সউদ আব্দুল্লাহ,কালাই (জয়পুরহাট) প্রতিনিধি :
জয়পুরহাটের কালাই উপজেলায় প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি কার্যক্রম নিয়ে একের পর এক চাঞ্চল্যকর প্রতারণার ঘটনা ঘটছে।সরকারের শিক্ষাখাতে সরাসরি সহায়তার এই মহৎ কর্মসূচি এখন হ্যাকার চক্রের কবলে পড়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। হ্যাকার চক্রের নতুন ও ভয়াবহ কৌশলে সরকারের বরাদ্দ করা উপবৃত্তির অর্থ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সুবিধাভোগী শিক্ষার্থীরা আর এতে চরম বেকায়দায় পড়েছেন বিদ্যালয় প্রধানরা।
প্রথমে ২০২৪ সালের জুলাই-ডিসেম্বর মেয়াদে কালাই উপজেলার ২৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৯৬৭ জন শিক্ষার্থীর নগদ মোবাইল অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে লক্ষাধিক টাকা আত্মসাৎ করে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। ঘটে যাওয়া প্রথম পর্বের হ্যাকিংয়ের ঘটনায় দায় এড়াতে পারেননি তৎকালীন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু এতদিনেও আত্মসাৎকৃত অর্থ উদ্ধার কিংবা হ্যাকারদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি।এরপর আবার ২০২৫ সালের জানুয়ারি-জুন মেয়াদে উপজেলার বাকি ২৭টি বিদ্যালয়ও একই প্রতারণার কবলে পড়ে।অর্থাৎ,পুরো উপজেলার ৫৪টি বিদ্যালয়ই এখন হ্যাকারদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।
প্রতারণার পদ্ধতিটি এইবার আরও জটিল ও গভীরভাবে উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। অনলাইনে উপবৃত্তির ডাটা এন্ট্রি ও ক্লাস্টার অনুমোদনের পর বিদ্যালয় থেকে চাহিদা পাঠানোর পূর্বমুহূর্তে অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের মোবাইল নম্বর গোপনে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। হ্যাকাররা আগেই ঐসব নম্বর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিচ্ছে, ফলে সরকারি অর্থ সরাসরি প্রতারকদের হাতে চলে যাচ্ছে।এই প্রতারণা যে কেবল প্রযুক্তিগত দক্ষতার ফল তা নয় বরং এর পেছনে সংশ্লিষ্ট সফটওয়্যার ব্যবস্থার মারাত্মক নিরাপত্তা দুর্বলতা কাজ করছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষক প্রধানরা।
প্রতিষ্ঠান প্রধানদের দাবি, হ্যাকার চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা,সফটওয়্যার ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক। তা না হলে এই কার্যক্রম প্রতারকদের কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে।
একডালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আব্দুল হাকিম বলেন,আগে হ্যাকারদের জিম্মিতে ছিল ২৭টি বিদ্যালয়, এখন পুরো উপজেলার ৫৪টিই তাঁদের দখলে।এ অবস্থা চলতে থাকলে প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম নিরাপত্তার মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে।
মাদাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মজিদ বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া নগদ একাউন্ট খোলা সম্ভব নয়। তাহলে কিভাবে একই পরিচয়পত্রে ভিন্ন মোবাইল নম্বর যুক্ত করে একাউন্ট চালু হচ্ছে! এটি এক ধরনের প্রযুক্তিগত ভেলকিবাজি ছাড়া কিছু নয়।
কালাই মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমিনুল ইসলাম মনে করেন,এটি শুধু হ্যাকারদের প্রযুক্তির ব্যাপার নয়, বরং সংশ্লিষ্ট সফটওয়্যার ব্যবস্থার দুর্বলতা ও নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠায়। সম্ভবত কোনো ক্লোন বা ডুপ্লিকেট সফটওয়্যারের মাধ্যমে তথ্য পাচার হচ্ছে। আজ কালাইয়ে, কাল সারাদেশে হতে পারে। তাই জরুরি তদন্ত প্রয়োজন।
কালাই উপজেলা শিক্ষা অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাশেদুল আলম জানান,শিক্ষার্থীদের তথ্য অনলাইনে এন্ট্রি কেন হচ্ছে না,তা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা শিক্ষা কমিটির সভাপতি শামিমা আক্তার জাহান বলেন, উপবৃত্তি কার্যক্রমে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।বিষয়টি ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে অবহিত করা হয়েছে।
জয়পুরহাট জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মমিনুল ইসলাম জানান, পুরো বিষয়টি জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি সফটওয়্যার ব্যবস্থার দুর্বলতা চিহ্নিত, মোবাইল নম্বর পরিবর্তনের উৎস শনাক্ত এবং হ্যাকারদের চিহ্নিত করতে সাইবার অপরাধ দমন সংস্থার সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজন হলে বিকল্প নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থার বিষয়েও সুপারিশ জানানো হবে।