বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে গুম হয়ে যাওয়া মানুষদের গল্প যেন কেবল নিখোঁজ হওয়ার নয়, বরং তার চেয়েও ভয়াবহ এক বাস্তবতার চিত্র। গুম কমিশনের সাম্প্রতিক অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন সব লোমহর্ষক নির্যাতনের বিবরণ, যা রীতিমতো শিউরে উঠার মতো।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গুম হওয়া ব্যক্তিদের শরীরে যাতে নির্যাতনের চিহ্ন জনসমক্ষে না আসে, সে জন্য তাদের শরীরে মলম লাগিয়ে ক্ষত ঢেকে দেওয়া হতো। নির্যাতনের দাগ না মুছে গেলে অনেক সময় তাদের মুক্তিও দিত না বাহিনী। এমনকি কেউ কেউ ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে নির্যাতনের দাগ দেখালেও অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়নি।
ভুক্তভোগীদের রাখা হতো শব্দনিরোধক বিশেষ কক্ষে, যেখানে তাদের আর্তনাদও বাইরের কেউ শুনতে পেত না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব গুমের ছিল না কোনো আনুষ্ঠানিক রেকর্ড, ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো আইনি দায় ছাড়াই চালাতে পারত চরম বর্বরতা।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় কথিত ‘সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র’ অনুসন্ধানে যাদের গুম করা হতো, তাদের রাখা হতো ‘স্পেশাল সেল’-এ, যেখানে নির্যাতন হতো ‘শিফটিং সিস্টেম’-এ। একেক সময় একেক বাহিনী একেক পদ্ধতিতে নির্যাতন করত—কখনো ঝুলিয়ে পেটানো, কখনো নখ তুলে নেওয়া, আবার কখনো বৈদ্যুতিক শক। অনেকে অজ্ঞান হয়ে যেত, কেউ কেউ নিজের শরীরের পোড়ার গন্ধ পর্যন্ত পেত।
নারীরা ছিলেন আরও বেশি অসহায়। একজন ২৫ বছর বয়সী নারী জানান, তাকে ক্রুশবিদ্ধের মতো ঝুলিয়ে রাখা হয়, গায়ে ছিল না ওড়না। জানালার মুখোমুখি করে রাখা অবস্থায় বাহিনীর সদস্যরা বারবার এসে তাকে দেখে মজা পেত, কেউ কেউ বলত, “এখন সব পর্দা ছুটে গেছে।” ওই নারী আরও জানান, পিরিয়ড শুরু হলে তিনি যখন প্যাড চাইতেন, তখন সেটি নিয়েও তারা হাসাহাসি করত।
পুরুষদের নির্যাতনও ছিল ভয়াবহ। সংকীর্ণ কক্ষে, টয়লেট প্যানের উপর শুয়ে থাকতে হতো। সিসিটিভিতে প্রতিটি কাজ নজরদারিতে থাকত। খাবার, ঘুম, টয়লেট—সব কিছুতেই লাঞ্ছনার চরম সীমা। কেউ কেউ জানান, ঘূর্ণায়মান চেয়ারে বসিয়ে নির্যাতন, মুখে গামছা ঢুকিয়ে পানির চাপ, গোপনাঙ্গে শক দেওয়া ছিল রোজকার ঘটনা।
একজন বলেন, “পায়ে ক্লিপ লাগিয়ে শক দিলে পুরো শরীর ফুটবলের মতো গোল হয়ে যেত।” আরেকজন বলেন, “প্রস্রাবের সময় বৈদ্যুতিক শক, গোপনাঙ্গে প্লাস দিয়ে চেপে ধরা হতো।” এমন বর্বর নির্যাতন চালানো সদস্যদের অনেকেই এখনও চাকরিতে বহাল। কেউ গ্রেপ্তার হয়নি, শাস্তিও হয়নি।
গুমের শিকার ভুক্তভোগীরা বলছেন, বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি চলতে থাকলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ আরও ভয়াবহ গুম সংস্কৃতির দিকে ধাবিত হবে।