শাহজাহান আলী মনন, নীলফামারী জেলা প্রতিনিধি:
দেশের বৃহত্তম সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার ভেতরে আরেকটি ক্যারেজ কারখানা নির্মাণ প্রকল্প ৯ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি। দৃশ্যত সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখার মধ্যে কার্যক্রম সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। ভারত সরকারের অর্থায়নে এ কারখানা নির্মাণ করার কথা ছিল। কিন্তু ভারত আশ্বাস দিয়েও প্রতারণামুলকভাবে মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। আদৌ বাস্তবায়ন হবে কিনা তা বলতে পারছে না কেউ। অথচ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে এখানেই ক্যারেজ ও ওয়াগন তৈরি করা সম্ভব। তাহলে আর বগি আমদানি করার প্রয়োজন হবে না। এতে রাষ্ট্রের অর্থের সাশ্রয় হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, ১৮৭০ সালে ১১০ একর জমির ওপর নির্মিত হয় দেশের প্রাচীন ও বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানা। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এ কারখানার ২৭টি উপ-কারখানায় (সপ) শ্রমিকরা কাজ করেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখানে নতুন কোচ তৈরি হতো। কিন্তু ১৯৯৩ সালে রেল সংকোচন নীতির আওতায় ওই কোচ নির্মাণ কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। তখন থেকে কোচের জন্য পুরোপুরি বিদেশ নির্ভর হয়ে পড়ে বাংলাদেশ। ভারত, চীন, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, জার্মানি ও কোরিয়া থেকে শ্রেণিভেদে ৫ থেকে ৮ কোটি টাকা দরে প্রতিটি কোচ আমদানি করে আসছে রেলওয়ে। প্রতিবছর গড়ে ৬০টি কোচ আমদানি করে বাংলাদেশ। ফলে দেশের অনেক বড় আকারের ব্যয় হচ্ছে এই আমদানির পেছনে। অথচ দেশে নির্মাণ করা হলে প্রতিটি কোচে এর অর্ধেক টাকা খরচ হবে।
সূত্রটি আরও জানায়, কোচের আমদানি-নির্ভরতা কমাতে সৈয়দপুরে আরও একটি নতুন কোচ কারখানা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ ব্যাপারে ভারতীয় সরকারের সঙ্গে ২০১৬ সালে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। পরে দুই বছর ধরে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা এলাকায় নতুন ক্যারেজ কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কশপ নির্মাণে ব্যাপক সমীক্ষা চালায় বাংলাদেশ রেলওয়ে। এর সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন হয় ২০১৮ সালে।

সমীক্ষা অনুযায়ী সৈয়দপুর কারখানার উত্তর পাশে দার্জিলিং গেটসংলগ্ন এলাকায় কোচ তৈরির কারখানা স্থাপনে জায়গা নির্বাচন করা হয়। এজন্য প্রাথমিকভাবে রেলের ২০ একর জমি নেওয়া হয়। ফলে নতুন করে জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হয়নি। ২০১৯ সালের মে মাসে কারখানাটির ধরনের জন্য আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। একই বছর রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোফাজ্জল হোসেন নির্ধারিত এলাকা পরিদর্শন করেন। কারখানার জন্য সরকার প্রাথমিকভাবে ৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। বাকি টাকা ঋণের জন্য ভারতের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। কিন্তু ২০২৩ সালে ভারত সরকার এ প্রকল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ভারত প্রকল্পে ঋণদান করবে না বলে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়ে দেয়। এতে থেমে যায় কাজের অগ্রগতি। যার ফলে হতাশ রেলওয়ে কর্মচারীসহ স্থানীয় বাসিন্দারা। তারা দ্রুত কাজ শুরু করার দাবি জানিয়েছেন।
রেলওয়ে এমপ্লয়িজ লীগের (বিআরইএল) সৈয়দপুর কারখানা শাখার সেক্রেটারি খায়রুল বাশার বলেন, আওয়ামী লীগের উন্নয়নের ফাঁকা বুলির অন্যতম নজির হলো নতুন ক্যারেজ কারখানা নির্মাণ প্রকল্প। সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার কার্যকর উন্নয়ন তথা সংষ্কারের দাবির প্রেক্ষিতে এই মুলা ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। ভারত ও আওয়ামী লীগের যৌথ প্রতারণার শিকার সৈয়দপুরবাসী।
প্রকৃতই যদি রেলওয়ের উন্নয়ন তথা সরকারি অর্থের অপচয় রোধ করতে হয় তাহলে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন না করেও শুধু কারখানার ক্যারেজ সপটি (উপ-কারখানা) পুরোপুরিভাবে সচল করলেই সম্ভব। কারণ এখানে আগেও ক্যারেজ ও ওয়াগন তৈরি করা হয়েছে। এখনও উদ্যোগ নিলে বিদেশ থেকে বগি আনতে যে খরচ হয় তার অর্ধেক টাকাতেই এখানে তৈরি করা যাবে। সেদিকেই সরকারকে মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়নের কারখানা শাখার সম্পাদক শেখ রোবায়তুর রহমান বলেন, জনবল সংকটে দেশের বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানা ধুঁকে ধুঁকে চলছে। রেলওয়ে কোচ তৈরির নতুন কারখানাটি স্থাপনের জন্য জায়গা নির্ধারণ করে সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে প্রায় ৯ বছর আগে। কারখানা স্থাপনের খবরে রেল কর্মচারীদের মনে আশার সঞ্চার হয়েছিল। তারা ভেবেছিল তাদের ছেলেমেয়েসহ এখানে অনেকের কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু দীর্ঘ দিনেও কাজ শুরু না হওয়ায় আমরা হতাশ।
নীলফামারী চেম্বার অব কমার্সের সদস্য সিদ্দিকুল আলম সিদ্দিক বলেন, সৈয়দপুর একটি বাণিজ্যিক শহর। নতুন কোচ তৈরির কারখানাটি স্থাপন করা হলে এ অঞ্চলে ব্যবসার ব্যাপক প্রসার ঘটবে। আর সংশ্লিষ্ট রেল কর্মকর্তারা বলছেন, যে টাকায় কোচ আমদানি করা হয় তার অর্ধেক টাকাতেই এখানেই কোচ নির্মাণ করা সম্ভব।
সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার ক্যারেজ শপের ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী মমিনুল ইসলাম জানান, নতুন এ ক্যারেজ কারখানাটি চালু হলে এখানে প্রতিমাসে ৫টি করে বগি নির্মাণ করা সম্ভব হবে। আর প্রতিটি বগিতে খরচ পড়বে দুই থেকে তিন কোটি টাকা। অথচ সেখানে ৫ থেকে ৮ কোটি টাকা দরে প্রতিটি কোচ আমদানি করে আসছে রেলওয়ে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক (ডিএস) শাহ সুফী নুর মোহাম্মদ বলেন, ২০২২ সালে অক্টোবর মাসের ১০ তারিখে প্রকল্পটির ভৌত কাঠামোর সমীক্ষা প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ের প্ল্যানিং কমিশনে (পিএলসি) পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে। এরপর এ প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে তার জানা নেই। তবে কাররখানাটি স্থাপন হলে এখানে নতুন বগি নির্মাণ করা সম্ভব। তখন আর বগি আমদানি করার প্রয়োজন হবে না। এতে রাষ্ট্রের অর্থের সাশ্রয় হবে বলে জানান তিনি।