বাংলাদেশের রাষ্ট্র-সামাজিক কাঠামোতে প্রধানত যে সমস্যাগুলো দেখা যায় তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আইনের শাসনের ঘাটতি ও সুশাসনের অভাব। একজন শিশু জন্মলাভের পর থেকেই বঞ্চিত হয় নানানভাবে।
এদেশে রয়েছে ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব, ভাল শিক্ষকের অভাব, ভাল কারিকুলামের অভাব। রাজনৈতিক বিভাজন ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্বাসবোধের ঘাটতি এতটাই প্রকট যে, একটি স্থায়ী, দীর্ঘমেয়াদি, সমন্বিত ও পরিকল্পিত ইনক্লুসিভ কারিকুলাম এখনো গড়ে উঠেনি। চলাচলের জন্য যে মানের রাস্তাঘাট ও গণপরিবহন দরকার, তা গড়ে উঠেনি। রাস্তাঘাট ও গণপরিবহন নিয়ন্ত্রণের জন্য যে কাঠামো, নীতিমালা ও নেতৃত্ব দরকার, তাও অনুপস্থিত।
একটি এলাকায় শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে হলে দরকার নানান সরকারি ও বেসরকারি সেবা। এজন্য প্রয়োজন হয় সরকারি দপ্তর ও জনপ্রতিনিধির কার্যালয়ের নিয়মিত পরিবীক্ষণ, গবেষণা ও বাস্তবায়নের। অথচ এদেশে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভার নামে স্থানীয় সরকারের যে সকল কার্যালয় রয়েছে সেগুলোর সেবা প্রদানের মান প্রশ্নবিদ্ধ।
একটু বড় পরিসরে, বিভাগীয় শহরে আসলেও জীবনযাপনের নিরাপত্তা, রাস্তার দূর্ভোগ, ব্যবসা বাণিজ্যের স্বাধীনতা, সন্ত্রাসী হামলা কিংবা চাঁদাবাজের বিরুদ্ধে আইনী ও সামাজিক সহায়তার ব্যাপক ঘাটতি দেখা যায়। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী হয়ে দেশ পরিচালনা কিংবা পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখাও এদেশে অন্যায় কারণ বিদ্যমান ক্ষমতাসীন কাঠামো অপর কাউকে সামান্যতম ছাড় দিতে রাজি নয়। একজন ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আদলতে গিয়ে ন্যায় বিচার পাবে, এ আস্থাও জনমানুষের মধ্যে আনা কঠিন। কারণ, বিদ্যমান সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো এজাতীয় বিচারবিভাগীয় আইনের-শাসন প্রতিষ্ঠাকে তাদের জন্য সম্ভাব্য হুমকী হিসাবে দেখে এবং একে দমনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, দরিদ্র ও গরীব ব্যতীত অন্যায় করে বিচার বিভাগের শাস্তি পেয়েছে এমন নমুনা এদেশে খুব কম। যেকোন ভাবে রাজনৈতিক ছত্রছায়া গ্রহণ করে শক্তিশালী ব্যক্তি বিচার-বিভাগীয় শাস্তি এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়।
সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোতে বিদ্যমান বহুমুখি সমস্যার প্রধানতম কারণ ‘কলোনিয়াল মাইন্ডসেট বা ঔপনিবেশিক মানসিকতা’। এই মাইন্ডসেট যেমনি রয়েছে সমাজের তথাকথিত উচ্চবিত্তদের মাঝে তেমনি রয়েছে আইন-প্রণেতাসহ জনপ্রতিনিধি ও রাষ্ট্র পরিচালনার সকল কাঠামোতে বিদ্যমান আমলাদের মধ্যে।
এ সকল বাধা পেরিয়ে আর্থসামাজিক কাঠামোর উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে কলোনিয়াল মাইন্ডসেট সম্পর্কে আমাদের একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা জরুরী।
বাংলাদেশে বিদ্যমান জনসেবা প্রক্রিয়ায় সামাজিক কাঠামোর সাথে যুক্ত অংশীজনকে প্রধানত দু’ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে, প্রত্যক্ষভাবে জড়িত– যারা এর নিয়ন্ত্রণের সাথে আইনীভাবে ও প্রশাসনিকভাবে যুক্ত; এবং পরোক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিবর্গ/প্রতিষ্ঠান।
জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, গবেষণা সংগঠন,
মসজিদ-মন্দির, সুশীল বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যক্তিবর্গ/সংগঠন, পরিবার, পঞ্চায়েত পরোক্ষভাবে জড়িত।
যারা বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও আইনী কাঠামোগত প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করে এবং সেবাদান প্রক্রিয়াকে সরাসরি প্রভাবিত করে তাদের কলোনিয়াল মাইন্ডসেটই আর্থ-সামাজিক কাঠামোর উন্নয়নের জন্য প্রধানতম বাধা।
এই ক্যাটাগরিতে রয়েছে প্রথমত রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, দল/সংগঠন, তাদের মূলনীতি, কালচার, এবং দ্বিতীয়ত আমলাতন্ত্র বা সরকারি চাকুরিজীবী গোষ্ঠী। কাজেই এই দুই গোষ্ঠীর কলোনিয়াল মাইন্ডসেটের পরিবর্তন বা রুপান্তরই হচ্ছে এদেশের জনসেবার উন্নয়নের মাধ্যমে দেশকে শান্তিপূর্ণ ও সেবাবান্ধব দেশ হিসাবে গড়ে তোলার এক অন্যতম প্রধান মাধ্যম।
জনসেবার ক্ষেত্রে কলোনিয়াল মাইন্ডসেট (Colonial Mindset) হলো এমন একটি মনস্তাত্ত্বিক ও প্রশাসনিক মানসিকতা, যা উপনিবেশিক শাসনের উত্তরাধিকার হিসেবে রাষ্ট্রের সেবাপ্রদানকারী সংস্থা ও কর্মচারীদের মধ্যে বিদ্যমান থাকে। এটি ঔপনিবেশিক শক্তির শাসনামলের সেই মনোভাবকে প্রতিফলিত করে, যেখানে শাসকশ্রেণি জনগণকে প্রজা বা অধস্তন মনে করত এবং জনসেবাকে নিজেদের অধিকার ও ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যম হিসেবে দেখত, জনগণের প্রাপ্য অধিকার হিসেবে নয়।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হামজা আলাভি তার The State in Post-Colonial Societies: Pakistan and Bangladesh প্রবন্ধে বলেছেন, কলোনিয়াল মাইন্ডসেট হচ্ছে ব্যক্তি বা সংগঠনের মধ্যে বিরাজমান, স্পষ্ট বা অস্পষ্ট, দৃশ্যমান বা অদৃশ্যমান এমন এক মানসিক বা প্রশাসনিক চিন্তা যা তাকে জনসেবার আসনে বসিয়েও জনসেবক ভাবতে বাধ্য করেনা, বরং তাকে কলোনিয়াল যুগের মতই নিয়ন্ত্রক, প্রশাসক বা রাজতন্ত্রের রাজার মত এক অস্পষ্ট অনূভূতি এনে দেয়।
বিশেষ করে বাংলাদশ ও পাকিস্তানে তিনি সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের কলোনিয়াল আমলাদের মতই আচরণ করেছেন বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। ভারতীয় আইনজীবী ও লেখক তার India that is Bharat: Coloniality, Civilisation, Constitution এ বলেন, ঔপনিবেশিকতা হলো উপনিবেশিতদের মনে প্রবেশ করানো এক ধরনের (inception), যার ফলে উপনিবেশবাদ এবং ঔপনিবেশিকতা তাদের চেতনার জন্য আর বহিরাগত থাকে না, বরং এর অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। এই মানসিকতা স্থানীয় জনগণের মধ্যে এমন ধারণা জন্ম দেয় যে, পশ্চিমা পদ্ধতিই একমাত্র viable (কার্যকর) পথ, যা তাদের নিজেদের ঐতিহ্য ও উদ্ভাবনী শক্তিকে সংকুচিত করে।
সরকারি দপ্তরের জনসেবার সমস্যা ও জনতুষ্টি বিষয়ক পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, সেবাগ্রহীতাদের অভিযোগ হচ্ছে, দায়িত্বশীল কোন আসনে বসে একজন অফিসার কাজ করতে বাধ্য, এমন চিন্তা ও মানসিকতার বদলে ‘আমাকে ছাড়া কাজটি করা সম্ভব নয়, তাই আমাকে সূযোগ সুবিধা দিয়েই কাজটি করাতে হবে বা আমাকে তেল দিয়েই কাজ করাতে হবে’ এমন চিন্তা অফিসারদের আচ্ছন্ন রাখে। সেবাগ্রহীতাদের যে সেবাটি দরকার, আগে থেকেই সেটি প্রস্তুত না করে, বরং সেবাগ্রহীতা আসলে আসতে-ধীরে সেটি প্রস্তুত করা হয়। পদায়িত অফিসকে ‘জনগণের সম্পত্তি বা সেবাদান কেন্দ্র’ মনে না করে নিজের অফিস বা কর্মক্ষেত্র ভাবায়।এজন্যই দেখা যায়, জনসেবার জন্য নির্ধারিত অফিসে অফিসারের কক্ষ ও বসার আসন এবং রাষ্ট্রের মূল মালিক যে জনগণ তাদের বসার আসনের মধ্যে ঢের পার্থক্য। পাবলিক অফিসে জনসেবকদের ব্যবহারের বাথরুম স্বতন্ত্র ও মানসম্পন্ন হলেও জনগণের জন্য নির্ধারিত বাথরুমটি, অনেকক্ষেত্রেই ব্যবহারের অনুপযোগী।
তাদের মতে, কলোনিয়াল মাইন্ডসেট এর কারণে এখনও পাবলিক অফিসের পদায়িত কর্মচারীগণ ব্রিটিশযুগের মত কতটা সম্মান পেল বা কতটা সুন্দরভাবে তাকে সম্বোধন করা হল বা কতটা ক্ষমতাধর তাকে মনে করা হলো তার চিন্তায় আবিষ্ট থাকে।
অথচ এদেশে প্রায় ৭৫ বছর আগে এবং স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে ৫৪ বছর আগে ব্রিটিশযুগীয় সামন্তবাদী বা রাজা প্রজা জাতীয় শাসন- কাঠামোর পতন হয়েছে, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জনগণ-কেন্দ্রিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। যেখানে রাজা, সম্রাট বা জমিদার নয়, জনগণের সেবা-মানই হচ্ছে মূল ফোকাস, জনগণকে আস্থায় আনাই হচ্ছে প্রধান টার্গেট, আইনী কাঠামোর মধ্যে জন-সন্তোষ অর্জনই মূল লক্ষ্যবিন্দু।
এ ব্যবস্থায় অফিসের জনসেবা প্রদান পদ্ধতিকে হতে হবে জনগণ-বান্ধব এবং আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে
আইসিটিনির্ভর ও হিউম্যান-টাচহীন। পাবলিক সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মপরিবেশ এবং সেবাদান পদ্ধতির ক্রমাগত উন্নতি করতে হবে।
ধারা যাক, আজ যে কাজ হচ্ছে সাত স্তরে ও সাত দিনে, পরের দিন, পরের মাস বা পরের বছর সেই সেবা যেন আরো কম ধাপে এবং আরো কম সময়ে সম্পন্ন করা যায় সে বিষয়ে ক্রমাগত গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে।
সেবাগ্রহীতাদের মতে, কলোনিয়াল মাইন্ডসেটের আরো কিছু বৈশিষ্ট্য হচ্ছে; সরকারি অফিসের মধ্য আন্তঃযোগাযোগ ও আন্তঃসম্পর্কের ঘাটতি। সকলেই নিজে স্বাধীন ও অন্যদের সাথে সংযোগবিহীন থেকে কাজ করতে চায়। এমনকি একই অফিসের বিভিন্ন শাখার মধ্যেও কোন যোগাযোগ থাকেনা। ফলে বিভিন্ন শাখায় গিয়ে সেবাগ্রহীতাদের হয়রানী হতে হয়। এতে জনদূর্ভোগ বাড়ে এবং জনতুষ্টি কমে আসে ব্যাপক হারে।
কলোনিয়াল মাইন্ডসেট শুধুমাত্র আমলাদের মধ্যে নয়, বিরাজমান এদেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যেও। এদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুফল জনগণ না পাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, নামে এদেশ থেকে ব্রিটিশ শাসনের পতন, পাকিস্তানের শাসনমুক্ত হয়ে স্বাধীনতা অর্জন এবং গণুভ্যুত্থানের মাধ্যমে বার বার স্বৈরাচারের পতন হলেও, প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চা এদেশে তার শেকড় গাড়তে পারেনি।
প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চা হলে এদেশে (৩৬ জুলাই ২০২৪ এ) জুলাই বিপ্লবে হাজার হাজার আহত কিংবা শত শত প্রাণহানির ঘটনা কিংবা আয়নাঘরের মত অমানবিক ও হিটলারীয় ধারণার জন্মলাভ হতোনা। এদেশে নাগরিক-বান্ধব উন্নয়ন পরিকল্পনা করা হলেও, তার বাস্তবায়নে নাগরিকদের যুক্ত থাকার কোন সূযোগ নেই। বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার পুরোটাই আমলাতান্ত্রিক। এই আমলাতান্ত্রিকতা এতটাই কেন্দ্রীভূত যে, যারা বাস্তবায়নের কাজে যুক্ত তাদেরকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করা যায় না বলেই সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রবল ধারণা রয়েছে।
তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ পাশ হলেও তথ্যে জনগণের অধিকার নিশ্চিত হয়নি। জনপ্রতিনিধিদের যে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিকে জনকল্যাণে কাজে লাগানোর কথা ছিল, তারা যখন বিপরীতটা করেন, তখন, জনগণের পক্ষে কথা বলার কেউ থাকেনা। যে রাজতন্ত্রের পতনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের উত্থান হয়েছিল, সেই গণতান্ত্রিক দেশের জনপ্রতিনিধিদের মধ্যেই রাজতন্ত্রের সেই ‘বীজ’ দেখা যাচ্ছে।
সবাই জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতার বাইরে থাকতে চায় সেই রাজতন্ত্র যুগের রাজাদের মতই। গণতন্ত্র মেনে গণভোটে নির্বাচিত হবার পরে তারাই আবার ক্ষমতাকে “ডিভাইন পুরস্কার” হিসাবে পেতে চায়। অথচ, একই কারণে ১৬২৫ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম চার্লস এবং ১৭৮৯ সালে ফরাসী রাজা ষোড়শ দ্যা লুই-এর পতন হয়েছিল এবং তাদেরকে যথাক্রমে প্রকাশ্যে শিরচ্ছেদ ও গিলোটিনে হত্যা করা হয়েছিল। গণতন্ত্রে উত্তরণের সেই আন্দোলন, ত্যাগ ও অমানবিক ঘটনাবলী গভীরভাবে চর্চার না করার ফলে তারা একই ধরণের তথাকথিত রাজকীয় আচরণ ও কর্মকান্ড পরিচালনা করতে দ্বিধাবোধ
করেনা। গণতন্ত্রে উত্তরণের এই ইতিহাস সম্পর্কে রাজনৈতিক কর্মী, জনগণ ও শিক্ষার্থীদের সচেতন করা গেলে সকলেই তাদের গণতান্ত্রিক আচরণ ও দায়িত্ববোধ সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারবে যা নিশ্চিত করবে জনসেবার মান।
ব্রিটিশ শাসনামলের কলোনীযুগের পরিবর্তন হলেও সে জায়গা দখলে করেছে বর্তমানে পশ্চিমা দর্শন। তাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তাদের উপর নির্ভরশীল করে রাখছে। এজন্য তারা তৈরি করছে সামাজিক দর্শন। পশ্চিমা চিন্তা কিভাবে বর্তমানে তাদের শ্রেষ্ঠত্বের চিন্তা অন্য-দুনিয়ার মানুষের মধ্যে টিকিয়ে রাখছে তা ফুটে উঠেছে দার্শনিক চিন্তাবিদ এডওয়ার্ড সাইদের লিখায়। তিনি তার ‘ওরিয়েন্টালিজম’ বইতে দেখিয়েছেন কিভাবে পশ্চিমা চিন্তা অন্যদের উপর প্রভুত্ব বজায় রাখছে। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা কলোনিযুগের প্রভাব ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের মানব-সাইকিতে হীনমন্যতা ও আত্ম-পরিচয়ের সংকট কিভাবে তৈরি করেছে তা দেখতে পাওয়া যায় ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ক বিখ্যাত আলজেরিয়ান দার্শনিক, তাত্ত্বিক ও আলজেরিয়ান ন্যাশন্যাল লিবারেশোন ফ্রন্ট-এর এক যোদ্ধা
সমাজবিজ্ঞানী ফ্রাঞ্চ ফ্যানন-এর লিখায়। এ বিষয়ে তার লিখিত ‘ব্ল্যাক স্কিন, হোয়াইট মাস্ক’ এবং ‘দ্যা রেচড অব দ্যা আর্থ’ বই দুটি খুবই বিখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য দলিল হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
ফ্যাসিজম ও কলোনিয়াল মাইন্ডসেট:
স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার সঙ্গে কলোনিয়াল মাইন্ডসেটের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে (হামজা আলাভী, ১৯৭২)। অনেক ক্ষেত্রে, স্বৈরাচারী শাসনব্যাবস্থা ও আমলাদের কলোনিয়াল মাইন্ডসেট কিভাবে একে অপরকে সহায়তা করে এবং শক্তিশালী করে টিকিয়ে রাখে সে বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তারিক আলী তার “The State in the Post-Colonial Societies” প্রবন্ধে দেখিয়েছেন। স্বৈরাচারী শাসনের ভিত্তি তৈরি করে এবং একে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে। ডক্টর হাসানুজ্জামান জামান (২০২৩) তার Challenging Colonial Administrative Behavior in Bangladesh বইতে দেখিয়েছেন, বাংলাদেশে আমলাদের প্রশাসনিক আচরণ হচ্ছে ব্রিটিশ শাসন ও স্বৈরাচারী শাসনের দ্বৈত উত্তরাধিকারী। কলোনিয়াল মাইন্ডসেট বাংলাদেশের প্রশাসনিক আচরণে আরো অনেকভাবে প্রকাশ হয়।
ভারতীয় লেখক ও সমাজবিজ্ঞানী আশিস নন্দী তার The Intimate Enemy বইতে যুক্তি দিয়েছেন যে, কলোনিয়ালিজম কেবল রাজনৈতিক শোষণের পদ্ধতি ছিল না বরং এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোও তৈরি করে। এই কাঠামোতে শাসক ও তাদের আমলাগোষ্ঠী জনগণের ওপর প্রভুত্ব করতে অভ্যস্ত হয় এবং জনগণও এই প্রভুত্বকে মেনে নিতে শেখে। এই মানসিকতা স্বৈরাচারী শাসনকে স্বাভাবিক করে তোলে। ফ্রাঞ্জ ফ্যানন (Frantz Fanon) তার The Wretched of the Earth গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, কীভাবে ঔপনিবেশিক আমলের মানসিকতা এবং কাঠামো উপনিবেশ-পরবর্তী দেশগুলোতে স্বৈরাচারী
শাসকদের উত্থানকে উৎসাহিত করেছে। তিনি বলেন, ঔপনিবেশিক শক্তি চলে গেলেও তাদের রেখে যাওয়া প্রশাসনিক কাঠামো এবং মানসিকতা নতুন স্বৈরাচারী শাসকদের জন্য একটি প্রস্তুত ক্ষেত্র তৈরি করে।
জনসেবা একক এবং স্বনির্ভর মৌলিক কোন বিষয় নয়। বরং এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া যা অনেকগুলো দার্শনিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ফ্যাক্টরের উপর নির্ভরশীল। এটি ক্রমাগত চলমান প্রক্রিয়া এবং অসীম তার লক্ষ্য।
বিখ্যাত দার্শনিক আব্রাহাম মাশলো (১৯৪৩) সালে তার “A Theory of human motivation” প্রবন্ধে দেখিয়েছেন মানুষের চাহিদা ক্রমবর্ধান ও স্তরভিত্তিক (Continuous and Hierarchical)। এটি চুড়ান্তভাবে কখনোই শেষ হবার মত বিষয় নয়। একটি ধাপ পূরণ হলেই পরের ধাপের চাহিদা তৈরি হয় (Self Actualisation)। এজন্য জনসেবাকে সর্বদাই চাহিদার সাথে সংগতি রেখে অগ্রসর হতে হবে। বলা যায়, Public service is an ever-going and never-ending process।
এতে সর্বদাই নতুন পরিস্থিতি সামনে আসে, নতুন চাহিদা সামনে আসে এবং সৃজনশীলভাবেই এর সমাধান করতে হয়। প্রতিটি সমস্যা সমাধানে বা জনসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে আগের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন পলিসি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়। জাপানিজ দর্শন ‘কাইজেন’ এক্ষেত্রে মুখ্যভূমিকা পালন করতে পারে। একজন রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি, কিংবা আমলা সকলের সব সময়ের চিন্তা-দর্শন হবে সামাজিক-কাইজেন। এতে কর্মপরিবেশ কিংবা সেবাদান প্রক্রিয়া ক্রমাগত হতে থাকবে জন-বান্ধব যা অর্জন করবে জনআস্থা। এই জনআস্থা গড়ে তুলবে এক শান্তিপূর্ণ সমাজ যার প্রত্যাশায় ছুটে চলছে এই মানব-সভ্যতা অনন্তকাল ধরে, অন্তহীনভাবে।
মাহবুবুর রহমান
mahbub.cn@gmail.com