অ আ আবীর আকাশ
বাংলাদেশে বছরের প্রথম দিনটি অনেক শিক্ষার্থীর কাছে বিশেষ উৎসবের। বিনামূল্যের নতুন পাঠ্যবই হাতে পেয়ে তারা যেমন আনন্দ পায়, তেমনি সেই বই হাতে নিয়ে নতুন শিক্ষাবর্ষে ভালোভাবে পথচলার মানসিক প্রস্তুতিও তৈরি হয়। দীর্ঘদিন ধরে এই বই উৎসব শুধু একটি প্রশাসনিক কার্যক্রম নয়—বরং এটি শিক্ষার্থীদের কাছে এক ধরনের সামাজিক উদযাপন। কিন্তু গত কয়েক বছরের মতো এবারও জানুয়ারির এক তারিখে দেশের লাখো শিক্ষার্থীর হাতে বই পৌঁছানো নিয়ে দেখা দিয়েছে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা।
এমনকি ২০২৬ সালের শিক্ষাবর্ষে মাধ্যমিকের চার শ্রেণির (ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম এবং নবম-দশম) জন্য প্রয়োজনীয় বইয়ের বিশাল অংশ এখনো ছাপা হয়নি। মোট ৩০ কোটি বইয়ের বিপরীতে ছাপা হয়েছে মাত্র সাড়ে ১১ কোটি—অর্থাৎ ১৮ কোটির বেশি বই এখনো বাকি। সময়ের তুলনায় এই ঘাটতি এতটাই বিপজ্জনক যে বছরের শুরুতে বইবিহীন শ্রেণিকক্ষের দৃশ্য অনিবার্য হয়ে উঠছে।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের এই দীর্ঘসূত্রতা কেবল বই বিলম্বেই সীমাবদ্ধ থাকে না; এটি পুরো শিক্ষাব্যবস্থার ওপর ধারাবাহিক ও গভীর ক্ষতি তৈরি করে। আর এই ক্ষতি দিনের শেষে এসে আঘাত হানে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক এবং বৃহত্তর সমাজের ওপর।
১. বই বিতরণে বারবার ব্যর্থতা: সমস্যার কেন্দ্রে কাঠামোগত দুর্বলতা
প্রতি বছরই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) বই ছাপা ও বিতরণের জন্য একটি রূপরেখা তৈরি করে। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে বই ছাপা শেষ করে উপজেলা পর্যায়ে পাঠানোর নিয়ম আছে। কিন্তু বাস্তবে সেই লক্ষ্য অর্জন অনেক দূরের কথা—মধ্যপথেই এসে থেমে যায় কাজ।
এবারের দেরির প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে দরপত্র বাতিল এবং পুনরায় আহ্বানের জটিলতা। বিশেষ করে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের ক্ষেত্রে প্রথম দফার দরপত্র বাতিল হওয়ায় কয়েক সপ্তাহ পেছাতে হয়েছে পুরো প্রক্রিয়াকে।
সরকারি ক্রয়ের নিয়মকানুন অবশ্যই মানতে হবে—এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে যে বইগুলোর ওপর, সেগুলো সরবরাহে বারবার এমন জটিলতা দেখা দেওয়ার অর্থ হলো—মৌলিক পরিকল্পনা, প্রস্তুতি ও সমন্বয়ে বড় ধরনের ঘাটতি রয়ে গেছে। এটি প্রশাসনিক ব্যর্থতা, যা প্রতিবছরই নতুন করে পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
প্রশ্ন হলো, যদি প্রাথমিকের বই ৯০% অগ্রগতি নিয়ে সঠিক সময়েই ছাপা শেষ করতে পারে, তাহলে মাধ্যমিক পর্যায়ের বইতে কেন এত বড় ধস দেখা দেয়? এর ব্যাখ্যা একটাই—সমন্বয়হীনতা ও দক্ষতার অভাব।
২. মাধ্যমিক স্তরে বড় সংকট—সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তরেই সবচেয়ে বেশি শূন্যতা
ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি এবং নবম-দশম স্তরের বই ছাপাই এবার সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে। অথচ মাধ্যমিক শ্রেণিগুলোই হলো শিক্ষাগত ভিত্তি নির্মাণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ে শিখন ঘাটতি মানে ভবিষ্যতের পুরো শিক্ষাজীবনে দুর্বলতা তৈরি হওয়া।
সংখ্যাগুলোই বলছে পরিস্থিতি কতটা নাজুক:
ষষ্ঠ শ্রেণিতে প্রয়োজনীয় বই: ৪.৪৩ কোটি
ছাপা হয়েছে মাত্র ১৪%
সপ্তম শ্রেণিতে: ৪.১৫ কোটি
ছাপা হয়েছে মাত্র ৫%
অষ্টম শ্রেণিতে: ৪.০২ কোটি
ছাপানো হয়েছে প্রায় ৩%
নবম-দশম শ্রেণিতে: ৫.৫৪ কোটি
ছাপানো হয়েছে ১৬%
অর্থাৎ এই চার শ্রেণিতে মোট প্রয়োজনীয় বইয়ের তুলনায় ছাপা হয়েছে মাত্র এক অঙ্কের শতাংশ। হাতে থাকা সময় যদি হয় মাত্র কয়েক সপ্তাহ, তাহলে আশাবাদী মন্তব্য দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায় না।
এটি কোনো সাধারণ প্রশাসনিক সমস্যা নয়—এটি সরাসরি শিক্ষার মান, শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ এবং জাতীয় মানবসম্পদ উন্নয়নের ওপর প্রভাব ফেলে।
৩. দেরিতে বই পাওয়া মানে ক্লাসে পিছিয়ে পড়া
বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষাপঞ্জি অনুযায়ী ১ জানুয়ারি শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়। কিন্তু বাস্তবে জানুয়ারি মাসে অধিকাংশ সময় বই ছাড়াই কাটাতে হয় শিক্ষার্থীদের। ফলে যারা নতুন বইয়ের অভাবে ঠিকমতো পড়া শুরু করতে পারে না, তারা ফেব্রুয়ারি-মার্চে এসে রমজান ও অন্যান্য ছুটির কারণে আরও পিছিয়ে পড়ে।
বছরজুড়ে ছুটির সিডিউল, রাজনৈতিক অস্থিরতা, পরীক্ষার নির্ধারিত তারিখ—সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীর কার্যকর পাঠদানের সময় এমনিতেই কম। এর ওপর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির শিখন ঘাটতি যোগ হলে বার্ষিক শেখার সামর্থ্য মারাত্মকভাবে কমে যায়।
তাই অভিভাবক-মতামত সবখানেই একই দাবি—যদি সময়মতো বই সরবরাহ সম্ভব না হয়, তাহলে শিক্ষাপঞ্জিতেও সমন্বয় আনতে হবে। ক্লাসের সময় কমে যাওয়ার অর্থ হলো শিক্ষার্থীর শেখার সুযোগ কমে যাওয়া। আর এই ক্ষতি একটি পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেলেই পূরণ হয় না।
৪. পরীক্ষায় ভালো নম্বর—কিন্তু শেখা হচ্ছে কতটা?
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকৃত শেখার সাথে পরীক্ষার ফলাফলের সম্পর্ক বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় অনেকটাই দুর্বল। কারণ পাঠ্যবই না পেয়ে, ক্লাস নিয়মিত না হয়ে, শেখার সুযোগ না পেয়ে যেসব শিক্ষার্থী শুধু পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেয়, তারা যেন এক ধরনের ‘খালি ফলাফল’ অর্জন করে। উচ্চ জিপিএ পেলেও তাদের মৌলিক জ্ঞান, বিশ্লেষণী ক্ষমতা, ভাষা দক্ষতা বা গণিত-বিজ্ঞান বোঝার ভিত্তি দুর্বল থেকে যায়।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদের উদ্বেগ এখানেই—শিক্ষার্থীরা ফলাফল পাচ্ছে, কিন্তু জ্ঞান পাচ্ছে না। দীর্ঘমেয়াদে এই ঘাটতি রাষ্ট্রের জন্য ভয়াবহ।
আজ যারা বই ছাড়াই ক্লাস শুরু করছে, তারাই ভবিষ্যতে দেশের নীতি-নির্ধারক, প্রশাসক, প্রযুক্তিবিদ, শিক্ষক ও চিকিৎসক হবে। যদি এই প্রজন্মের ভিত্তিই দুর্বল হয়, তাহলে উন্নয়ন কাঙ্ক্ষিত গতিতে এগোবে কীভাবে?
৫. প্রাথমিক ও ইবতেদায়িতে সাফল্য—কিন্তু মাধ্যমিকের দুরবস্থা কেন?
প্রাথমিক ও ইবতেদায়ির বই ছাপায় এবার তুলনামূলকভাবে ভালো অগ্রগতি দেখা গেছে। প্রায় ৮০–৯০% কাজ নভেম্বরের মধ্যেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। এমনকি উপজেলা পর্যায়েও বড় অংশ বই পৌঁছে গেছে।
এটি প্রমাণ করে—সমন্বিত পরিকল্পনা ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করলে সময়মতো বই সরবরাহ সম্ভব। প্রশ্ন হলো—একই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান একই সময়ে দুই ধরনের ফল দিচ্ছে কেন?
এর কারণ প্রধানত তিনটি:
1. দরপত্র প্রক্রিয়ার জটিলতা: মাধ্যমিক পর্যায়ে বহু লট ও বহুবিধ বই থাকে, ফলে দরপত্র বাতিল হলে পুরো প্রক্রিয়া ভেঙে পড়ে।
2. কর্মপরিকল্পনার দুর্বলতা: সম্ভাব্য ঝুঁকি ধরে আগাম পরিকল্পনা না থাকায় দেরিতে ব্যাকআপ ব্যবস্থা নেয়া হয়।
3. সমন্বয় সংকট: এনসিটিবি, মাউশি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ছাপাখানার মধ্যে সমন্বয় দুর্বল।
৬. শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শিক্ষাগত ক্ষতি
বই পেতে দেরি হলে শিক্ষার্থীরা নিরুৎসাহিত হয়। নতুন বছরের উদ্দীপনা কমে যায়, অনেকে স্কুলে যেতে আগ্রহ হারায়। শিক্ষকরা পাঠদান শুরু করতে পারেন না। ফলে বছরের প্রথম মাসেই শিখন ঘাটতির ভিত্তি তৈরি হয়।
এটি কেবল শিক্ষার মানে নয়, শিক্ষার্থীর সামগ্রিক মানসিক বিকাশেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিশেষত মাধ্যমিকের কিশোর বয়সে শিক্ষার প্রতি অনাগ্রহ সৃষ্টি হলে এটি ভবিষ্যৎ শিক্ষাজীবনের ওপর দীর্ঘমেয়াদে বিরূপ প্রভাব ফেলে।
৭. কীভাবে এই সংকট থেকে বের হওয়া যায়?
পাঠ্যবই সরবরাহের এই দীর্ঘসূত্রতা বহু পুরনো সমস্যা। তবুও সমাধান অসম্ভব নয়। প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং পরিষ্কার জবাবদিহিতা।
কিছু বাস্তবসম্মত করণীয় হতে পারে—
১. দরপত্র ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও গতিশীলতা বৃদ্ধি
দরপত্র বাতিল হওয়া কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। কিন্তু এই ঝুঁকি মাথায় রেখে আগাম সময়ভিত্তিক বিকল্প পরিকল্পনা করতে হবে।
২. মাধ্যমিক বইয়ের জন্য আলাদা সমন্বয় সেল
প্রাথমিক পর্যায়ে যেভাবে নির্ভুলভাবে কাজ হয়েছে, মাধ্যমিকেও সেইরকম কেন্দ্রীভূত সমন্বয় দরকার।
৩. বই বিতরণ পদ্ধতিতে প্রযুক্তিগত নজরদারি
প্রতিটি লটের অগ্রগতি ডিজিটাল ড্যাশবোর্ডে পর্যবেক্ষণ করা গেলে দেরি হওয়ার সম্ভাবনা কমে।
৪. শিক্ষাপঞ্জি নমনীয় করা
যদি দেখা যায় জানুয়ারিতে সব বই বিতরণ সম্ভব নয়, তাহলে ক্লাস শুরু ও পরীক্ষার সূচি পিছিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
৫. জবাবদিহি নিশ্চিত করা
বছরের পর বছর একই সংকট হলে প্রশ্ন ওঠে—এর দায় কে নেবে? কোনো ব্যর্থতার পরও যদি কেউ দায় না পায়, তবে উন্নতি আসবে কীভাবে?
৮. রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সম্পদ—মানুষ। তাকে গড়ে তুলতে বইই প্রথম শর্ত
একটি দেশ উন্নত হবে কি না, তা নির্ভর করে তার নাগরিকদের জ্ঞান, দক্ষতা ও চরিত্রের ওপর। আর এই জ্ঞানের প্রথম চাবিকাঠি পাঠ্যপুস্তক।
যে দেশে এখনো লাখো শিক্ষার্থী বছরের প্রথম দিনে বই হাতে পায় না, সেখানে উন্নয়ন ভাবনা কতটা বাস্তবসম্মত?
বই বিতরণে দেরি মানে শুধুই প্রশাসনিক ত্রুটি নয়—এটি ভবিষ্যৎ মানবসম্পদের ভিত্তি ভেঙে দেওয়া।
শেষকথা
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বহু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি—পাঠ্যক্রম পরিবর্তন, শিক্ষক সংকট, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, প্রযুক্তিগত অসমতা। এর মধ্যে সবচেয়ে সহজ সমস্যা হলো সময়মতো বই সরবরাহ। কিন্তু সবচেয়ে সহজ সমস্যাটিই বছরের পর বছর সমাধান করা যাচ্ছে না।
বই ছাপার এই দীর্ঘসূত্রতা দূর না হলে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি শুধু বাড়তেই থাকবে। পরীক্ষামুখী শিক্ষায় তারা হয়তো ভালো নম্বর পাবে, কিন্তু জ্ঞানের ভিত দুর্বল থাকবে। আর সেই দুর্বল প্রজন্ম দিয়েই ভবিষ্যতের রাষ্ট্র তৈরি হবে—যা দেশের জন্য ভয়াবহ সংকেত।
জানুয়ারির প্রথম দিনে শিক্ষার্থীর হাতে বই পৌঁছানো কোনো উপহার নয়—এটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা মানে একটি জাতির ভবিষ্যৎকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেওয়া। এখনই সময়—বই ছাপা ও বিতরণকে সর্বোচ্চ জাতীয় অগ্রাধিকার দেওয়ার।
অ আ আবীর আকাশ, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
সম্পাদক: আবীর আকাশ জার্নাল
abirnewsroom@gmail.com

