🌙 ঈদুল আজহা ২০২৫: আত্মত্যাগ, মানবতা ও সমবেদনার এক মহোৎসব

লেখা: আনোয়ার মুরাদ | তারিখ: ৪ জুন ২০২৫
স্থান: ৩৩ ওল্ডপোর্ট রোড, ওয়েনভো, ভেল অব গ্লামোর্গান, CF5 6AL

ভূমিকা

প্রতি বছর মুসলিম উম্মাহর কাছে পবিত্র ঈদুল আজহা আসে এক গভীর বার্তা নিয়ে—আত্মত্যাগ, আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, এবং মানবতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করার শিক্ষা। ঈদুল ফিতরের পরে এই দ্বিতীয় ঈদটি মুসলমানদের জীবনে শুধু একটি উৎসব নয়, বরং এটি একটি আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা, একটি আত্মবিশ্লেষণের সুযোগ এবং মানবিক দায়িত্ব পালনের প্রতিশ্রুতি।

২০২৫ সালের ঈদুল আজহা এসেছে এমন এক সময়, যখন বিশ্বজুড়ে মুসলমানরা যুদ্ধ, দারিদ্র্য, দুর্যোগ, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও প্রযুক্তির আগ্রাসনের মধ্যেও তাদের বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে উদযাপন করছে ঈদের এই মহোৎসব।

✨ঈদের পেছনের ইতিহাস: আত্মত্যাগের মহাকাব্য

ঈদুল আজহার ঐতিহাসিক ভিত্তি নিহিত রয়েছে ইসলাম ধর্মের অন্যতম প্রধান পুরুষ হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর জীবনে। আল্লাহর নির্দেশে নিজের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু, তাঁর সন্তান ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানি দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে ইব্রাহিম (আ.) যেভাবে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সোপর্দ করেন, তা মানব ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। সেই আত্মত্যাগের নিদর্শন স্বরূপ আজও মুসলমানরা পশু কোরবানি দিয়ে নিজেদের হৃদয়ে ত্যাগ, সংযম ও আত্মার পরিশুদ্ধি ঘটায়।

🕌 ঈদুল আজহা ২০২৫: বিশ্বব্যাপী আয়োজন ও প্রেক্ষাপট

১. বাংলাদেশে ঈদের আবহ

বাংলাদেশে ঈদের চিরাচরিত উচ্ছ্বাস ফিরে এসেছে এই বছর। ঈদের আগে পশুর হাটগুলো ছিল জমজমাট—রাজধানী ঢাকার গাবতলী, চট্টগ্রামের সাগরিকা, রাজশাহী ও খুলনার বড় হাটগুলোতে হাজারো মানুষ কোরবানির পশু কিনতে ভিড় জমায়। গরু, ছাগল, মহিষ, এমনকি উটও দেখা গেছে কিছু কিছু জায়গায়।

তবে এই বছর আলোচনায় ছিল অনলাইন হাট। করোনার অভিজ্ঞতা থেকে শিখে বহু মানুষ এবারে অ্যাপ বা ওয়েবসাইট ব্যবহার করে অনলাইনেই পশু কিনেছেন। বিক্রেতারাও সরবরাহ করেছেন পশু বাড়ি পৌঁছে দিয়ে, কোরবানিও সম্পন্ন করে দেওয়ার প্যাকেজসহ।

২. বিশ্বজুড়ে মুসলিম সমাজের ঈদ

যুক্তরাজ্যে, বিশেষ করে ওয়েলস, ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডে ঈদের নামাজ হয়েছে বড় বড় খোলা মাঠে—মুসলিম কমিউনিটি ঐক্যবদ্ধ হয়ে নামাজ পড়েছে, দোয়া করেছে বিশ্বশান্তির জন্য।
সৌদি আরবের মক্কায় হজ পালন শেষে হাজিরা মিনায় কোরবানি দেন, মাথা মুণ্ডন করেন, এবং ঈদের প্রথম দিনে বিশাল জামাতের মাধ্যমে ঈদুল আজহার সূচনা করেন।

তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, মিসর, মরক্কো—সবখানে ধর্মীয় ভাবগম্ভীরতা ও উৎসবের রঙে রঙিন ছিল ঈদের সকাল।

৩. গাজার কান্না, সুদানের হাহাকার

তবে আনন্দের পাশাপাশি ব্যথার চিত্রও রয়েছে। গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি দখলদারিত্ব ও সহিংসতায় এই ঈদও কেটেছে বোমার শব্দ, ক্ষুধা ও মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।
গতকাল গাজায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪ হাজারেরও বেশি—এই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যেও ঈদের জামাত হয় ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদের পাশে। কোরবানির জন্য পশু তো দূরে থাক, খাবার জোটানোই ছিল কঠিন।

এক গাজাবাসী বলেন:

“আমরা ঈদে নতুন জামা চাই না। চাই শান্তি। চাই যেন আমার সন্তানেরা বেঁচে থাকতে পারে।”

🐄 কোরবানি: প্রতীক নয়, দায়িত্বও

আজকের দিনে পশু কোরবানি নিছক রীতির পালন নয়—এটি এক মহৎ দায়িত্ব। এতে রয়েছে গরিব ও সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের প্রতি ভালোবাসা ও সহমর্মিতার বহিঃপ্রকাশ।
তিন ভাগে ভাগ করে কোরবানির মাংস আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী ও দরিদ্রদের মাঝে বণ্টন করা—এটাই ইসলামের শিক্ষা।

এই বছর অনেক সংগঠন কোরবানি প্রজেক্ট চালু করেছে, যার মাধ্যমে শহর ও গ্রামের দুস্থ মানুষের হাতে কোরবানির মাংস পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। ব্রিটেনে বসবাসকারী অনেক প্রবাসীও পরিবার ও দান সংস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশে কোরবানি দিয়েছেন।

👨‍👩‍👧‍👦 ঈদের সামাজিক দিক

ঈদ মানে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো, পুরোনো সম্পর্কের বন্ধন জোড়া লাগানো, ভুল ভ্রান্তি ভুলে কোলাকুলি করে নতুনভাবে সম্পর্ক শুরু করা।

বাড়ি ফিরে দেখা হলো মা-বাবার সঙ্গে, ভাই-বোনের সঙ্গে। অনেকেই দোতলায় রান্নাঘরের ব্যস্ততায় ছিলেন, কেউ ছিল গরুর রশি ধরায়, কেউ আলু-পোলাও বানানোর প্রস্তুতিতে। আর ছোটরা তো আনন্দে আত্মহারা!

📱 ডিজিটাল ঈদ: রিলস, ভিডিও আর সেলফির যুগে ঈদ

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই বছর ঈদের vibe একেবারে অন্যরকম। TikTok, Facebook, Instagram, Snapchat—সবখানে ট্রেন্ড করছিল #EidVibes #EidOOTD #Kurbani2025।

বিশেষ করে তরুণ-তরুণীরা ঈদের পোশাক, মেহেদি ডিজাইন, কোরবানির পশুর নাম রাখা (যেমন “কালো মানিক”, “টাইটান”, “গোল্ডি”) ইত্যাদি নিয়ে প্রচুর কনটেন্ট তৈরি করেছে।

তবে এই প্রযুক্তি ব্যবহার যেমন আনন্দ বাড়িয়েছে, তেমনি অনেকেই ঈদের গুরুত্ব ও আত্মত্যাগের চেতনার জায়গায় সতর্কতা না রাখায় সমালোচিতও হয়েছে।

🎈উপসংহার: ঈদের শিক্ষা সারাবছরের পাথেয়

ঈদ মানে আনন্দ, কিন্তু সেই আনন্দ যেন হয় ভারসাম্যপূর্ণ। ঈদ মানে খুশি, কিন্তু সে খুশি যেন হয় সবার মাঝে ভাগ করে নেওয়া। ঈদ মানে আত্মত্যাগ, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের প্রিয় জিনিস বিলিয়ে দেওয়ার মানসিকতা তৈরি করা।

এই ঈদ আমাদের শিক্ষা দিক—

• অহংকার নয়, বিনয় শেখার;
• অপচয় নয়, সংযমে চলার;
• শুধু আত্মীয় নয়, অপরকেও ভালোবাসার;
• ধর্ম মানেই দায়িত্ব—মানবতার প্রতি।

✍️ লেখকের পক্ষ থেকে ঈদের শুভেচ্ছা

সবার জন্য রইল আমার পক্ষ থেকে আন্তরিক ঈদ মোবারক।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে ঈদের মূল শিক্ষা—আনুগত্য, ত্যাগ ও মানবতা—অনুশীলনে ধারণ করার তাওফিক দান করুন।
ঈদ মোবারক!

🔹 লেখক পরিচিতি:
আনোয়ার মুরাদ
📍৩৩ Oldport Road, Wenvoe, CF5 6AL
📞 07377 551884
📧 samaramurad1216@gmail.com