জুলাই সংঘটিত গণ–অভ্যুত্থান এবং ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে রক্তাক্ত অভিযানের ঘটনায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ড, নিখোঁজ, নির্যাতন ও গণহত্যার অভিযোগে দায়ের করা একাধিক মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
এই মামলাগুলোর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনপীড়নের গুরুতর অভিযোগ। আজ সোমবার এসব মামলায় ১৩ জন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়, যাদের মধ্যে রয়েছেন প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের সাবেক কর্মকর্তা, রাজনীতিক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন:
প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনের শীর্ষ নাম:
- মো. আতিকুল ইসলাম – ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) সাবেক মেয়র
- শামসুল হক টুকু – সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী
- এ কে এম শহীদুল হক – সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি)
- মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসান – সাবেক র্যাব কর্মকর্তা ও সামরিক কর্মকর্তা
সাবেক পুলিশ ও নিরাপত্তা কর্মকর্তারা:
- মোল্যা নজরুল ইসলাম – পুলিশের সাবেক ডিআইজি
- জাবেদ ইকবাল – ডিবি পুলিশের সাবেক সহকারী কমিশনার
- মো. মুজিবুর রহমান – উত্তরা পূর্ব থানার সাবেক ওসি
- কনস্টেবল হোসেন আলী – পুলিশের সদস্য হিসেবে অভিযুক্ত
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ:
- মো. শাহিনুর মিয়া – উত্তরা পূর্ব থানা আওয়ামী লীগের শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক
- মনোয়ার ইসলাম চৌধুরী – উত্তরা পশ্চিম থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি
- আবদুল্লাহ আল মামুন – গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক
- মো. বশির উদ্দিন – উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টর আওয়ামী লীগের সভাপতি
- দেলোয়ার হোসেন – ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের ১ নম্বর ওয়ার্ড সভাপতি
মামলার প্রেক্ষাপট:
২০১৩ সালের মে মাসে হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বে হাজার হাজার মানুষের সমাগমে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে শাপলা চত্বর। সরকার দাবি করে সেদিন অভিযান ছিল “অপেশাদার” দাঙ্গাকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে, কিন্তু বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা একে ‘রাতের আঁধারে পরিচালিত গণহত্যা’ হিসেবে আখ্যা দেয়। ঠিক তেমনি, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সরকারবিরোধী আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে অনেক আন্দোলনকারী প্রাণ হারান বলেও অভিযোগ রয়েছে।
আজকের শুনানিকে কেন্দ্র করে আদালত চত্বরে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বিচারক প্যানেল মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণ ও প্রাথমিক দলিল পর্যালোচনা করছেন বলে জানা গেছে।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া:
এই মামলার শুনানি শুরু হওয়ায় রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনার ঝড় উঠেছে। মানবাধিকারকর্মী ও ভুক্তভোগীরা এই পদক্ষেপকে ‘বহু প্রতীক্ষিত ন্যায়বিচারের প্রাথমিক ধাপ’ হিসেবে দেখলেও, ক্ষমতাসীন দলের নেতারা একে ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা’ বলেও উল্লেখ করছেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো এমন উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে একযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধের অভিযোগে বিচারিক কার্যক্রম শুরু হলো, যা ভবিষ্যতের রাজনীতি ও বিচার ব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।