✍️ বিশেষ বিশ্লেষণ
১. ইতিহাসের পটভূমি: জম্মু-কাশ্মীর সংকটের গোড়ার কথা
ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর থেকেই কাশ্মীর অঞ্চলের মালিকানা নিয়ে উত্তেজনা বিরাজ করছে।
১৯৪৭ সাল থেকে তিনটি বড় যুদ্ধ এবং অসংখ্য সশস্ত্র সংঘর্ষের পরও জম্মু-কাশ্মীর প্রশ্নে সমাধান আসেনি।
১৯৮৯ সালে কাশ্মীরে স্বাধীনতা আন্দোলন এবং সশস্ত্র বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটে। এরপর ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এবং পাকিস্তানের মদতপুষ্ট সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড—উভয় দিক থেকেই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষ করে ২০১৯ সালে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা (Article 370) বাতিল করার পর অঞ্চলটির রাজনৈতিক পরিবেশ আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
২. পুলওয়ামা হামলা: প্রশ্নের ঝড় তুলেছিল যে ঘটনা
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামায় একটি বিস্ফোরকভর্তি গাড়ি আঘাত হানে আধা-সামরিক বাহিনীর কনভয়ের উপর। প্রাণ হারান ৪০ জনের বেশি সিআরপিএফ সদস্য।
সরকার পাকিস্তান-ভিত্তিক জইশ-ই-মোহাম্মদ সংগঠনের ওপর দায় চাপিয়ে কূটনৈতিক এবং সামরিক প্রতিক্রিয়া দেখায়, যার মধ্যে ছিল পাকিস্তানে বিমান হামলা (বালাকোট এয়ার স্ট্রাইক)।
কিন্তু ঘটনার পরে বেরিয়ে আসে কয়েকটি অস্বস্তিকর তথ্য:
- হামলার পূর্বাভাস থাকা সত্ত্বেও কেন কনভয়ের বিমান সহায়তা মঞ্জুর করা হয়নি?
- কেন এত বড় কনভয়কে এত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় সুরক্ষা ছাড়া পাঠানো হয়েছিল?
- সত্য পাল মালিকের বক্তব্য কি শুধুই হতাশার বহিঃপ্রকাশ, নাকি ইঙ্গিত কোনও গভীর ষড়যন্ত্রের দিকে?
এটি অনেকের মনে সন্দেহ জাগায় যে পুলওয়ামার ঘটনা কি ইচ্ছাকৃত অবহেলার মাধ্যমে রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের হাতিয়ার ছিল?
৩. পেহেলগাম হামলা: একই চিত্রের পুনরাবৃত্তি?
২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন পর্যটক নিহত হন।
➡️ সরকার আবারও পাকিস্তানকে দায়ী করে।
➡️ সাথে সাথে সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করে উত্তেজনা বাড়িয়ে তোলে।
কিন্তু এবার সাড়া জাগায় আসাম রাজ্যের বিধায়ক আমিনুল ইসলামের মন্তব্য। তিনি অভিযোগ করেন:
“পেহেলগাম হামলার পেছনে মোদি সরকারের ষড়যন্ত্র রয়েছে, এটি জনমত প্রভাবিত করার একটি প্রচেষ্টা।”
এই বক্তব্যের জন্য তাকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার করা হয়, যা রাজনৈতিক মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর বড় প্রশ্ন তুলে দেয়।
৪. আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও উদ্বেগ
❖ আমেরিকা:
- যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি কোনো পক্ষ নেয়নি, তবে উভয় দেশকেই “সংযম” দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে।
- সিন্ধু পানি চুক্তির স্থগিতাদেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, কারণ এটি দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
❖ চীন:
- পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে চীন ভারতকে “বিভেদ না বাড়িয়ে আলোচনায় ফিরে আসার” আহ্বান জানিয়েছে।
- চীন কাশ্মীর ইস্যুতে বরাবরই পাকিস্তানের পাশে থেকেছে।
❖ জাতিসংঘ:
- পানির মতো মৌলিক সম্পদকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার না করার আহ্বান জানিয়েছে।
- কাশ্মীরের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
❖ পাকিস্তান:
- সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করাকে “যুদ্ধের ঘোষণা” বলে উল্লেখ করেছে।
- আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে অভিযোগ করেছে যে ভারত ইচ্ছাকৃতভাবে উত্তেজনা বাড়াচ্ছে।
৫. বিশ্লেষণ: কাদের লাভ হচ্ছে এই অস্থিরতা থেকে?
পেহেলগাম বা পুলওয়ামা হামলা পরবর্তী রাজনৈতিক চিত্র বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়:
- জাতীয়তাবাদী আবেগের উত্থান
- সরকারের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি
- বিরোধী কণ্ঠস্বর দমন করা সহজতর
- সমালোচনা থেকে মনোযোগ সরিয়ে আনা
এখানে প্রশ্ন উঠে—
▶️ হামলা প্রতিরোধে ব্যর্থতা ইচ্ছাকৃত নাকি গাফিলতি?
▶️ নির্বাচনের আগে কেন বারবার এই ধরনের বড় হামলা হয়?
▶️ কীভাবে নিরাপত্তা ব্যর্থতাকে রাজনৈতিক পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে?
৬. উপসংহার ও সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ বিশ্লেষণ
কাশ্মীর ইস্যু শুধু সীমান্ত বা সন্ত্রাসের প্রশ্ন নয়—এটি এখন ক্ষমতার রাজনীতির প্রধান হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
যদি সরকার প্রকৃতপক্ষে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারে, কিংবা হামলার মাধ্যমে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চায়, তাহলে সেটা গণতন্ত্রের চরম অবক্ষয়।
👉 একমাত্র স্বচ্ছ তদন্ত, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং জনগণের চাপের মাধ্যমেই প্রকৃত সত্য উন্মোচিত হতে পারে।
👉 যুদ্ধোন্মাদনা নয়, বরং শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান করা ছাড়া বিকল্প নেই।
ভবিষ্যতে যদি এ ধরনের রাজনৈতিক মেরুকরণ অব্যাহত থাকে, তবে দক্ষিণ এশিয়া আরও গভীর সংকটের মুখে পড়তে পারে।