তৌহিদুল ইসলাম তালুকদার লায়নর, কালাই(জয়পুরহাট) প্রতিনিধি:
বাংলা বর্ষের অগ্রাহয়ণ মাসের প্রথম বৃহস্পতিবারে প্রতি বছরের মতো এবারও জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার বেগুনগ্রামে চিশতীয়া তরিকার পীরের আস্তানায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে নবান্ন উৎসব। পীরভক্তদের উদ্যোগে আয়োজন করা এ উৎসবকে কেন্দ্র করে এখন জমে উঠেছে পুরো বেগুনগ্রাম।
উৎসবের আগের দিন থেকেই চলছে প্রস্তুতির ব্যস্ততা। ভক্তদের রান্নাবান্না, প্রসাদ প্রস্তুত, মাজার প্রাঙ্গণ সাজসজ্জা—সব মিলিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে এলাকায়। নবান্ন উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন, ভক্তদের আগমন এবং তাদের ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের কারণে বেগুনগ্রামের এই আস্তানা দীর্ঘদিন ধরেই বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছে। দিনব্যাপী নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে চলবে নবান্ন উৎসব, যা মধ্যরাত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। উৎসবে অংশ নিতে কালাইসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ভক্তরা ভিড় জমাচ্ছেন পীরের মাজারে।
মাজারের ভান্ডার খানার তথ্য মতে, ক্ষীর রান্নার প্রধান উপকরণ চাল, গুড়, দুধ ও নারিকেল। ক্ষীর রাখার জন্য তৈরি করা হয়েছে বিশাল দুটি হাউস। ক্ষীর রান্নার কাজে সহযোগিতার জন্য ৩১০ জন ভক্ত স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন।
সরেজমিনে গিয়ে মাজার চত্বরে দেখা যায়, বেগুনগ্রাম আস্তানায় চিশতীয়া তরিকার পীর আব্দুল গফুর চিশতী (রা:) তার অনুসারীদের যেন ব্যস্ততার শেষ নেই। সকাল থেকে দূর দূরান্ত থেকে আসতে শুরু করেছে হাজার হাজার পীর ভক্ত। একসঙ্গে ৩১টি চুলায় রান্না করা হচ্ছে ক্ষীর। সকাল থেকে রান্না শুরু হলেও চলবে রাত ৮টা পর্যন্ত। স্বেচ্ছাসেবীদের দম ফেলানোর সময় নেই। কেউ গুড়, কেউ নারিকেল ভাঙছেন আবার কেউ রান্না করছেন। রান্না হয়ে গেলে হাউসে রাখা হচ্ছে সেই ক্ষীর।
নবান্ন উৎসবে আস্তানায় বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার ভক্ত জমায়েত হয়েছে। নবান্ন উপলক্ষে এই গ্রামের মানুষরা তাদের জামাই-মেয়েসহ আত্মীয় স্বজনদের দাওয়াত করেছেন। উৎসবকে কেন্দ্র করে চলে নবান্ন মেলা। প্রতিটি ঘরে ঘরে চলছে ক্ষীর, পায়েস, মাছ ও মাংস রান্না। এই মেলাকে ঘিরে রাস্তার দুই পাশে বসেছে খাবার সামগ্রী ও মিষ্টান্নের দোকান। এছাড়াও সাংসারিক নিত্যপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্রের দোকানও বসেছে।
বেগুনগ্রাম চৌধুরীপাড়ার বাসিন্দা ও ভক্ত তোতা চৌধুরী বলেন,‘প্রায় শত বছর আগে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষে থাকা অবস্থায় কুমিল্লা জেলার হযরত খাজা শাহ মাওলানা মো. আব্দুল গফুর চিশতী (রা:) বেগুনগ্রামে আসেন। সেসময় এই এলাকার মানুষরা অভাবগ্রস্থ ছিল। বছরে প্রতি বিঘায় আমন ধান হতো ৭-৮ মণ। এই এলাকার মানুষের উপর আল্লাহর রহমত ও বরকতের জন্য অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার হালকায়ে জিকিরের আয়োজন করেন। হালকায়ে জিকির শেষে এলাকার মানুষের মাঝে নতুন চাল ও গুড় দিয়ে তৈরি ক্ষীর সবার মাঝে বিতরণ করেন। সেই থেকে এই আস্তানায় নবান্ন উৎসবে ক্ষীর রান্নার আয়োজন চলে আসছে।’
বাবুর্চি আব্দুল মান্নান বলেন, একযোগে ৩১টি চুলায় ক্ষীর রান্না করা হচ্ছে। ফজরের নামাজের পর থেকে শুরু হয়েছে। এই ক্ষীরগুলো রাতে ভক্তদের খাওয়ানো হয়।
আস্তানা পরিচালনা কমিটির সহ-সাধারন সম্পাদক সাজ্জাদুল ইসলাম বলেন, এবার লোকজনের সমাগম বেশী। চাল ৮৬ মণ, গুড় ৫১ মণ, নারিকেল ১ হাজার ৫০০ টি, দুধ ৭৮ মণ দিয়ে ক্ষীর রান্নার কাজ চলছে। দুপুরে খাবারের জন্য ৪০ মণ চালের ভাত, ২৬০ কেজি খাসির মাংস ও ৪৮ মণ আলু দিয়ে রানা করা হচ্ছে আলুঘাটি। রাতে হালকা জিকির শেষে ক্ষীর পরিবেশন করা হবে।
সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন বলেন,‘বেগুনগ্রাম পীরের মাজারে যে নবান্ন উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে তা শুধু এলাকা ভিত্তিক নয়, পুরো উত্তরবঙ্গের সব চেয়ে বড় নবান্ন উৎসব। পীরে কামিল হযরত খাজা শাহ মাওলানা মোঃ আব্দুল আব্দুল গফুর চিশতী (রাঃ) বেগুনগ্রামে ১৯৬৫ সালের অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার থেকে ভক্তদের সম্মিলিত আয়োজনে এই নবান্ন উৎসব পালনের সূচনা করেন। সেই থেকে আজও নবান্ন উৎসব চলমান রয়েছে।’
কালাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদ হোসেন বলেন,‘নবান্ন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র মাজার এলাকায় আইনশৃংখলা পরিস্থতি ঠিক রাখার জন্য অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। যাতে করে আস্তানা এলাকায় কোনো অঘটন না ঘটে।







