সাকলাইন যোবায়ের , কুমিল্লা প্রতিনিধি:
মঙ্গলবার সকাল ৮টা। কুমিল্লা নগরের কান্দিরপাড় মোড়ে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে অবৈধ ইজি বাইকে সারি। হর্নের যন্ত্রনাদায়ক শব্দ ভেসে আসছে চারপাশে, কিন্তু গাড়িগুলো প্রায় থেমে থেমে চলছে। অফিসগামী মানুষ, স্কুলের শিশুরা সবার মুখে অস্থিরতার ছাপ। ফুটপাত দখল হয়ে গেছে হকার ও দোকানের পসরা দিয়ে।
একই সময় রাজগঞ্জ, কান্দিরপাড়, চকবাজার ও শাসনগাছ রেলগেটের প্রধান সড়কগুলো সকাল থেকেই যানজটের কবলে। পথচারীরা বাধ্য হয়ে মূল সড় থেকে পায়ে হেটে নেমে চলাচল করছেন। এতে গাড়ির গতি থেমে থেমে চলে। সড়কের দুই পাশে যত্রতত্র পার্কিং স্থাপন করছেন চালকরা । অটোরিকশা যাত্রী তুলছে, প্রাইভেটকার দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার পাশে ক্রেতার জন্য। পণ্যবাহী ট্রাক লোড-আনলোড করছে।
তেলিকোনা চৌমুহনী থেকে রাজগঞ্জ যেতে ১০ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে এখন সময় লাগে প্রায় ৩৫ মিনিট। সিএনজি চালকরা বিকল্প গলি ব্যবহার করলেও সেখানে ভিড়ের শেষ নেই। ছোট ইজিবাইক বা মোটরসাইকেল মাঝেমধ্যেই চলতে পারছে না।
দুপুর ১২টার দিকে চকবাজারে যানজট ভয়াবহ রূপ নেয়। বাজারে আসা মানুষের ভিড়, পণ্যবাহী ভ্যান, ইজিবাইক ও রিকশা রাস্তার চলাচল প্রায় বন্ধ করে দেয়। চকবাজার থেকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পর্যন্ত এক কিলোমিটার পথ যেতে সময় লাগে ২০ মিনিটের বেশি। অ্যাম্বুলেন্স সাইরেন বাজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, কিন্তু গাড়িগুলো সরতে পারে না।
বাজারে ব্যবসায়ীরা পণ্য আনা-নেওয়ার জন্য রাস্তার ধারে গাড়ি থামিয়ে রাখে। ক্রেতারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে গাড়ি খুঁজে বেড়ায়। এতে সড়কের চাপ আরও বেড়ে যায়।
বিকেল ৩ টার পর স্কুল ও কলেজ ছুটির সঙ্গে সঙ্গে হাজারো শিক্ষার্থী শহরের সড়কে নেমে আসে। অভিভাবকরা গাড়ি বা মোটরসাইকেল নিয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন। এতে সড়কের অর্ধেক জায়গা বন্ধ হয়ে যায়। ট্রাফিক পুলিশ চেষ্টা করলেও জনবল সীমিত হওয়ায় তা পর্যাপ্ত হয় না। অনেক রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের উপস্থিতি দেখা যায় না।
নগরের প্রধান সড়কগুলোতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যানজটের চাপ অনুভূত হয়। অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকায়, বিক্রেতা ও ক্রেতা চলাচল করায় এবং শিশু ও অভিভাবক রাস্তার পাশে থাকায় চাপ আরও বেড়ে যায়।
অথচ প্রশাসন মাঝে মাঝে অভিযান চালায়। অবৈধ পার্কিং উচ্ছেদ, ফুটপাত দখলমুক্ত করা বা নির্দিষ্ট সড়কে ইজিবাইক নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু অভিযান শেষ হলেই আগের চিত্র ফিরে আসে। নগরে প্রায় ৬০ হাজার ইজিবাইক ও অটোরিকশা চলাচল করে, যার বড় অংশ নিবন্ধন বিহীন। সংকীর্ণ সড়ক ও পার্কিংয়ের অভাবে যানজটের চাপ আরও বাড়ছে। বিকল্প গণপরিবহন না থাকায় মানুষ ছোট যানবাহনের ওপর নির্ভর করছে।
নগরের বাসিন্দার সাথে কথা বলে জানা যায়, কুমিল্লার সড়ক নকশা তৈরি হয়েছিল এমন এক সময়ে, যখন জনসংখ্যা ও যানবাহনের চাপ কম ছিল। বর্তমানে শহরের জনসংখ্যা ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম কয়েকগুণ বেড়েছে, কিন্তু সড়কের প্রস্থ বা বিকল্প রুট বেড়েনি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, আদালতপাড়া, বাজার—সব একই এলাকায় কেন্দ্রীভূত হওয়ায় একই সড়কে চাপ থাকে দিনের বেশিরভাগ সময়।
যানজটে আটকে থাকা মানে শুধু সময় নষ্ট নয়। অফিসগামীদের দেরিতে পৌঁছানো, শিক্ষার্থীদের ক্লাস মিস করা এবং রোগীর হাসপাতালে দেরিতে পৌঁছানোএগুলো সবই দৈনন্দিন ঘটনার অংশ। ফুটপাত দখল ও গাড়ির চাপ দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষক বেলাল আহমেদ বলেন, প্রতিদিনই তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকেন। ট্রাফিক পুলিশের উপস্থিতি থাকলেও যানজট কমানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
প্রতিবেশী রাস্তায় বিকল্প গলি ব্যবহার করলেও সেগুলোও ভিড়ের কারণে কার্যকর হচ্ছে না। গাড়ি দাঁড়ানো, পণ্য সরবরাহ ও মানুষ চলাচলের জন্য সময় লেগে যাচ্ছে। ফলে অফিস, ক্লাস ও হাসপাতাল যাত্রা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
নগরবিদ ড. আহসান কবির বলেন, যানজট কমাতে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। বিশেষ করে বিকল্প গণপরিবহন চালু করা,এছাড়াস্মার্ট ট্রাফিক সিগন্যাল ও আধুনিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা।সড়ক সম্প্রসারণ ও বিকল্প রুট তৈরি।নির্দিষ্ট পার্কিং জোন ও অবৈধ পার্কিং নিয়ন্ত্রণ। ফুটপাত দখলমুক্ত রাখা।নিবন্ধনবিহীন ইজিবাইক নিয়ন্ত্রণ করা
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে ১১০ কিলোমিটার পাকা সড়ক থাকলেও অর্ধেকেরও বেশি এলাকায় যানজট লেগেই থাকে। এর প্রধান কারণগুলো হলো— অবৈধ পার্কিং, অবৈধ দোকানপাট, অতিরিক্ত ইজিবাইক ও অটোরিকশার বিশৃঙ্খলা, সড়কের নির্মাণ ও মেরামত কাজ এবং ট্রাফিক পুলিশের অপ্রতুল জনবল।
কুমিল্লা জেলা ট্রাফিক ইন্সপেক্টর সারোয়ার মো. পারভেজ বলেন, ‘আমাদের এখানে লোকবলের তীব্র সংকট। ৭৯ জন ট্রাফিক পুলিশ দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে, যেখানে অন্তত ২০০ জন ট্রাফিক সদস্য প্রয়োজন।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুন বলেন, ‘যানজট নিরসনে জেলা প্রশাসনের একটি কমিটি কাজ করছে। আমরা শুধু ফুটপাত দখলমুক্ত করতে অভিযান চালাই।







