বিশেষ প্রতিনিধি | ঢাকা থেকে
দক্ষিণ এশিয়ার দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিবেশী — ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আবারও পানি ও সীমানা ঘিরে তীব্র উত্তেজনা দেখা দিয়েছে।
“পানি নিয়ে আবার উত্তপ্ত ভারত-পাকিস্তান”, “ঝিলাম নদীর বন্যায় শঙ্কিত কাশ্মীর
ভারত থেকে ঝিলাম নদীর অতিরিক্ত পানি ছাড়ার ফলে পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরের বিভিন্ন অঞ্চলে হঠাৎ করে মাঝারি ধরনের বন্যা দেখা দিয়েছে। শনিবার (২৬ এপ্রিল) পাকিস্তানের কাশ্মীরের রাজধানী মুজাফ্ফরাবাদের জেলা প্রশাসনের এক মুখপাত্র আল-জাজিরাকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
তিনি জানান,
“ঝিলাম নদীর পানির স্তর স্বাভাবিকের তুলনায় দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাসিন্দাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে, কারণ পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে।”
এদিকে, কেবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, এর পেছনে রয়েছে দ্বিপাক্ষিক রাজনৈতিক টানাপোড়েনও। জম্মু ও কাশ্মীরে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই দেশের সম্পর্ক আরও অবনতি ঘটেছে।
পানির রাজনীতি: সিন্ধু চুক্তির স্থগিত ঘোষণা

পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান দৈনিক ডন জানিয়েছে, ভারত সরকার ১৯৬০ সালের ঐতিহাসিক ইন্দাস পানি চুক্তি “স্থগিত” ঘোষণা করেছে। এই পদক্ষেপ দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে টিকে থাকা পানিবণ্টন ব্যবস্থাকে মারাত্মক অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই সিদ্ধান্তের ফলে পাকিস্তানের কৃষি উৎপাদন, বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং দৈনন্দিন পানির চাহিদায় গুরুতর সংকট দেখা দিতে পারে। কারণ, পাকিস্তানের কৃষি এবং সেচব্যবস্থা মূলত ইন্দাস, ঝিলাম এবং চেনাব নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল।
সিন্ধু পানি চুক্তির সংক্ষিপ্ত পটভূমি:
১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত এই চুক্তি অনুযায়ী —
- ভারত পায় পূর্বের তিনটি নদী: রবি, বিয়াস, সুতলেজ
- পাকিস্তান পায় পশ্চিমের তিনটি নদী: ইন্দাস, ঝিলাম, চেনাব
ভারত এই চুক্তির অধীনে সীমিত ব্যবহারের অধিকার রাখলেও, নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করতে পারে না বা পানি সংরক্ষণ করতে পারে না।
কিন্তু এখন ভারত এই চুক্তি “স্থগিত” করে পাকিস্তানের পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে, যা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলেই অনেকে মনে করছেন।
সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলা এবং পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থা

সম্প্রতি ভারতের কাশ্মীরের পর্যটন শহর পাহালগামে এক মর্মান্তিক সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন ভারতীয় পর্যটক নিহত হন। এই ঘটনার জন্য ভারত সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করে। প্রতিক্রিয়ায়, ভারত —
- সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করে
- পাকিস্তানি নাগরিকদের ভিসা বাতিল করে
- সীমান্তে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে
অন্যদিকে, পাকিস্তান ভারতের এসব সিদ্ধান্তকে ‘যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য’ বলে আখ্যা দিয়েছে।
পাকিস্তান পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে —
- ভারতীয় বিমান সংস্থার জন্য আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে
- কূটনৈতিক চাপ তৈরি করতে আন্তর্জাতিক মহলের কাছে নালিশ করেছে
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে,
“ভারতের এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক চুক্তি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিপন্থী। এর ফলে গোটা অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে।”
জলবায়ু পরিবর্তন ও নদী-রাজনীতির ঝুঁকি
বিশ্লেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নদীর প্রবাহের অস্থিরতা এবং হঠাৎ বন্যার ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে। এর সাথে যদি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও প্রতিহিংসা মিশে যায়, তাহলে এর প্রভাব পড়বে কোটি কোটি সাধারণ মানুষের জীবনে।
বিশ্বব্যাংক এবং জাতিসংঘ ইতোমধ্যে দুই পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে এবং পানিবণ্টন সংক্রান্ত সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পরামর্শ দিয়েছে।
সামনে কী?
বর্তমানে ঝিলাম নদীর পানি পাকিস্তানের কাশ্মীর অংশে মধ্যম মাত্রার বন্যা তৈরি করেছে। তবে পরিস্থিতির অবনতি হলে বড় ধরণের মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।
বিশেষ করে, চাষাবাদ, পানির সরবরাহ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতগুলো সরাসরি এই সংঘাতের শিকার হতে পারে।
পানি নিয়ে দ্বন্দ্ব যদি চলমান থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে এটি সীমান্ত সঙ্ঘাত থেকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে গড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
পানির রাজনীতি দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন নয়। তবে এই অঞ্চলের দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে পানি নিয়ে এমন উত্তপ্ত পরিস্থিতি ইতিহাসে বিরল।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে প্রয়োজন — কূটনৈতিক সংলাপ, পারস্পরিক আস্থা এবং জনগণের জীবন-জীবিকা রক্ষার দায়িত্ববোধ।
নদীর পানি কোনো দেশের একক সম্পদ নয় — এটি মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য।
সেই চেতনাকে সামনে রেখেই ভারত-পাকিস্তান উভয়ের উচিত সংকট নিরসনে এগিয়ে আসা।