নিজস্ব প্রতিবেদক:
প্রতিবছর কোরবানির পশুর দাম বাড়ছে, অথচ কমছে গরু ও মহিষের কোরবানির সংখ্যা। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, গত ছয় বছরে গরু-মহিষ কোরবানি গড়ে কমেছে প্রায় ১৪ শতাংশ। বাজারে সরবরাহ ‘উদ্বৃত্ত’ দাবি করা হলেও দামে এর প্রভাব পড়ছে না। এর পেছনে রয়েছে আয়বৈষম্য, মূল্যস্ফীতি, এবং পরিসংখ্যানগত অনিয়ম—বলছেন বিশ্লেষকরা।
কোরবানি কমছে, কেন?
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী,
২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে গড়ে কোরবানি হয় প্রায় ৫৪ লাখ গরু-মহিষ।
২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে গড়ে তা কমে দাঁড়ায় ৪৭ লাখ ৩৩ হাজারে।
অর্থাৎ গরু-মহিষ কোরবানির হার কমেছে ১৪ শতাংশের বেশি। মহিষের কোরবানি খুবই সীমিত—প্রতি বছর প্রায় ৫০ হাজার।
সার্বিকভাবে কোরবানি পশুর সংখ্যাও হ্রাস পেয়েছে।
২০১৮-২০২০ সালে গড়ে ১ কোটি ২ লাখ ১১ হাজার প্রাণি কোরবানি হয়।
২০২২-২০২৪ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১ কোটি ১ লাখ ৩৫ হাজারে।
অথচ এই সময়েই দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বেড়েছে। তারপরও কেন কমছে কোরবানি?
দাম বাড়ছে, আয় না
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলছেন, “মূল্যস্ফীতির চাপ এবং গরুর বাড়তি দামে কোরবানি অনেকের সামর্থ্যের বাইরে চলে গেছে। মধ্য ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।”
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, আগে যারা একটি গরু কোরবানি দিতেন, এখন তারা ভাগে কোরবানি দেন বা গরুর বদলে ছাগল বেছে নেন। কারণ ছাগল তুলনামূলক সাশ্রয়ী।
বাজারে সরবরাহ ‘উদ্বৃত্ত’, তবু দাম চড়া
প্রতি বছর প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বলছে, চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি পশু প্রস্তুত রয়েছে।
২০২৩ সালে তারা জানায়, ২১ লাখ পশু উদ্বৃত্ত।
২০২৪ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ২৩ লাখ।
চলতি বছরও ২১ লাখ পশু উদ্বৃত্ত বলে জানানো হয়েছে।
তবে বাজারের বাস্তব চিত্র ভিন্ন। সরবরাহ বাড়লে দাম কমার কথা থাকলেও গরুর মাংস ও কোরবানিযোগ্য পশুর দাম বেড়েই চলেছে।
গরুর মাংসের গড় দাম বাড়ছেই
- ২০১৮ সালে গরুর মাংসের গড় খুচরা মূল্য ছিল প্রতি কেজি ৪৩০ টাকা।
- ২০২3 সালে তা দাঁড়ায় ৭২৪ টাকা।
- ২০২৫ সালে ঢাকার বাজারে কেজিপ্রতি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০–৮০০ টাকায়।
কোরবানির জন্য প্রস্তুত গরুতে খরচ আরও বেশি। ঢাকার গাবতলীর বাজারে মাত্র ২ মণের মতো ছোট গরুর দাম ৮০ হাজার টাকার আশপাশে। এতে মাংসের কেজি পড়ছে প্রায় ১,০০০ টাকা। ছাগলের দামও এখন অনেক বেশি।
পরিসংখ্যানে ভুল? স্বার্থের সংঘাত?
অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান বলেন, “সরকারি সংস্থার পরিসংখ্যান অনেক সময় বাস্তবের সঙ্গে মেলে না। যারা উৎপাদনের দায়িত্বে, তারাই যদি উৎপাদনের হিসাব তৈরি করেন, সেটা স্বার্থের সংঘাতের জায়গায় পড়ে।” তাঁর মতে, পরিসংখ্যান তৃতীয় কোনো নিরপেক্ষ সংস্থার মাধ্যমে তৈরি হওয়া উচিত।
গরু আমদানি বন্ধ, বাজারে চাপ
বাংলাদেশে গরুর বাজারে অস্থিরতা শুরু হয় ২০১৪ সাল থেকে, যখন ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় এসে গরু রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। নিষেধাজ্ঞার আগে প্রতি বছর ঈদে ২০–২২ লাখ গরু অবৈধ বা বৈধ পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করত। এখন সেই পথ বন্ধ। ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারেই যোগান দিতে হচ্ছে, যা চাহিদার সঙ্গে মিলছে না।
উপসংহার
মূল্যস্ফীতি, গরুর দাম বৃদ্ধি, এবং আমদানি নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশে কোরবানির ধারা স্পষ্টভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। ঈদের ধর্মীয় গুরুত্ব অটুট থাকলেও তা পালন করতে গিয়ে অনেকে আর্থিক চাপে পড়ছেন। এই অবস্থায় প্রয়োজন বাস্তবমুখী বাজার বিশ্লেষণ, স্বচ্ছ পরিসংখ্যান এবং সীমিত আয়ের মানুষদের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা।