নিজস্ব প্রতিবেদক:
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৪ হাজার ৩৪৫ জন। কিন্তু একমাত্র জুন মাসেই আক্রান্ত হয়েছেন ৫ হাজার ৮০৪ জন—যা আগের পাঁচ মাসের সম্মিলিত সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে। সরকারি হিসাবে এটিই দেশের ইতিহাসে এক মাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংক্রমণের রেকর্ড।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল (১ জুলাই) পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৬৮২ জন। এর মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন ৪৩ জন। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় (সোমবার সকাল ৮টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) আক্রান্ত হয়েছেন ৩৮৬ জন এবং মৃত্যু হয়েছে একজনের।
ডেঙ্গুর অনুকূলে আবহাওয়া
জনস্বাস্থ্যবিদ ও কীটতত্ত্ববিদেরা মনে করছেন, জুন মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টি এবং বেশি আর্দ্রতার কারণে এডিস মশার প্রজনন বেড়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, জুনে গড় বৃষ্টিপাত ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে অন্তত ২০ শতাংশ কম, আর বাতাসে আর্দ্রতা ছিল ৯০ শতাংশের কাছাকাছি।
আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান কীটতত্ত্ববিদ তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “আবহাওয়া ডেঙ্গুর জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। এর মধ্যে সেরোটাইপ-৩ এর বিস্তার একটি নতুন সংকেত দিচ্ছে, যা রোগীর জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।”
আইইডিসিআরের সাম্প্রতিক জরিপে বরগুনায় সেরোটাইপ-৩ এর প্রাধান্য পাওয়া গেছে। ২০২৩ সালে দেশে ডেঙ্গুর ভয়াবহ সংক্রমণের সময় সেরোটাইপ-২ ছিল প্রধান। নতুন ধরনের বিস্তার সংক্রমণের গতি ও জটিলতা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
ঢাকার চেয়ে বেশি প্রাদুর্ভাব অন্যান্য জেলায়
চলতি বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঢাকার তুলনায় বেশি ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। রাজশাহী, চট্টগ্রাম, বরিশাল, বরগুনা, সিলেটসহ বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয়ভাবে ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে। জনস্বাস্থ্যবিদদের মতে, এলাকাভিত্তিক হটস্পট ম্যাপিং ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এখন জরুরি হলেও, বাস্তবে এমন কোনো দৃশ্যমান তৎপরতা নেই।
জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি ঘোষণা দাবি
ডেঙ্গুর দ্রুত সংক্রমণ ও মৃত্যুহারের ঊর্ধ্বগতি দেখে জনস্বাস্থ্যবিদেরা এ রোগকে ‘জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি’ ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, “এখন ডেঙ্গু পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, একে আর হেলাফেলা করার সুযোগ নেই। জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে সমন্বিত প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।”
পরীক্ষার ফি নির্ধারণ
এই পরিস্থিতিতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ডেঙ্গু পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
- সরকারি হাসপাতালে: এনএস, আইজিজি, আইজিএম—প্রতিটি পরীক্ষার ফি ৫০ টাকা
- বেসরকারি হাসপাতালে: একই পরীক্ষাগুলোর ফি ৩০০ টাকা করে
- সিবিসি (CBC) পরীক্ষার ফি: ৪০০ টাকা
এই সিদ্ধান্ত ১ জুলাই থেকে কার্যকর হয়েছে এবং চলবে আগামী বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত।
২০২৩ সালের রেকর্ড সংক্রমণ
উল্লেখ্য, দেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুর সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয়েছিল ২০২৩ সালে। সে বছর আক্রান্ত হন ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন এবং মৃত্যু হয়েছিল ১ হাজার ৭০৫ জনের—যা আগের ২৩ বছরের মোট মৃত্যুর সংখ্যার চেয়েও বেশি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর উদ্যোগ না নিলে ২০২৫ সালেও ভয়াবহ পরিস্থিতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।