বাংলাদেশে মাছ উৎপাদনে ময়মনসিংহ আবারও শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। এ বছর জেলাটিতে উৎপাদিত মাছের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে চার লাখ ১৮ হাজার ৬৪৫ টনে, যার আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ১২ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। মাছ চাষ এখন জেলার সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পরিণত হয়েছে।
২৬ বছর আগে মাত্র ১০ একর পুকুর নিয়ে মাছ চাষ শুরু করেছিলেন ভালুকার শাহাবুদ্দিন খান। প্রথমদিকে দেশীয় রুই, কাতলা, মৃগেল চাষ করলেও ২০০৭ সালে তিনি পাঙাশ চাষ শুরু করেন। বর্তমানে তাঁর খামারের পরিমাণ ১২০ একর, যেখানে পাঙাশের পাশাপাশি তেলাপিয়া, শিং, মাগুর ও আরও নানা প্রজাতির মাছ উৎপাদন হচ্ছে।
শাহাবুদ্দিনের মতো প্রায় এক লাখ ২০ হাজার চাষি এখন এ জেলায় বাণিজ্যিক মাছ উৎপাদনে যুক্ত। জেলায় তিন লাখেরও বেশি পুকুর ও খামারের মধ্যে এক লাখের বেশি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানকার মাছ দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশ জোগান দেয়। প্রতিদিন শত শত ট্রাকে মাছ সরবরাহ হচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে ময়মনসিংহে উৎপাদন হয়েছিল তিন লাখ ৪৫ হাজার এক টন মাছ। এ বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার লাখ টনের বেশি। কুমিল্লা দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে তিন লাখ ২৬ হাজার টন নিয়ে। যশোরের তথ্য এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয়নি।
ত্রিশালের হুমায়ূন আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে চাকরি না খুঁজে নামেন মাছ চাষে। ২০১৯ সালে মাত্র এক একর পুকুরে শিং মাছ দিয়ে শুরু করেন। প্রথম বছরেই লাভ দেখে আরও বড় আকারে চাষ শুরু করেন তিনি। বর্তমানে বছরে কোটি টাকারও বেশি আয় করছেন।
মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, মাছ উৎপাদনে সবচেয়ে এগিয়ে ভালুকা উপজেলা, যেখানে এক বছরে উৎপাদিত হয়েছে ৮৩ হাজার ৫৫৩ টন। এরপর রয়েছে ত্রিশাল (৭২ হাজার ৮৮ টন) ও মুক্তাগাছা (৪২ হাজার টন)।
উৎপাদন বাড়লেও চাষিরা নানা সংকটে ভুগছেন। খাবারের উচ্চমূল্য, বিদ্যুতের বাণিজ্যিক বিল, ব্যাংক ঋণের উচ্চসুদ, আকস্মিক বন্যা ও রোগবালাই বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। পরীক্ষাগার ও সংরক্ষণ সুবিধার ঘাটতির কারণে অনেক সময় উৎপাদিত মাছের ন্যায্যমূল্য পাওয়া যায় না।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন জানান, বিদ্যুৎ বিল কৃষি খাতের মতো সহনীয় পর্যায়ে আনা উচিত। খাবারের দাম নিয়ন্ত্রণ ও বাজার ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী হলে উৎপাদন আরও বাড়বে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ড. মশিউর রহমান বলেন, মাছের খাবারের কাঁচামাল দেশে উৎপাদনের উদ্যোগ নিলে খরচ কমবে। আর জলাশয়গুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা উৎপাদন বাড়াতে সহায়ক হবে।
ময়মনসিংহ বিভাগীয় মৎস্য অফিসের পরিচালক নৃপেন্দ্রনাথ বিশ্বাস জানান, এখানকার প্রকৃতি ও চাষিদের একাগ্রতাই এই সাফল্যের মূল চালিকা শক্তি। তিনি বলেন, “আমাদের লক্ষ্য একটি টেকসই বাজার ও আন্তর্জাতিক রপ্তানি কাঠামো গড়ে তোলা। এতে চাষিরা তাদের ন্যায্যমূল্য পাবেন এবং দেশও লাভবান হবে।”