হেক্টর জমিতে আমন ধানের আবাদ হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি। এতে প্রায় ৮ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন চাল উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে, যার বাজারমূল্য ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
তিনি আরও জানান, নতুন আপডেট জাতের ধান চাষে কৃষকদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। কৃষি কর্মকর্তারা মাঠে গিয়ে চাষিদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন—কীভাবে আধুনিক প্রযুক্তি, সঠিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়। এতে খরচ কমে যাচ্ছে, জমির উর্বরতা বাড়ছে এবং ফলনও হচ্ছে আশানুরূপ।
জেলা প্রশাসক রফিকুল ইসলাম ধান কর্তনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কবিতার পঙক্তি উদ্ধৃত করে বলেন, সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা, দেশমাতারই মুক্তিকামী দেশের সে যে আশা।
তিনি আরও বলেন, দিনাজপুর কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি জেলা। এখানকার উৎপাদিত ধান স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের অন্যান্য জেলায় পাঠানো হয়। কৃষকরা এখন প্রযুক্তি নির্ভর কৃষিতে অভ্যস্ত হচ্ছেন। সরকার প্রদত্ত কৃষি অ্যাপস ব্যবহারের মাধ্যমে তারা সারের যৌক্তিক ব্যবহার, কীটনাশক প্রয়োগ ও সেচ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা অর্জন করেছেন।”
তিনি কৃষকদের উদ্দেশে বলেন,
“কৃষকরাই দেশের চালিকাশক্তি। তাদের ঘামে সিক্ত এই মাটির ফসলেই বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সরকার কৃষকদের পাশে আছে, থাকবে—যাতে তারা তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পান।
তিনি আরো বলেন, অনুকূল আবহাওয়া ও সরকারি সহায়তায় এবার দিনাজপুরে আমন ধানের ফলন আশানুরূপ হয়েছে। মাঠে মাঠে কৃষকের হাসি, আর বাতাসে ভাসছে নতুন ধানের সুবাস।

