সদরপুর উপজেলা (ফরিদপুর) প্রতিনিধি:
ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলা ভুবনেশ্বর নদের তীড়ে অবস্থিত। এক সময় ভুবনেশ্বর নদে বড় বড় পালতোলা পন্যবাহী নৌকা চলতো, লঞ্চ আসতো ঢাকা সদরঘাট থেকে।পদ্মা নদীর বৃহৎ শাখা ছিল নদটি। নৌকা বাইচ হতো, যা ছিল নদী কেন্দ্রীক সংস্কৃতির অংশ। জেলেরা ইলিশ মাছ ধরতো বর্ষা মৌসুমে৷ দেশি প্রজাতির মাছের অভয়াশ্রম ছিল ভুবনেশ্বরে। জীব বৈচিত্র রক্ষায় নদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। বর্ষাকালে ভুবনেশ্বর নদীর দুইপার অথৈ পানিতে ভরপুর থাকতো।
সদরপুর উপজেলার আকটেরচর ইউনিয়ন এলাকায় প্রবাহমান পদ্মার শাখা হতে উৎপত্তি।ইতিহাস থেকে জানা যায়,মুঘল আমল ও ব্রীটিশ আমলে ফরিদপুর অঞ্চলে কৃষি পন্য এই নদের পথেই পরিবহনের প্রধান মাধ্যম ছিল। ভুবনেশ্বর নদটি বিভিন্ন এলাকা একে বেকে গিয়ে নগরকান্দা উপজেলার কাইচাইল ইউনিয়নে কুমার নদের সাথে গিয়ে মিলিত হয়েছে৷ এর দৈর্ঘ ২৭ কিঃমিঃ প্রস্থ্য ৪০ মিটার পর্যন্ত। আকৃতিতে অনেকটা সর্পৃল আকৃতির।
পদ্মার গতিপথ পরিবর্তন ও ভূমি ক্ষয়ের কারনে কালের বিবর্তনে পলি ও বালু মাটির স্তর বাড়তে থাকায় নদটি শুকিয়ে যায়। ড্রেজিং ব্যবস্থ্যা না থাকায়, ভুবনেশ্বর নদটির দুই পার আকারে ছোট হয়ে আসে। এরপর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ভাবে স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখল করে নেয়। বর্তমানে দখল,দুষন, বেদখল আর দেখভালের অভাবে ভুবনেশ্বর নদটি এখন মরা খালে পরিনত হয়েছে৷
একসময় এই ভুবনেশ্বর নদকে কেন্দ্র করেই উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ব্যাবসা বানিজ্যের প্রসার ঘটেছিল। সদরপুর বাজার ভুবনেশ্বর নদকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে।দূর দুরান্ত থেকে মানুষ সদর কাচারীতে নৌকায় চড়ে খাজনা দিতে আসতো। পালতোলা নৌকা নিয়ে দূর দুরান্ত থেকে লোকজন মালামাল নিয়ে আসতো। একসময় নদী পথে পন্য পরিবহনের একমাত্র মাধ্যম ছিল ভুবনেশ্বর নদ।
ভুবনেশ্বর নদের কয়েকটি বৃহৎ সংযোগ খাল ছিল। আজ সেসব ও বিভিন্ন জনের দখলে চলে গেছে। ভুবনেশ্বর নদের যে সংযোগ খালটি সদরপুর সুইচচগেটের নীচ দিয়ে প্রবাহিত ছিল গত কয়েকবছর আগে কৃষ্ণপুর মোড়ের স্থলে প্রভাবশালীরা মাটি দিয়ে ভরাট করে খালটির পানি প্রবাহ বন্ধ করে দেয় এবং সেখানে স্থানীয় একটি মহল দোকান ভাড়া ও সি,এন,জি স্টান্ড বসিয়েছে। অথচ এই খাল কে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল উপজেলার অন্যতম ব্যবসা কেন্দ্র সাড়েসাত রশি বাজার,হাট কৃষ্ণপুর বাজার,সহ বেশকিছু ছোট বড় ব্যাবসা কেন্দ্র।
আজ ভুবনেশ্বর নদ তার রুপ যৌবন সব হারিয়ে মরা খালে পরিনত হয়েছে। আয়তনে ও প্রস্থে এখন এটি একটি মরা খালের মত। পানির প্রবাহ নেই, সংযোগ খাল গুলো বন্ধ, কিছু কিছু জায়গায় বালুর চর পরে দখলে ফসলি জমি হয়ে গেছে স্থানীয়দের। নদের দুই পাড়ের বেশির ভাগ জায়গাই স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে ৷ দুই পাড়েই বিভিন্ন বসতি, বাড়িঘর তৈরী হয়েছে, ভুবনেশ্বর নদে পানি প্রবাহ না থাকায় সংযোগ খাল গুলো পানির অভাবে শুকিয়ে স্থানীয়দের দখলে চলে গেছে।
ভুবনেশ্বর পাড়ের বাসিন্দা আমিরাবাদ গ্রামের পান্নু মৃধা বলেন, আমরা ছোটবেলায় নৌকায় উপজেলা সদরের সাথে যোগাযোগ করতাম, এই নদের পথেই নৌকা দিয়ে জেলা শহর ফরিদপুর পর্যন্ত যাতায়ত ছিল। বর্ষা মৌসুমে ইলিশ মাছের পাশাপাশি প্রচুর দেশীয় মাছের অভয়াশ্রম ছিল এটি। এখন পানির অভাবে আর দেশীয় মাছ পাওয়া যায়না। নদটি খনন করে পানির প্রবাহ বাড়ালে আবার দেশীয় প্রজাতির মাছের অভয়াশ্রম হতো এটি। এখন যেখানে জাকের মঞ্জিল স্কুল তার পিছনে সারা বছর নৌকা ঘাট থাকতো। ছইওয়ালা একমালাই নৌকা বলতো তাকে৷ আজ সব অতীত হয়ে গেছে৷
ভুবনেশ্বর নদের পাড়েই ভাষানচর ইউনিয়ন পরিষদ কার্য্যালয়। ইউ পি চেয়ারম্যান শেখ কাউসার রহমান জানান, আমি ইতিপুর্বে ফরিদপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদারের কাছে নদটি খনন করে পানি প্রবাহের অনুরোধ করেছিলাম সেই সাথে ইউনিয়ন পরিষদের সাথে একটি পাকা ঘাটলা তৈরীর অনুরোধ করেছিলাম যাতে মানুষ গোসল করতে পারে এবং নদের পাড়ের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি পায়, কিন্ত জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান বদলি হয়ে যাওয়ার পর সে কাজ আর আলোর মুখ দেখে নাই। এখন পানি উন্নয়ন বোর্ড সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট্য দপ্তরের কর্মকর্তাদের উচিত ভুবনেশ্বর নদটি সীমানা নির্ধারন করে দক্ষলমুক্ত করা, সেই সাথে নদটি খনন করে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি করা৷
এই ব্যাপারে ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী সামছুল হাসান আমার দেশ প্রতিনিধিকে জানান,ভুবনেশ্বর নদ এখন মৃত্য।এটা আর ড্রেজিং করার অবস্থায় নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই নদের খনন কাজে কোন উন্নয়ন বাজেট নেই। পদ্মা নদীর গতি পরিবর্তনের ফলেই ভুবনেশ্বর নদের মৃত হয়েছে ৷
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাকিয়া সুলতানা বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড যদি ভুবনেশ্বর নদ খনন কাজে কোন প্রকল্প হাতে নেয় তবে উপজেলা প্রশাসন উক্ত নদটি খনন কাজে সর্বাত্মক সহযোগীতা করবে। নদটি খনন করলে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি করে জীব বৈচিত্র রক্ষার পাশাপাশি দেশীয় প্রজাতির মাছের অভয়াশ্রম করা যেত।