নাজমুল হোসেন, ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি:
ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলায় এক সময়ের বাঁশ ও বেতের কারিগরগুলো প্লাস্টিকের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাপটে এখন প্রায় দুই শত পরিবার তেমন ভালো নেই। তবে একটা সময় বাঁশ মালিদের গ্রামের কৃষক পরিবার থেকে শহরের প্রতিটি পরিবারে বেশ কদর ছিল যা চোখে পড়ার মতো। বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তির উন্নত জীবন মানের আধুনিকতায় বাঁশ মালিদের আগের সেই কদর এখন প্রায় বিলিনের পথে।

এক সময় রাণীশংকৈল উপজেলার প্রতিটি বাঁশ মালির পরিবার সারাদিন বাঁশের তৈরি বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তৈরী করতে ব্যস্ততায় দিন পার করতো পরিবারের ছোট বড় সকলেই।বর্তমান কালের বিবর্তনে সেই দৃশ্য গুলো হারিয়ে গেছে বাঁশ মালিদের পরিবার থেকে। এক সময় প্রতিটি পরিবার বাঁশের নিত্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র বানিয়ে সাপ্তাহিক বড় ছোট সকলে হাট বাজারে বিক্রি করেই তাদের জীবিকা নির্বাহ করলেও এখন আর সেই অতিতের চিত্র গুলো অনেক টা সপ্নের মতো।
আগে বাঁশ মালির বিভিন্ন কারিগর গুলো সারাদিনের ব্যস্ততা পার করে বিকাল হলেই বিভিন্ন হাটবাজারে তাদের বাঁশের তৈরি করা বিভিন্ন নকশার টুকরি,কুলা,হাতপাখা, খুচি,মাটির ডালি,বিভিন্ন ঝুড়ি সহ তাদের তৈরি জিনিসপত্র বিক্রির জন্য যেত, কিন্তু কালের বিবর্তনে আধুনিক প্লাস্টিকের জিনিসপত্র ও সিলভারের জিনিসপত্র বাজারে পর্যাপ্ত সর্বরাহের কারণে আর আগের মতো চাহিদা না থাকায় অনেকেই বাপ দাদার পেশাটি নামমাত্র ধরে আছেন। প্রয়োজনের তুলনায় কৃষক পরিবার গুলোর বাঁশ তৈরি জিনিসের প্রতি অনেকের আগ্রহ কম থাকায় হাট বাজারে এসব তেমন একটা বেচাবিক্রি হয় না।তাই অনেক পরিবার এখন বিভিন্ন ভাবে ঋণ গ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এ পেশার অনেক বাঁশ শিল্প কাজের সাথে জরিতরা পরিবার নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় দিন পার করছে।
উপজেলার বলিদারা অনন্তপুর গ্রামের অর্জুন দাস বলেন,এই বাঁশ শিল্প আমাদের বাপ দাদা থেকে শুরু করে তাদেরও আগের মানুষ গুলোও এই কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেছে এটি আমাদের প্রাচীন একটি পেশা। আগে গ্রাম থেকে শহর সবার পরিবারে আমাদের বাঁশের তৈরি এসব জিনিসপত্র ব্যবহার হতো।আমরাও পরিবারের সবাই এই কাজে ব্যস্ত থাকতাম। তবে এখন বিভিন্ন প্লাস্টিকের জিনিসপত্র বাজারে আসার কারণে এখন আর বাঁশের তৈরি আসবাবপত্র বেশি চলে না। তাই আমরা অনেকেই বাপ দাদার এই পেশাটি টিকিয়ে রাখা নিয়ে চিন্তায় আছি। অনেকেই এখন পেশা বদলিয়ে অন্যান্য পেশায় যোগ দিচ্ছেন। ওই গ্রামের রচনা রাণী দাস ও তেতলা রাণী দাস এবং রুপালী রাণী দাস বলেন,এই পেশা টিকিয়ে রাখতে আমরা নারীরা এখন বাড়িতে বাঁশের তৈরি বিভিন্ন জিনিস পত্র তৈরি করছি এগুলো সপ্তাহে দুই একদিন বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে যায় পুরুষ মানুষ গুলো তবে আগের মতো আর এই জিনিস গুলোর প্রতি গ্রামের মানুষের চাহিদা না থাকায় তেমন একটা বিক্রি হয় না।অন্যদিকে আবার প্রতিটি বাঁশ কিনতে অতিরিক্ত টাকা লাগে, আগে একটি বাঁশ কিনতাম ১০০/১৫০ টাকায় আর এখন সেই বাঁশ গুলো বাজারে বারতি ২৫০/৩৫০ টাকা দিয়ে কিনতে হয়। আর বাঁশ দিয়ে যেসব আসবাব পত্র আমরা তৈরি করি সেগুলো বাজারে উচিৎ মুল্যে দাম পাওয়া যায় না। তাই খাটুনি হিসেবে আগের মতো আর লাভ হয় না এই পেশায়। সেজন্য পরিবারের পুরুষ মানুষগুলো ভ্যান,অটো সহ বাড়ি ঘরের পাটুন তৈরির কাজ করে, অনেকে আবার বিভিন্ন কৃষি কাজে সময় দিচ্ছে, তবে তারদেরও তেমন আয় হয় না। পরিবারের স্বামী স্ত্রী দুজনের মিলে যা আয় হয় তাই দিয়ে কিস্তির টাকা পরিষদ করতে হয় বাকিটা দিয়ে খুব কস্ট করে সংসার টানাটানি করে চালিয়ে নিতে হচ্ছে। আমাদের এই পেশার প্রতি যদি সরকার পৃষ্ঠপোষকতা করে এবং সরকারি একটু সহায়তা পাই তাহলে বাপ দাদার পেশা কে ধরে রাখা সম্ভব হবে।
রাণীশংকৈল পৌর শহরের কৃষ্ণ দাস ও তার স্ত্রী মিনতি রাণী দাস, বসবাস করছেন বড় ব্রিজের সামনে খাস জমিতে, আয়ের একমাত্র ভরসা এই বাঁশ মালির ব্যবসা,তিনি এলাকার অনেক কারিগরের কাছে বাঁশের তৈরি বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী পাইকারি ভাবে কিনেন তারপর তিনি সাপ্তাহিক হাট হরিপুর উপজেলার যাদুরানী বাজার,রাণীশংকৈল উপজেলার নেকমরদ ও কাতিহার,পৌর শহরের বন্দর হাটে এসব জিনিসপত্র বিক্রি করেন এই কাজ ছাড়া তিনি আর কিছুই পারেন না।তবে তিনি বলেন,এখন এই আধুনিক প্লাস্টিকের দাপটে আমাদের এই পেশা হারিয়ে যেতে বসেছে।এখন আর আগের মতো বেচাবিক্রি নাই যা বিক্রি হয় তাই দিয়ে কোন রকম সংসার চলে। সরকারের কাছে আমাদের আকুল আবেদন এই বাঁশের শিল্পটি যেন ধরে রাখা হয়।এবং সরকারি ভাবে আমাদের সুদ মুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।
বেসরকারি এনজিও ইএসডিও থ্রাইভিং থ্রো ইক্যুইটি ইকোনমিক এ্যামপাওয়ারমেন্ট এন্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স (থ্রাইভ) প্রজেক্টের অফিসার খায়রুল ইসলাম বলেন,রাণীশংকৈল উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও পৌরসভা মিলে প্রায় ২০০/২৫০ টি বাঁশ মালি পরিবার রয়েছে। আমরা এই দলিত সম্পদায়ের মানুষের জীবন মান উন্নয়নে প্রতিনিয়তই কাজ করে আসছি,আমরা তাদের এই পেশাকে টিকিয়ে রাখতে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের ইএসডিও আর্থিকভাবে সহায়তা করে যাচ্ছে।