ইউরোপের অন্যতম সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার ইতালি। কিন্তু ভাষা ও কারিগরি জ্ঞানের অভাবে এই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশি কর্মীরা। ২০২৩ সালে বৈধভাবে ইতালিতে গেছেন ১৬ হাজার ৮৭৯ জন, যেখানে ২০২৪ সালে এই সংখ্যা কমে মাত্র ১ হাজার ১৬৪ জনে দাঁড়িয়েছে। এ বছর প্রথম চার মাসে গেছেন ১ হাজার ২৪৬ জন। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আবারও বাংলাদেশিদের মধ্যে অবৈধ পথে ইউরোপে প্রবেশের ঝুঁকি বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ইতালির শ্রমবাজারে প্রবেশে আগ্রহ থাকলেও ভাষাগত দুর্বলতা, দক্ষতার ঘাটতি ও ভুয়া নিয়োগপত্রের অভিযোগের কারণে অনেকেই ভিসা পান না। ফলে ইতালি সরকার ভিসা দেওয়ার প্রক্রিয়ায় কড়াকড়ি আরোপ করেছে। ঢাকায় ইতালি দূতাবাস নিয়োগপত্র যাচাই করতে দীর্ঘ সময় নিচ্ছে, কখনো কখনো এক বছরের বেশি সময় অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে আবেদনকারীদের। অনেকের পাসপোর্ট ফেরত দেওয়া হলেও ভিসা পাওয়া অনিশ্চিত থাকছে।
বরিশালের শাহজাদা (ছদ্মনাম) ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিয়োগপত্র পাওয়ার পর জুলাইয়ে পাসপোর্ট জমা দেন দূতাবাসে। ছয় মাস পর ডিসেম্বরে ভিসা ছাড়াই ফেরত পান পাসপোর্ট। এরপর থেকেই তিনি অপেক্ষা করছেন দূতাবাসের ইমেইলের।
বাংলাদেশ ও ইতালির মধ্যে ২০২০ সালে একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার ফলে ২০২১ সালে মাত্র ৬৫৩ জন কর্মী ইতালি যান। এরপর ২০২২ সালে ৭ হাজার ৫৯৪ জন এবং ২০২৩ সালে গিয়ে পৌঁছায় ১৬ হাজার ৮৮০ জনে। কিন্তু ২০২৪ সালে তা আবার দ্রুত কমে আসে। এর কারণ হিসেবে অনেকে বলছেন, ইতালিতে যাওয়া ৮০ শতাংশ কর্মী বৈধতা পান না, কারণ তাঁরা ভাষা ও দক্ষতা ছাড়াই বিদেশে যান।
ইতালিতে বাংলাদেশি অভিবাসীদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা সংগঠন ‘ইতালবাংলা সমন্বয় ও উন্নয়ন সমিতি’ জানায়, আশির দশক থেকেই বাংলাদেশিরা ইতালিতে পাড়ি দেওয়া শুরু করেন। ২০০৩ সালে বিদেশি শ্রমিক নিয়োগ কোটায় বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু ২০১২ সালে বাংলাদেশি কোটা বাতিল করে দেশটি। এরপর দীর্ঘদিন কর্মী পাঠানো বন্ধ ছিল।
নতুন করে ২০২৪ সালের ৬ মে বাংলাদেশ ও ইতালির মধ্যে ‘মাইগ্রেশন ও মোবিলিটি’ বিষয়ক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এতে সিজনাল ও নন-সিজনাল দুই ধরনের কর্মী নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ইতালি। একটি যৌথ কারিগরি কমিটি গঠন এবং ভাষা প্রশিক্ষণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু চুক্তি করলেই হবে না, বাস্তবায়নের জন্য দক্ষতা ও ভাষা শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। ইতালি মূলত নিজস্ব ভাষাভিত্তিক কর্মসংস্থান নির্ভর দেশ। যারা ইতালির ভাষা শিখে যান, তারা সহজে ভিসা পাচ্ছেন এবং বৈধভাবে কাজ করতে পারছেন।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ শাহ মো. তাইফুর রহমান বলেন, “ভাষা ও দক্ষতার অভাবেই ৮০ শতাংশ কর্মী অবৈধ হয়ে পড়ছেন। সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে যেন ইউরোপে গিয়ে কেউ অবৈধ না হন। প্রশিক্ষণ ছাড়া কাউকে পাঠানো যাবে না।”
বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে শুরু হওয়া ‘ট্যালেন্ট পার্টনারশিপ’ প্রকল্পের মাধ্যমে বৈধ ও দক্ষ অভিবাসন প্রক্রিয়া চালু রাখা হয়েছে। এর আওতায় আগামী তিন বছরে ইউরোপের বাজারে দক্ষ কর্মী পাঠাতে কাজ করবে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO), বিএমইটি এবং প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকার যদি পরিকল্পিতভাবে ভাষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মী তৈরি করে, তাহলে শুধু ইতালি নয়—ইউরোপের অন্যান্য দেশেও বাংলাদেশিদের জন্য বৈধ অভিবাসনের দরজা খুলে যাবে। অন্যথায়, ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্রপথে আবারও বিপজ্জনক অভিবাসনের প্রবণতা বাড়বে, যা মানবিক সংকটের আশঙ্কা তৈরি করতে পারে।