লক্ষ্মীপুরে কেনো জেলা সাহিত্য মেলা বর্জন করেছেন কবি’রা?
বাংলা একাডেমী ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে জেলা প্রশাসনের বাস্তবায়নে সারাদেশের মত লক্ষ্মীপুরেও দুই দিনব্যাপী সাহিত্য মেলার আয়োজন করা হয়।
গত ৫ ও ৬ বৃহস্পতি ও শুক্রবার স্থানীয় টাউন হল মিলনায়তনে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। টানা বৈরি আবহাওয়া উপেক্ষা করে জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও প্রত্যন্ত এলাকা থেকে কবি সাহিত্যিক ও সাহিত্যসেবিগণ উপস্থিত হন। নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী সকাল ৯ঃ০০ টায় লেখকদের নাম নিবন্ধনের মধ্য দিয়ে কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা থাকলেও অনুষ্ঠান শুরু হয় বারোটার দিকে। বিকেল তিনটার দিকে লেখকদের মধ্যাহ্ন ভোজের জন্য মিষ্টির কার্টুনজাত পলিথিন মোড়া খাবার পরিবেশন করা হয়। এ খাবার দুর্গন্ধ হওয়ায় অনেক লেখক তা খেতে না পেরে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলেন। এ বিষয়টি জেলা কালচারাল অফিসারকে জানানো হলে তিনি বলেন- ‘সকালে অর্ডার করেছি তো, তাই তারা সকাল-সকাল প্যাকেট করায় এরকম হয়েছে।’
লেখিয়েদের নিয়ে কর্মশালা হওয়ার কথা থাকলেও স্থানীয় এক লেখক দিয়ে পূর্বে লিখে রাখা যৎসামান্য লেখা (চেয়ারে বসে) পাঠের মধ্য দিয়ে কর্মশালা শেষ করেন। সূচীতে বিকেল বেলায় কর্মসূচী দেয়া থাকলেও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয় সন্ধ্যার অনেক পরে।
২.
দ্বিতীয় দিন শুক্রবারের কর্মসূচি সকাল ১০ টায় স্থানীয় লেখকদের সাহিত্য পাঠ, কবি কন্ঠে কবিতা পাঠ, ছড়া, কথা সাহিত্যের ছোট গল্প ইত্যাদি হওয়ার কথা থাকলেও তা শুরু হয় সকাল সাড়ে ১১ টায়। শুধু স্থানীয় কবি’দের কবিতা পাঠ দিয়েই প্রথম অধিবেশন চালানো হয়। এতে জেলা প্রশাসন কিবা কালচারাল অফিসার কেউ-ই উপস্থিত ছিলেন না। জুমার নামাজের বিরতির জন্য কবিগণ হইচই শুরু করলে ১.২০ মিনিটে অনুষ্ঠান বিরতি দেয়া হয়। উল্লেখ্য যে, সকালবেলার অধিবেশনে কবি সাহিত্যিকদের জন্য কোনো চা বিরতি বা আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়নি।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, জুমার নামাজ পড়ে এসে অনুষ্ঠানস্থলে কবিগণ প্রশাসনের কিবা অনুষ্ঠানের আয়োজকদের কাউকেই দেখতে পাননি। কবি’দের জন্য কোনো খাবারের আয়োজন নেই, চা নাস্তা পানি কিবা খোঁজখবর নেয়ার মত কোন লোক নেই। প্রশাসন কিবা জেলা কালচারাল অফিসার সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু অনুষ্ঠান সূচি অনুযায়ী সকাল দশটায় শুরু হয়ে বিকেল সাড়ে চারটায় টানা প্রোগ্রাম চলার কথা ছিল।
অনুষ্ঠানসূচিতে শুক্রবারের পবিত্র জুমার নামাজ ও মধ্যাহ্ন ভোজের কোনো বিরতি রাখা হয়নি।
সারাদিনের অভুক্ত কবিগণ ঘোরাঘুরি করে সন্ধ্যার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। এদের মধ্যে জেলার প্রথম সারির কবিগন এসব অবহেলার দরুন জেলা সাহিত্য মেলা বর্জন করে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করতে শুরু করেন, অনেকে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
একপর্যায়ে সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে সমাপনী দিনের অনুষ্ঠান সভাপতি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মেহের নিগার এলে তাকে কবিগণ বিষয়টি জানালে তিনি উল্টো কবি’দের উপর বিরক্তি প্রকাশ করেন ও রাগ দেখিয়ে কালচারাল অফিসার মনিরুজ্জামান মনিরকে ডেকে রাগ প্রকাশ করেন।
কবিগন অত্যন্ত বিনয়ের সাথে- অনুষ্ঠানে কোনো মেহমান না থাকা, অনুষ্ঠানের কোনো খোঁজ খবর না রাখা, দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন না করা, চা নাস্তা কিবা পানিও না দেওয়ার বিষয়টি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মেহের নিগারকে জানালে- ‘তিনি বা তাঁর এসব দেখার বিষয় নয়’ কিবা ’তাঁকে এসব কেন জানানো হচ্ছে?’ এ নিয়েও রাগান্বিত হয়ে তিনি যথেষ্ট বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে ক্ষুদ্ধতা প্রকাশ করেন।
দুপুরের পর থেকে সন্ধার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত আয়োজকদের কাউকে দেখা না গেলেও রাতে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও উপস্থিত কয়েকজনকবি’র হাতে একটা জল পানের মগ ও অভিনন্দনপত্র দেয়ার মধ্যোদিয়ে দুই দিনের আয়োজন শেষ করা হয়। কবি’দের কোনো যাতায়াত সম্মানী দেয়া হয়নি।
৩.
দুই দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানস্থলে ছিলেন নোয়াখালীর কবি ও লোক গবেষক ম পানা উল্লাহ। তিনি বলেন- ‘এটা কোনো আয়োজনই হয়নি। আমাদের নোয়াখালীতে প্রাণবন্ত ও আনন্দঘন দুই দিনের অনুষ্ঠানেই দুপুরে খাওয়ার আয়োজন ছিলো, সকালে ও বিকেলে চা বিরতি ছিলো। সমাপনী দিনে কবি সাহিত্যিকদেরকে ক্রেস্ট ও উত্তরীয় পরিয়ে দিয়ে কবি’দের সম্মানিত করা হয়েছে। যাওয়ার সময় কবি’দের খামেপুরে যাতায়াত খরচ বাবদ এক হাজার টাকা ও যারা প্রবন্ধ লিখেছেন তাদের দুই হাজার টাকা করে সম্মানী দিয়েছেন জেলা প্রশাসক। কিন্তু আপনাদের লক্ষ্মীপুরে এটা কি অনুষ্ঠান হয়েছে এতো কৃপণতা করে? আমার বুঝে আসেনা।’
এমনটিই বললেন চট্টগ্রাম থেকে আসা, লক্ষ্মীপুরের কৃতিসন্তান, বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও কবি ড. আজাদ বুলবুল। তিনি বলেন- ‘আমি বিস্মিত ও হতাশ হয়েছি, লক্ষ্মীপুরের কবিদের মূল্যায়ন করা হয়নি। দুপুরে লাঞ্চ পর্যন্ত করানো হয়নি শুনে আমার ভীরমী খাওয়ার দশা হয়েছে।’
প্রগতি লেখক সংঘের জাতীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও বাংলাদেশ রাইটার্স ইউনিয়নের সভাপতি জেলার সর্বজন শ্রদ্ধেয় (৬০ বছর ধরে সাহিত্যচর্চা করছেন) কবি মুজতবা আল মামুন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন -‘শুনেছি পাঁচ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়েছে জেলা সাহিত্য মেলা করার জন্য। কিন্তু লক্ষ্মীপুরে জেলা প্রশাসনের সামগ্রিক অব্যবস্থাপনা, অসংগতিমূলক নানা বির্তকের মাধ্যমে শেষ করেছেন দুইদিনের এ অনুষ্ঠান। প্রধানমন্ত্রীর সব আয়োজন ব্যর্থ। এতে আমি হতাশ। তাই এসবের প্রতিবাদ স্বরুপ আমি দ্বিতীয় দিনের সকল কর্মসূচী বর্জন করেছি।’
জেলার সাহিত্য সংস্কৃতিসেবী নজরুল একাডেমি লক্ষ্মীপুর জেলা সভাপতি সাংবাদিক ও লেখক সেলিম উদ্দিন নিজামী বলেন- ‘দুইদিনের এ মেলার আয়োজনে যে সব অব্যবস্থাপনা ও অসামঞ্জস্য দেখেছি তাতে আমি লক্ষ্মীপুরের নাগরিক হিসেবে লজ্জিত ও অনুতপ্ত । এটা লক্ষ্মীপুর জেলাবাসীর জন্য বিশেষ করে কবি ও সাহিত্যসেবীদের জন্য একটা লজ্জার বিষয়। আমরা সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও কর্তৃপক্ষের নিকট এমনটি আশা করিনি। প্রত্যাশা করি আগামীদিনের কোনো আয়োজনে আমরা নিজেদেরকে যথাযথ ভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হবো। এছাড়া এ অনুষ্ঠানের আয়োজনেও অব্যবস্থাপনায় যারা নানা ভাবে হয়রানির শিকার ও কষ্ট পেয়েছেন আমি তাদের জন্য সমবেদনা প্রকাশ করছি।’
৪.
কবি সাহিত্যিকগণ আরও অভিমত ব্যক্ত করেন যে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কবি সাহিত্যিকদের মর্যাদা বৃদ্ধিসহ সাহিত্যচর্চাকে আরো প্রসারিত করার জন্য দেশব্যাপী এমন কর্মসূচী ঘোষণা করেছেন। কিন্তু লক্ষ্মীপুরে ব্যর্থ বা যথাযথ ফলপ্রসূ না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্য সফল হয়নি।
নির্দেশনা অনুযায়ী জেলা উপজেলা পর্যায়ে কবি সাহিত্যিক ও সাহিত্যসেবীদের মূল্যায়ন করার জন্য , সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চা তৃণমূল পর্যায়ে বেগবান করার লক্ষ্যে বইমেলা উদ্বোধনীতে বাংলা একাডেমি ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারই ধারাবাহিকতায় জেলা পর্যায়ে পাঁচ লাখ টাকা ও উপজেলা পর্যায়ে তিন লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে বলে জানা যায়। কবি সাহিত্যিক ও সাহিত্য সেবিদের নিয়ে জেলা সাহিত্য মেলার আয়োজন করার জন্য। এ সাহিত্য মেলার মূল লক্ষ্য হচ্ছে জেলা উপজেলা ভিত্তিক কবি সাহিত্যিকদের সাহিত্যচর্চাকে প্রসারিত করে তাদের একত্রিত করে তাদের নাম, ছবি ও প্রকাশনা কর্মের তালিকা ডাটাবেজ আকারে সংরক্ষণ করে জাতীয় পর্যায়ে তুলে ধরা।
কিন্তু লক্ষ্মীপুরে দু’একজন তৈলমর্দনকারীর কারণে জেলা ও উপজেলাসহ প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা অধিকাংশ কবি সাহিত্যিক সংস্কৃতিসেবীরা অবমূল্যায়িত হচ্ছে সবসময়। সরকারি এমন আয়োজন প্রশ্নবোধক হবে তা কবি’রা কখনো ভাবতেই পারেনি।
লেখক: কবি প্রাবন্ধিক কলামিস্ট ও সাংবাদিক