ভারত যুক্তরাষ্ট্রসহ বৈশ্বিক শক্তিগুলোর পরামর্শ মেনে চলবে কি না, এবং পাকিস্তানের সেনাপ্রধানের ভাষ্য অনুযায়ী “দ্রুত, সুসংগঠিত এবং উচ্চমাত্রার” প্রতিক্রিয়ার হুঁশিয়ারিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবে—তা এখনও পরিষ্কার নয়। ফলে, দুই পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশী দেশের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমনের জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা চললেও, সামরিক সংঘর্ষের সম্ভাবনা পুরোপুরি নাকচ করা যাচ্ছে না।
পাকিস্তানের অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারকদের জন্য এ পরিস্থিতি একটি নতুন এবং অত্যন্ত জটিল চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। যদি ভারত পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত পানির প্রবাহ ব্যাহত করার পদক্ষেপ নেয়, তাহলে এমনিতেই পানির ঘাটতিতে থাকা দেশের অর্থনীতি আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। একই সঙ্গে এটি আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকেও বাধাগ্রস্ত করবে, যার লক্ষ্য হলো ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত এড়ানো।
২০২৫ সাল এখন পর্যন্ত বহু দিক থেকেই চ্যালেঞ্জে ভরা একটি বছর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এর মধ্যে পানি সমস্যা সর্বোচ্চ জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে উঠে এসেছে। সৌভাগ্যক্রমে, পানিবণ্টন নিয়ে সিন্ধুকে বঞ্চিত করার সম্ভাবনার ব্যাপারে সাধারণ আশঙ্কা আপাতত প্রশমিত করেছে কাউন্সিল অব কমন ইন্টারেস্টস (CCI)।
তবে, এ বছর প্রাক্কলিত ৩৭ শতাংশ পানির ঘাটতির মোকাবিলায় পাকিস্তান কী পদক্ষেপ নেবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। এই ঘাটতির প্রভাব শুধু কৃষিতে সীমাবদ্ধ থাকবে না; এর প্রভাব পড়বে দেশের সমগ্র অর্থনীতিতে।
এছাড়া দ্বিতীয় বৃহৎ চ্যালেঞ্জ হচ্ছে শিল্প উৎপাদনের পুনর্জাগরণ। অর্থবছরের প্রথম আট মাসে লার্জ-স্কেল ম্যানুফ্যাকচারিং (LSM) খাত সংকুচিত হয়েছে, যার পেছনে রয়েছে জ্বালানির উচ্চমূল্য, সুদের হার, দুর্বল শাসনব্যবস্থা, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং গঠনগত সমস্যা—বিশেষ করে দেশের প্রধান রপ্তানিমুখী খাত টেক্সটাইল শিল্পে।
আজ (১ মে) অনুষ্ঠিতব্য মুদ্রানীতি বৈঠকে স্টেট ব্যাংক সুদের হার কমাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে শিল্পখাতের যে গভীর মন্দা চলছে, তাতে এই ধরনের সীমিত হ্রাস শিল্প উৎপাদনে তাৎক্ষণিক কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনবে বলে মনে হচ্ছে না।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে LSM খাতে উৎপাদন ১.৯ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। পুরো বছরের হিসাবে মাত্র ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনও সম্ভব নয় বলেই ধারণা করা হচ্ছে। পাশাপাশি বাজেট ঘাটতিও ব্যাপকভাবে সীমাবদ্ধ। যদি ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়, তাহলে শিল্প পুনরুদ্ধারের জন্য আর্থিক সহায়তা দেয়ার কোন সক্ষমতাই সরকারের হাতে থাকবে না।
স্টেট ব্যাংকের অর্ধ-বার্ষিক প্রতিবেদনে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে—জিডিপির তুলনায় রপ্তানি কমে যাওয়ায়, প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের অকার্যকরতা, বিশ্বমানের সরবরাহ চেইনে শিল্প খাতের দুর্বল সংযুক্তি, এবং শ্রম দক্ষতার অভাবের বিষয়ে। মাইক্রোইকোনমিক স্তরে এর প্রকাশ দেখা যাচ্ছে—পণ্যের মান নিম্নমানের, উৎপাদন খরচ বেশি, এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার উপযুক্ত ব্র্যান্ড গঠনে ব্যর্থতা।
এমন পরিস্থিতিতে শিল্প উৎপাদনে সামান্য উত্তরণ হলেও, তা রপ্তানি বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে বৈদেশিক লেনদেনে কিছুটা লাভ হলেও, তা আগামী অর্থবছরে ধরে রাখা সম্ভব নয়—এমনকি ভারতের তরফ থেকে কোন আগ্রাসী পদক্ষেপ না এলেও।
এই সংকট নিরসনে সরকার এবং বেসরকারি খাতের মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ অপরিহার্য। দ্রুত শিল্প পুনরুজ্জীবন ও রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য কার্যকর কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। একই সঙ্গে পানিবণ্টন নিয়ে আন্তঃপ্রাদেশিক সমঝোতার জন্য কেন্দ্র ও প্রাদেশিক সরকারগুলোর মধ্যে ন্যায্যতার ভিত্তিতে আলোচনা প্রয়োজন। CCI’র মাধ্যমে একটি স্থায়ী সমাধানের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
সময় এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পানিসংক্রান্ত বিরোধ দ্রুত ও ন্যায্যভাবে নিষ্পত্তি করতে পারলে রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল হবে। আর রপ্তানি বৃদ্ধি করতে পারলে বৈদেশিক সহায়তার উপর নির্ভরতা কমবে—যা বর্তমান দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় অত্যন্ত জরুরি।
এই দুই খাতে অগ্রগতি অর্জিত হলে কৃষি ও শিল্প খাতে কিছুটা হলেও টেকসই প্রবৃদ্ধি আসতে পারে। এটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে, এবং জাতীয় নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ—কারণ সামাজিক বঞ্চনা থেকে উগ্রবাদ মাথাচাড়া দেয়ার আশঙ্কা থাকে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) তার সাত বিলিয়ন ডলারের প্রোগ্রামের দ্বিতীয় কিস্তা হিসেবে এক বিলিয়ন ডলার ছাড় করতে যাচ্ছে এবং এর সঙ্গে অতিরিক্ত ১.৩ বিলিয়ন ডলার জলবায়ু সহায়তা দেবে। উভয় অর্থ ছাড়ের জন্য পাকিস্তান মূল শর্তগুলো পূরণ করেছে।
এই মোট ২.৩ বিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তা দ্রুত ছাড় হলে তা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে এবং বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা দেবে। আর এই অস্থির ভূরাজনৈতিক সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শুধু অর্থনৈতিক প্রয়োজন নয়—এটি একটি কৌশলগত অপরিহার্যতা।