ভারত ও পাকিস্তান, এই দুটি দেশ ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই কাশ্মীর নিয়ে একাধিকবার যুদ্ধে জড়িয়েছে। এই সংঘাতের মূল কারণ হলো কাশ্মীর অঞ্চলের দখল নিয়ে বিরোধ, যা আজও পর্যন্ত একটি জটিল সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। উভয় দেশই নিজেদের সামরিক শক্তিকে ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রতিবেদনে, আমরা এই দুই দেশের সামরিক সক্ষমতা, পারমাণবিক অস্ত্রাগার এবং সাম্প্রতিক সামরিক উন্নয়ন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (IISS) মতে, ২০১৮ সালে ভারত তার সামরিক খাতে ৫৮ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করে, যা তাদের জিডিপির ২.১%। এর মধ্যে ১.৪ মিলিয়ন ডলার ছিল সক্রিয় সেনা সদস্যদের জন্য। একই বছর, পাকিস্তান সামরিক খাতে ১১ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করে, যা তাদের জিডিপির ৩.৬% ছিল। এই বরাদ্দ ছিল ৬ লাখ ৫৩ হাজার ৮০০ জন সেনা সদস্যের জন্য। পাকিস্তান ২০১৮ সালে বিদেশি সামরিক সহায়তা হিসেবে ১০০ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে। ভারতের সামরিক বাহিনীতে প্রায় ১৪ লক্ষ সক্রিয় সদস্য রয়েছে, যেখানে পাকিস্তানের রয়েছে প্রায় ৬ লক্ষ ৫৫ হাজার। এই বিশাল সেনাবাহিনী উভয় দেশকেই বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম সামরিক শক্তিতে পরিণত করেছে।
ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই ক্ষেপণাস্ত্র এবং পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম। ভারতের অস্ত্রাগারে বিভিন্ন পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যেমন অগ্নি-3, যা ৩,০০০ থেকে ৫,০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। এছাড়াও, ভারতের কাছে পৃথ্বী, ব্রহ্মোস এবং সূর্য-এর মতো উন্নত ক্ষেপণাস্ত্রও রয়েছে। পাকিস্তানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিও বেশ বিস্তৃত, যেখানে ভ্রাম্যমাণ এবং মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যা ভারতের যেকোনো স্থানে আঘাত হানতে সক্ষম। শাহিন-২ হলো পাকিস্তানের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, যার পাল্লা ২,০০০ কিলোমিটার। এছাড়াও, পাকিস্তানের কাছে বাবর, গজনবী এবং হ Hatf-এর মতো ক্ষেপণাস্ত্রও রয়েছে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (SIPRI) এর তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানের কাছে ১৪০-১৫০টি এবং ভারতের কাছে ১৩০-১৪০টি পরমাণুবাহী যুদ্ধাস্ত্র রয়েছে। এই পারমাণবিক সক্ষমতা উভয় দেশের মধ্যে একটি বিপজ্জনক ভারসাম্য তৈরি করেছে, যা সরাসরি যুদ্ধের সম্ভাবনা কমিয়ে দিলেও উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয়।
ভারতের স্থলবাহিনীতে রয়েছে প্রায় ৪,৬২৬টি যুদ্ধ ট্যাংক, ৩,৯০০টি পদাতিক যুদ্ধ যান, ৩৩৬টি সাঁজোয়া যান এবং ৯,৭১৯টি আর্টিলারি। ভারতের টি-৯০ ভীষ্ম এবং অর্জুন প্রধান যুদ্ধ ট্যাংকগুলো বিশ্বের অন্যতম সেরা হিসেবে বিবেচিত। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে রয়েছে ২,৪৯৬টি ট্যাংক, ১,৬০৫টি সাঁজোয়া যান, ৪,৪৭২টি আর্টিলারি গান এবং ৩৭৫টি স্ব-চালিত হাউitzer। পাকিস্তানের আল-খালিদ এবং আল-জারার ট্যাংকগুলো তাদের স্থলযুদ্ধের প্রধান শক্তি। IISS-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের বিশাল সেনাবাহিনীর জন্য পর্যাপ্ত সহযোগিতা, পরিচর্যা, গোলাবারুদ এবং খুচরা যন্ত্রাংশের ঘাটতি রয়েছে। তবে, ভারত সরকার এই ঘাটতি পূরণের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে।
ভারতীয় বিমানবাহিনীতে ১ লক্ষ ৪৩ হাজার কর্মী এবং ৮১৪টি যুদ্ধবিমান রয়েছে। তবে, ভারতের যুদ্ধ জেট বিমান নিয়ে কিছু উদ্বেগ রয়েছে। ভারতের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার জন্য ৪২টি স্কোয়াড্রন জেট প্রয়োজন, প্রায় ৭৫০টি বিমান, যা চীন ও পাকিস্তান থেকে আসা আক্রমণ প্রতিহত করতে পারে। রাশিয়ার পুরনো মিগ-২১ যুদ্ধবিমান, যা ১৯৬০ সালে প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল, শীঘ্রই অবসরের পথে। ২০৩২ সালের মধ্যে ভারতের ২২টি স্কোয়াড্রন থাকতে পারে। ভারত সরকার রাফায়েল এবং সুখোই সু-৩০এমকেআই-এর মতো আধুনিক যুদ্ধবিমান যুক্ত করে তাদের বিমানবাহিনীকে শক্তিশালী করছে। পাকিস্তানের বিমানবাহিনীতে ৪২৫টি যুদ্ধবিমান রয়েছে, যার মধ্যে চীনের তৈরি এফ-7পিজি এবং আমেরিকান এফ-16 ফ্যালকন উল্লেখযোগ্য। পাকিস্তানের ৭টি বায়ুবাহিত প্রাথমিক সতর্কতা ও নিয়ন্ত্রণ বিমান রয়েছে, যা ভারতের চেয়ে তিনটি বেশি। পাকিস্তান তাদের বিমানবাহিনীকে আধুনিকীকরণের দিকে নজর রেখেছে।
ভারতীয় নৌবাহিনীতে একটি বিমান বহনকারী, ১৯টি সাবমেরিন, ১৪টি সাবমেরিন বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, ১৬টি উপকূলীয় যুদ্ধজাহাজ এবং ৭৫টি যুদ্ধ ক্ষমতাসম্পন্ন বিমান রয়েছে। এই বাহিনীতে প্রায় ৬৭,৭০০ জন কর্মী রয়েছে। ভারতের বিমানবাহী রণতরী INS বিক্রমাদিত্য এবং INS বিরাট তাদের নৌবাহিনীর প্রধান শক্তি। পাকিস্তানের নৌবাহিনীতে ৯টি ফ্রিগেট, ৮টি সাবমেরিন, ১৭টি সামুদ্রিক যুদ্ধজাহাজ এবং ৮টি যুদ্ধ ক্ষমতাসম্পন্ন বিমান রয়েছে। পাকিস্তান তাদের নৌবাহিনীকে আধুনিক সাবমেরিন এবং যুদ্ধজাহাজ দিয়ে শক্তিশালী করছে।
সম্প্রতি, ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে জইশ-ই-মোহাম্মদ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আত্মঘাতী বোমা হামলায় ভারতের আধাসামরিক বাহিনীর ৪৯ জন সদস্য নিহত হওয়ার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই হামলার কঠোর জবাব দেওয়ার জন্য সেনাবাহিনীকে অনুমতি দিয়েছেন, এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান যেকোনো হামলার জবাব দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এই ঘটনা দুটি দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তুলেছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদ্বিগ্ন করেছে।
ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই নিজেদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে একটি বড় উদ্বেগের কারণ। দুটি দেশই বিশাল সেনাবাহিনী, উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি এবং পারমাণবিক অস্ত্রাগারে সজ্জিত। এই সামরিক সক্ষমতা উভয় দেশের মধ্যে একটি বিপজ্জনক ভারসাম্য তৈরি করেছে, যা সরাসরি যুদ্ধের সম্ভাবনা কমিয়ে দিলেও উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয়। এই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জোরালো ভূমিকা রাখা উচিত।