শাব্বির এলাহী, কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার):
২০২৪ সালের ৪ আগস্ট,বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে উত্তাল পুরো দেশ। এই উত্তাল ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার এম এ ওহাব উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র তোফাজ্জলের জীবনেও।
সেদিন সকাল সাড়ে ৯টায় কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় সে। গন্তব্য মৌলভীবাজার জেলা শহর—ছাত্রদের মিছিল-সমাবেশে যোগ দিতে। দুপুরে পৌছে যায় মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের সামনে। মিছিল এগোতে থাকে চৌমুহনী বাজারের দিকে। হঠাৎই শুরু হয় পুলিশের লাঠিচার্জ, টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ। ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরাও তখন পুলিশকে সহায়তা করছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।
তোফাজ্জলের চোখের সামনে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সে নিজেও গুলিবিদ্ধ হয়, পরে আরও কয়েক দফা গুলিতে তার শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যায়। একপর্যায়ে চাঁদনীঘাটের ব্রিজ এলাকায় পুলিশের ট্যাংকার থেকে ছোড়া গুলিতে লুটিয়ে পড়ে তোফাজ্জল।
জ্ঞান ফিরে পেলে সে একটি অটোরিকশার পেছনে আশ্রয় নেয়। এরপর রক্তাক্ত অবস্থায় টলোমলো পায়ে একটি ফার্মেসিতে গিয়ে নেয় প্রাথমিক চিকিৎসা। সন্ধ্যায় সিএনজিযোগে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরের নিজ বাড়ি—কাউয়ারগলা গ্রামে ফিরে আসে।
তার বাবা দরিদ্র সবজি বিক্রেতা ইছুব আলী (৫৬) ও মা সুফিয়া বেগম (৪১)। চার সন্তানের মধ্যে তোফাজ্জল সবার ছোট। বর্তমানে সে এসএসসি পাশ করেছে মানবিক বিভাগ থেকে। পরিবারের অভাবের কারণে বড় মেয়ের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে।
প্রথমদিকে পুলিশের ভয়ে তোফাজ্জলকে কোথাও চিকিৎসা করাতে পারেননি বলে জানান তার বাবা। অনেক কষ্টে ধারদেনা করে তাকে ঢাকাস্থ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যান, যেখানে শরীর থেকে ২টি গুলি অপসারণ করা হয়। স্থানীয় এক পল্লী চিকিৎসক আরও একটি গুলি বের করেন। এখনও শরীরে রয়েছে ১৬ থেকে ১৭টি বুলেটের টুকরো।
সে ভালোভাবে হাঁটতে পারে না, পায়ে ঝিনঝিন ব্যথা করে, বাইসাইকেল চালানো তো দূরের কথা। যে বাইসাইকেল নিয়ে সে স্কুলে যেত, তা আজ ঘরের কোণায় পড়ে আছে।
গত ৮ মে জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে তোফাজ্জল পেয়েছে ১ লাখ টাকার আর্থিক অনুদান। এর আগে পেয়েছে আরও ১৫ হাজার টাকা। এসব অর্থ দিয়ে চলেছে তার চিকিৎসা ও সংসারের ব্যয়ভার।
তবু থেমে নেই তোফাজ্জলের স্বপ্ন। গুলিবিদ্ধ পায়ে সে হেঁটে চলেছে শিক্ষা ও মানবিকতার পথেই। সে চায়—এক বৈষম্যহীন স্বদেশ, যেখানে ভাইবোনসহ সবাই শিক্ষা পাবে, স্বপ্ন দেখবে, আলো পাবে।