শাহজাহান আলী মনন, নীলফামারীর জেলা প্রতিনিধি:
খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির (রেশন) আওতায় সাশ্রয়ী দামে চাল বিতরণ কার্যক্রমের বরাদ্দকৃত চাল গোপনে বেশি দামে বিক্রি করে দিয়েছে ইউপি চেয়ারম্যান। চাল না পেয়ে কার্ডধারীরা প্রতিবাদ করায় তাদের নাম মাত্র টাকা দিয়ে ঘটনা ধামাচাপা দেয়া হয়েছে। তাও একজন গ্রাম পুলিশের উপর অনিয়মের দায় চাপিয়ে তাকে জিম্মি করে এই টাকা আদায় করা হয়েছে।
এমন ঘটনা ঘটিয়েছেন নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার বোতলাগাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান সরকার জুন। বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) সকাল ১১ টার দিকে চাল না পাওয়া কয়েকজন উপকারভোগী বিক্ষোভ প্রদর্শন করলে বাধ্য হয়ে তাদের কিছু টাকা দিয়ে ম্যানেজ করা হয়।
দুপুর সাড়ে ১২ টায় সাংবাদিকরা ঘটনাস্থলে পৌঁছলে ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডের সোনাখুলী গ্রামের বাসিন্দা আরমান হোসেন বলেন, আমার মা মোছা. মর্জিনা বেগমের নামে রেশনের কার্ড (নং ৩৬৯৮)। গত বৃহস্পতিবার চাল দেয়া হয়েছে। কিন্তু কারণ বশত: সেদিন আসতে পারিনি। রোববার আসলে চেয়ারম্যান বলেন, চাল নাই, সব দেয়া শেষ।
এতে অনেকে চলে যায়। কিন্তু আমি প্রতিবাদ করি এবং চাল না নিয়ে যাবোনা বলি। পরে চেয়ারম্যান আজ বৃহস্পতিবার আসতে বলেন। চেয়ারম্যানের কথা অনুযায়ী আজ আমরা প্রায় ১৫-২০ জন পরিষদে আসলে তিনি বলেন, চাল তো নাই। আপনারা ৬ শ’ টাকা করে নিয়ে যান।
এতে অনেকে বাধ্য হয়ে টাকা নিয়ে চলে গেছে। কারণ ইতোমধ্যে ৩ দিন যাতায়াতেই ১৫০ টাকা খরচ হয়ে গেছে। তাছাড়া চেয়ারম্যান একজন অসহায় গ্রাম পুলিশের উপর দায় চাপিয়ে দিয়েছে। তাই ওই দরিদ্র মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে আমরা মেনে নিয়েছি। কিন্তু চাল চুরি করে বিক্রির জন্য চেয়ারম্যানের বিচার হওয়া উচিত।
ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের লুৎফর রহমানের স্ত্রী মনিজা বেগম বলেন, আমার স্বামীর নামে কার্ড (২৯৫০)। তিন দিন ধরে ঘুরছি চাল পাচ্ছিনা। চেয়ারম্যান বলছে চাল নাই, ৬ শ’ টাকা নিয়ে যান। কেন? ওই টাকায় কী ৩০ কেজি চাল পাবো। সাশ্রয়ী দামে চাল পাবো বলেইতো কার্ড করেছি। এখন চাল না দিয়ে যে টাকা দিচ্ছে তা দিয়ে তো আর আমার সুবিধা হবেনা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন গ্রাম পুলিশ বলেন, চাল চুরি করলো চেয়ারম্যান আর খেসারত দিতে হচ্ছে নিরীহ মানুষকে। চাল বিতরণে হেরফেরের মিথ্যে অভিযোগ সাজিয়ে দায় চাপিয়ে প্রায় ২০ জন কার্ডধারীকে চালের পরিবর্তে দেয়া ৬ শ’ করে টাকা আদায় করা হয়েছে গ্রাম পুলিশ মোস্তাফিজের কাছ থেকে। এটা চরম অন্যায়, জুলুম।
বিশ্বস্ত একটা সূত্র মতে, ইউনিয়নের মোট ৪৫০৪ জন কার্ডধারীর মধ্যে প্রায় ২-৩ শতাধিক কার্ডের বিপরীতে বরাদ্দ চাল চেয়ারম্যান কৌশলে পাইকারদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। ইতোপূর্বেও তিনি ভিজিএফ ও ভিজিডির চাল বিক্রি করেছিল এবং ধরাও পড়ে। কিন্তু তখন আওয়ামী লীগ সরকার থাকায় এবং নিজে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ায় দলীয় দাপটে পার পেয়েছে।
পট পরিবর্তনের পর একারণে তার পরিবর্তে ইউপি সচিবের নামে বিগত দিন খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এবার আবারও চেয়ারম্যানের নামে বরাদ্দ দেয়ায় সুযোগ পেয়েই চাল চুরি করলো। আর এই অপরাধের বলি করা হলো একজন গ্রাম পুলিশকে। এজন্য উপজেলা প্রশাসন দায়ী। তারা কেন চেয়ারম্যানের নামে বরাদ্দ দিয়েছে।
গ্রাম পুলিশ মোস্তাফিজ বলেন, চাল বিতরণ শেষ হওয়ার পর গত রোববার ১৫-২০ জন কার্ডধারী আসে। এতে চেয়ারম্যান বলে বিতরণে সমস্যা হয়েছে। আর এজন্য আমি দায়ী। তাই ক্ষতিপূরণ হিসেবে যারা চাল পায়নি তাদের ৬শ’ করে টাকা দিতে হবে। আজ বৃহস্পতিবার তাদের টাকা দিয়েছি। চাকরি বাঁচাতে অনেক কষ্টে টাকা সংগ্রহ করেছি।
ইউপি চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান সরকার জুন বলেন, কিছু লোক আমাকে সমস্যায় ফেলার জন্য ষড়যন্ত্রমুলকভাবে একটা কার্ডে দুইবার চাল নিয়েছে। গ্রাম পুলিশ এই চালাকি বুঝতে না পারায় ধরা খেয়েছে। এতে কার্ডধারী কয়েকজনের চাল শর্ট হয়েছে। চালতো নাই, তাই তাদেরকে ৬শ’ করে টাকা দেয়া হয়েছে। গোপনে বিক্রির অভিযোগ সঠিক নয়।
চাল বিতরণে দায়িত্ব প্রাপ্ত তদারকি কর্মকর্তা উপজেলা যুব উন্নয়ন অফিসার মতিউর রহমান মুঠোফোনে বলেন, চাল না পাওয়ার ঘটনা আমার জানা নেই। আর চালের পরিবর্তে টাকা দেয়ার বিষয়েও জানিনা। সবসময় তো উপস্থিত থেকে বিতরণ সম্ভব নয়। কেননা একসাথে দুইটি উপজেলা ও দুইটি পৌরসভার দায়িত্বে আছি। কেমনে সামলাই!
উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তার অনুপস্থিতিতে খাদ্য পরিদর্শক ফাহমিদা খানম বলেন, মাস্টার রোল অনুযায়ী চাল বিতরণ করা হয়। এতে একজনের চাল অন্যজন বা একই কার্ডধারী একাধিকবার চাল নেয়ার কোন সুযোগ নাই। তাই চাল কম হবে কিভাবে? বা কার্ডধারী চাল পাবেনা কেন? চালের পরিবর্তে কোনভাবেই টাকা দেয়া যাবে না।
সৈয়দপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার নুর ই আলম সিদ্দিকীকে বিষয়টা জানালে তিনি তাৎক্ষণিক ইউপি চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান সরকার জুন ও সচিব ফেরেজুল শাহ কে মুঠোফোনে নির্দেশ দেন। তিনি তাদের বলেন, চাল না পাওয়া কার্ডধারীদের মধ্যে যাদের টাকা দেয়া হয়েছে সেই টাকা ফেরত নিয়ে অবশ্যই চাল কিনে দিতে হবে।
আর চাল কেন কম হলো তা খতিয়ে দেখা হবে বলে সাংবাদিকদের জানান তিনি। এতে যদি কারচুপির সত্যতা মেলে তাহলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে নিশ্চয়তা প্রদান করেন। বোতলাগাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান সরকার জুনের বিরুদ্ধে ইতোপূর্বেও এমন অভিযোগ আসায় ডিও দেয়া স্থগিত করার বিষয় স্বীকার করেন তিনি।

