রেড সাগা, ১০ জুলাই ২০২৫ — মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম ব্যস্ত সমুদ্রপথ রেড সাগরে আবারও হুতি বিদ্রোহীদের সশস্ত্র হামলার শিকার হলো একটি বাণিজ্যিক জাহাজ। এটারনিটি সি নামের লিবারিয়ান পতাকাবাহী এবং গ্রিস-চালিত একটি কার্গো জাহাজ রকেটচালিত গ্রেনেড ও বিস্ফোরণের আঘাতে ডুবে যায়। হামলার পর ছয় জন নাবিককে জীবিত উদ্ধার করা হলেও অন্তত তিনজনের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। এখনও ১৯ জন নাবিক নিখোঁজ রয়েছেন।
ইউরোপীয় নৌ মিশন ‘অপারেশন অ্যাসপিডেস’ জানিয়েছে, উদ্ধারকৃত ছয়জনের মধ্যে পাঁচজন ফিলিপাইনের নাগরিক এবং একজন ভারতীয়। তারা জানায়, উদ্ধার অভিযান এখনও চলমান রয়েছে, এবং শেষ আলোর আগ পর্যন্ত তল্লাশি চালানো হবে।
কীভাবে ঘটেছিল হামলা
যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইউকে মেরিটাইম ট্রেড অপারেশনস (UKMTO) জানিয়েছে, সোমবার (৮ জুলাই) ছোট ছোট নৌকা থেকে হুতিরা জাহাজটিকে লক্ষ্য করে রকেটচালিত গ্রেনেড (RPG) নিক্ষেপ করে। এতে জাহাজটি গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং প্রপালশন সিস্টেম অকার্যকর হয়ে পড়ে। পরদিন মঙ্গলবার পর্যন্ত হামলা চলতে থাকে এবং রাতভর চালানো হয় উদ্ধার অভিযান।
গ্রিসভিত্তিক মেরিটাইম নিরাপত্তা সংস্থা ‘ডায়াপ্লাস’ একটি ভিডিও প্রকাশ করে, যেখানে দেখা যায় আহত নাবিকদের উদ্ধার করা হচ্ছে। তাদের একজন জানিয়েছেন, জাহাজ ডুবে যাওয়ার পর কিছু নাবিক ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় পানিতে ভেসে ছিলেন।
হুতিদের দায় স্বীকার, ‘ইসরায়েলগামী জাহাজে’ হামলার দাবি
ইরান-সমর্থিত ইয়েমেনের হুতি গোষ্ঠী দাবি করেছে, তারা ইচ্ছাকৃতভাবে এটারনিটি সি নামক জাহাজে হামলা চালিয়েছে, কারণ এটি ইসরায়েলের দিকে যাচ্ছিল। তবে হুতিদের এই ধরনের অভিযোগ অতীতেও অনেকবার মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। গোষ্ঠীটি আরও জানায়, তারা কিছু নাবিককে “নিরাপদ স্থানে” সরিয়ে নিয়েছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েমেন দূতাবাস জানিয়েছে, হুতিরা “বেঁচে যাওয়া নাবিকদের অনেককে অপহরণ করেছে” এবং তাদের অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানায়।
ফিলিপাইন ও রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া
ফিলিপাইন সরকার নিশ্চিত করেছে যে এটারনিটি সি জাহাজের ২১ জন নাবিকই তাদের দেশের নাগরিক। অন্যদিকে, একটি সূত্র জানায়, রুশ এক নাবিক হামলায় গুরুতর আহত হয়ে একটি পা হারিয়েছেন। রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
আরও এক সপ্তাহে ডুবে গেল দ্বিতীয় জাহাজ
এই হামলার মাত্র কয়েকদিন আগে হুতিরা ‘ম্যাজিক সিস’ নামে আরও একটি লিবারিয়ান পতাকাবাহী গ্রিস-চালিত জাহাজে মিসাইল ও ড্রোন হামলা চালায়। হুতিরা দাবি করে, এটি এমন একটি কোম্পানির মালিকানাধীন ছিল যা ‘অধিকৃত ফিলিস্তিনে’ প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করেছে। তবে ওই জাহাজের ২২ জন নাবিক সবাই নিরাপদে উদ্ধার হন।
হুতিদের সাম্প্রতিক হামলা পরিসংখ্যান
২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে হুতি গোষ্ঠী রেড সাগর ও গালফ অব অ্যাডেনে প্রায় ৭০টি বাণিজ্যিক জাহাজে বিভিন্ন ধরনের হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যে তারা চারটি জাহাজ ডুবিয়েছে, একটি দখলে নিয়েছে এবং অন্তত ৭ জন নাবিককে হত্যা করেছে।
হুতিরা দাবি করে, এই হামলা তারা চালাচ্ছে গাজায় ইসরায়েল ও হামাসের চলমান যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে। তবে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই হামলাগুলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং সমুদ্রপথে চলাচলের স্বাধীনতার ওপর মারাত্মক হুমকি তৈরি করেছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও নিন্দা
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর এই হামলাকে “আন্তর্জাতিক নৌ চলাচলের ওপর হুতি সন্ত্রাসী হুমকি” হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। মার্কিন সরকার জানিয়েছে, তারা সমুদ্রপথে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ চালিয়ে যাবে।
আন্তর্জাতিক মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের (IMO) মহাসচিব আর্সেনিও ডোমিঙ্গেজ বলেছেন, “এই হামলাগুলো আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন এবং বেসামরিক নাবিকদের জীবনকে বিপন্ন করছে। এই ধরনের কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে জোরালোভাবে মোকাবিলা করা দরকার।”
ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা
যদিও মে মাসে হুতিদের সঙ্গে একটি সীমিত যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে, তবুও হুতিরা জানায় যে, তাদের হামলা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অব্যাহত থাকবে। এদিকে, ইসরায়েলও ইয়েমেনে বেশ কয়েকটি প্রতিশোধমূলক বিমান হামলা চালিয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, রেড সাগরে চলমান এই উত্তেজনা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল, জ্বালানি পরিবহন ও সামুদ্রিক পরিবেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদি হুমকি হয়ে উঠছে।