ইসরায়েলের ছয় সপ্তাহব্যাপী যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব হামাস প্রত্যাখ্যান করেছে, কারণ এতে গাজা ভূখণ্ড থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার কিংবা স্থায়ী যুদ্ধবিরতির কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। প্রস্তাবে হামাসকে তাদের অস্ত্র পরিত্যাগ করতে বলা হয়েছিল এবং বিনিময়ে জীবিত জিম্মিদের মধ্যে অর্ধেককে মুক্তি দিতে বলা হয়। কিন্তু হামাসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এমন কোনো চুক্তিতে তারা যাবে না যা শুধুমাত্র ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষা করে এবং ফিলিস্তিনিদের ভোগান্তি অব্যাহত রাখে।
একজন জ্যেষ্ঠ ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা বিবিসিকে জানান, “মিশরের মাধ্যমে প্রাপ্ত ইসরায়েলি প্রস্তাবে হামাসের নিরস্ত্রীকরণের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু এর বিপরীতে ইসরায়েল যুদ্ধ থামাবে বা গাজা ছেড়ে যাবে—এমন কোনো অঙ্গীকারই করেনি। কাজেই হামাস পুরো প্রস্তাবই বাতিল করেছে।”
হামাসের পক্ষ থেকে বারবার জানানো হয়েছে, তারা কেবলমাত্র তখনই জিম্মিদের মুক্তি দেবে যখন যুদ্ধ পুরোপুরি থেমে যাবে এবং ইসরায়েল গাজা থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে যাবে। এর আগে, হামাস পাঁচজন জিম্মিকে মুক্তি দেওয়ার বিনিময়ে যুদ্ধবিরতি বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল এবং জানিয়েছিল তারা বন্দিমুক্তির সংখ্যা নিয়েও নমনীয় হতে পারে।
এদিকে, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সম্প্রতি ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এরপরই ইসরায়েল এই নতুন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবটি আঞ্চলিক মধ্যস্থতাকারীদের কাছে পাঠায়। হামাসের প্রধান আলোচক খালিল আল-হাইয়া কায়রোতে মিশরের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেন।
বর্তমানে মিশর একটি সংশোধিত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব হামাসের কাছে পাঠিয়েছে, যা তারা বিবেচনা করছে বলে জানা গেছে। তবে ইসরায়েলি গণমাধ্যমগুলো বলছে, খুব দ্রুত কোনো চুক্তির সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ইসরায়েলের একটি শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তা উদ্ধৃত হয়ে জানিয়েছেন, “আমরা আশা করছি দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে একটি চুক্তি হবে, কিন্তু এখনও বেশ ফারাক আছে। আমরা চাই ১৯ জন জীবিত জিম্মিকে ফিরে পেতে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র একসাথে কৌশল নির্ধারণ করছে এবং সামরিক চাপ হামাসের উপর প্রভাব ফেলছে।”
বর্তমানে গাজার পরিস্থিতি চরম মানবিক সংকটের দিকে চলে গেছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, গাজায় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় অবরোধ চলছে—গত ছয় সপ্তাহে সেখানে কোনো খাদ্য, জ্বালানি বা চিকিৎসা সরঞ্জাম প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। গাজার হাসপাতালগুলো কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। খান ইউনিসের একটি ফিল্ড হাসপাতালের উপর মঙ্গলবার সকালে ইসরায়েলি বিমান হামলায় একজন নিরাপত্তা প্রহরী নিহত হন এবং কমপক্ষে নয়জন আহত হন। ইসরায়েল দাবি করেছে, হামলাটি ছিল সুনির্দিষ্ট এবং এতে একজন হামাস সেল কমান্ডার নিহত হয়েছে।
এদিকে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, এই ধরনের হামলা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন হতে পারে এবং এটি গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর “ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে”। গাজা শহরের আল-আহলি আরব হাসপাতালেও সম্প্রতি এক হামলায় অন্তত একটি ভবন ধ্বংস হয়ে গেছে এবং সেই হাসপাতাল এখন আর নতুন রোগী নিতে পারছে না।
ইসরায়েলের অভ্যন্তরেও যুদ্ধ নিয়ে মতভেদ বাড়ছে। সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, ইসরায়েলি জনগণের একটি বড় অংশ যুদ্ধ থামিয়ে জিম্মিদের মুক্তির পক্ষে। অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, হামাসকে দমন করার চেয়ে জিম্মিদের মুক্ত করাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ কিনা।
প্রতিরক্ষা বাহিনীর ভেতরে, বিশেষ করে রিজার্ভ বাহিনীতে, অসন্তোষ বাড়ছে। একাধিক রিজার্ভ সেনা ও সাবেক সদস্যরা উন্মুক্ত চিঠিতে সরকারের যুদ্ধনীতি সমালোচনা করেছেন। তারা বলছেন, এই যুদ্ধের ব্যয়, দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি ও সরকারের ধর্মীয় চরমপন্থীদের তোষণ নীতির কারণে দেশ বিভক্ত হয়ে পড়ছে।
এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো—এই অচলাবস্থা কতদিন চলবে? মানবিক সংকটের কারণে আন্তর্জাতিক মহলে চাপ বাড়ছে, আর গাজায় প্রতিদিনই বাড়ছে মৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞ। হামাস ও ইসরায়েল উভয়ের অবস্থান কঠোর হওয়ায় যুদ্ধ থামানোর পথ আপাতত খুব সহজ দেখাচ্ছে না। তবে কূটনৈতিক তৎপরতা চলমান রয়েছে, যার ওপর নির্ভর করছে আগামী দিনের নির্ধারক সিদ্ধান্তগুলো।