বাংলাদেশের রাজনীতিতে ২০২৫ সালে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলি ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ মোড় রচনা করতে যাচ্ছে। বহুল আলোচিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে ক্ষমতা পরিবর্তন এবং তার ধারাবাহিকতায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত গমন এবং সেখানে অবস্থান বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আল জাজিরাকে দেয়া সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে উন্মোচিত কিছু তথ্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা, কূটনৈতিক সমীকরণ এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে।
ড. ইউনূস বলেন,
“আমি মোদিকে বলেছিলাম—ঠিক আছে, আপনি যদি হাসিনাকে আশ্রয় দিতে চান, সেটা আপনার সিদ্ধান্ত। তবে তিনি যেনো কোনো উত্তেজনাকর বক্তব্য না দেন, কারণ তা বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।”
মোদির উত্তর ছিল আরও কূটনৈতিক। তিনি জানান, ভারতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সবার জন্য উন্মুক্ত; সেখানে কোনো ব্যক্তির মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমন করা সম্ভব নয়। এই উত্তরের ভেতরে ভারতের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির দোহাই যেমন আছে, তেমনি শেখ হাসিনার আশ্রয়প্রাপ্তিকে আঞ্চলিক কৌশলগত স্বার্থ রক্ষার অংশ হিসেবেও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
এই সংলাপের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য যে বার্তাগুলো উঠে আসে, তা কয়েকটি স্তরে বিশ্লেষণ করা যায়।
১. শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ছায়া থেকে বাংলাদেশের মুক্তি কি সম্ভব?
শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে শুধু একজন ব্যক্তি নন, বরং একটি প্রতিষ্ঠান, একটি দীর্ঘকালের ক্ষমতার প্রতীক। তার জনপ্রিয়তা, সংগঠিত রাজনৈতিক কাঠামো এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক এখনও বহাল। ভারতে থাকলেও তার সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত বক্তব্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক আবহকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
নতুন সরকার যদি মনে করে থাকে যে শেখ হাসিনাকে সরিয়ে তার প্রভাবও এককাট্টা নির্মূল করা যাবে, তবে তা এক বড় রাজনৈতিক ভুল হবে। কারণ রাজনীতির ময়দানে ‘উপস্থিতি’ শুধু শারীরিক নয়, মনস্তাত্ত্বিক এবং মিডিয়াগতও বটে। হাসিনার বার্তা, তার বক্তব্যের প্রতিধ্বনি, দেশের রাজনীতিতে বিক্ষোভ এবং সমর্থনের নতুন তরঙ্গ সৃষ্টি করতে পারে।
২. ভারতের ভূমিকায় কৌশলী দ্বৈতনীতি
নরেন্দ্র মোদির মন্তব্য থেকে স্পষ্ট — ভারত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিতে ইচ্ছুক, কিন্তু তার কর্মকাণ্ডের দায়ভার গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক। এটি কূটনৈতিক দিক থেকে ভারতের এক চিরাচরিত নীতি: প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ না করে, নিজেদের স্বার্থ রক্ষার কৌশল রক্ষা করা।
ভারত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে একদিকে তার দীর্ঘদিনের ‘বিশ্বস্ত মিত্র’ সম্পর্কের প্রতি সম্মান দেখিয়েছে, অন্যদিকে নিজের রাজনৈতিক ঝুঁকি কমিয়ে আনতে কৌশলী দুরত্ব বজায় রাখছে। মোদির মন্তব্য ‘আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো না’— এই কূটনীতিরই প্রকাশ।
৩. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নতুন যুদ্ধক্ষেত্র
বিশ্ব রাজনীতিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। একেকটি পোস্ট, একেকটি ভিডিও অথবা বক্তব্য মুহূর্তেই লাখ লাখ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে যেতে পারে এবং বাস্তব ময়দানে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
শেখ হাসিনার মতো অভিজ্ঞ ও কৌশলী রাজনীতিক যদি এই প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করে দেশবাসীর মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব বিস্তার করতে চান, তাহলে নতুন সরকারকে শুধু প্রশাসনিক নয়, মনস্তাত্ত্বিকভাবেও লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। বর্তমান বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতা হলো, বড় একটি জনগোষ্ঠী এখনো রাজনৈতিক দিক থেকে আবেগপ্রবণ এবং নেতার প্রতি আনুগত্যপ্রবণ।
৪. বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কতটা ঝুঁকিতে?
যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যদি ক্রমাগত উত্তেজনা, বিক্ষোভ, এবং মেরুকরণ চলতেই থাকে, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থান এবং সেখান থেকে সম্ভাব্য সক্রিয় রাজনৈতিক ভূমিকা নতুন সরকারের জন্য একটি অব্যাহত চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।
বিশ্ব অর্থনীতি ও আঞ্চলিক কূটনৈতিক চাপের মাঝে বাংলাদেশকে একটি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে হলে এখনই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিরোধী কণ্ঠকে শক্তি দিয়ে না উস্কিয়ে, গণতান্ত্রিক স্পেস বাড়ানো, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা, এবং রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনার জন্য উন্মুক্ত মঞ্চ তৈরি করাই হতে পারে উত্তম পথ।
শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয় এবং ড. ইউনূসের মোদির সাথে সংলাপ বাংলাদেশের সামনে এক কঠিন বাস্তবতা উন্মোচন করেছে: নেতৃত্ব পরিবর্তন মানেই সমস্যার অবসান নয়। বরং নতুন নেতৃত্বের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ — কীভাবে একটি বিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা যায় এবং কীভাবে আগামীর বাংলাদেশকে নিরাপদ, গণতান্ত্রিক ও টেকসই ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো যায়।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দূরে ঠেলে দিয়ে নয়, বরং সব পক্ষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে ভবিষ্যতের পথচলা নির্ধারিত হওয়া উচিত। আর তার জন্য চাই বাস্তবতা-নির্ভর কৌশল, কূটনৈতিক প্রজ্ঞা এবং সবথেকে বড় কথা, মানুষের প্রতি গভীর আস্থা।