বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ে বিতর্ক থামছেই না। গত বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে যেসব নেতার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে, তাদের বিচার হবে বাংলাদেশের আদালতে।
এদিকে, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামি, এনসিপি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে আসছে। ছাত্র-জনতা, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভে উত্তাল, তারা জানিয়ে দিয়েছে, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করা পর্যন্ত কোনো নির্বাচন হবে না। এরই মধ্যে এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার জন্য সরকারের প্রতি চাপ বাড়াচ্ছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি উঠেছিল এবং সেই দাবি এখন আবার জোরালো হচ্ছে। সাত মাস ধরে রাজনীতিতে এই ইস্যু নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চললেও, আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি একাধিক রাজনৈতিক দলের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে। এ সময়ের মধ্যে বিএনপির নেতৃবৃন্দ বলেছেন, দলটির বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত হলে, নিষিদ্ধ করার কথা চিন্তা করা যেতে পারে।
সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আওয়ামী লীগের রাজনীতি নির্ধারণ হবে তাদের বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়া ও ট্রাইব্যুনাল পরিচালনার ওপর ভিত্তি করে। এই বিষয়ে সরকার কোনও হস্তক্ষেপ করবে না, তবে ছাত্র-জনতা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারা ও বিশ্লেষকরা বলেছেন, অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথাযথ বিচার হলে, দলটি রাজনীতি করার সুযোগ পেতে পারে, তবে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচারের মুখোমুখি হওয়া উচিত।
আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবিতে উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন সারাদেশে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। গত কয়েক মাসে নানা রাজনৈতিক দল এবং সংগঠন তাদের অবস্থান পরিষ্কার করে আসছে, যেখানে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান এবং জুলাই-অগাস্টের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্বের প্রশ্ন তোলা হচ্ছে।
বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদ, এবি পার্টি, হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষভাবে উল্লেখ করছে যে, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যার অভিযোগ রয়েছে, সেগুলোর বিচার না হওয়া পর্যন্ত তাদের রাজনীতি করা উচিত নয়। এ বিষয়ে একাধিক বিক্ষোভ, প্রতিবাদ, ও সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে রাজনৈতিক নেতারা দাবি জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হোক এবং ওই দলের নেতাদের বিচারের মুখোমুখি করা হোক।
এদিকে, এনসিপি’র আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ এবং গণহত্যার বিচারের দাবিতে তারা বিক্ষোভ কর্মসূচি অব্যাহত রাখবে। পাশাপাশি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীরা হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করা পর্যন্ত তারা কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি আরও জোরালো হয়ে উঠেছে। সেই সময় থেকেই দলটির নিবন্ধন বাতিল করার দাবিও উঠেছে। একদিকে যেমন রাজনৈতিক দলগুলো এর পক্ষে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে, তেমনি বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্যে এই দাবি পরবর্তী সময়ে আদায় হতে পারে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
অন্যদিকে, বিএনপি এবং জামায়াতের নেতারা স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত হলে আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ করা হবে। তাদের দাবি, বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার পর দলটির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে। বিএনপির মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, দলটির বিচারের মধ্যে দিয়ে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত জনগণ এবং রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত হতে হবে।
বিভিন্ন বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে যদি এই ইস্যু আরও উত্তপ্ত হয়। তারা মনে করছেন, দেশে সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থার কার্যকর প্রক্রিয়া না থাকলে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়তে পারে। তাদের মতে, দেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ও রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হলে, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ সঠিকভাবে তদন্ত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
এই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে যদি অন্যান্য দলগুলোও নিজেদের অবস্থান আরও শক্তভাবে দৃশ্যমান করে তোলে, বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াত ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একযোগে। সেইসাথে, জনগণের মধ্যে এমন উত্তেজনা রয়েছে যে, রাজনীতি ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভবিষ্যৎ তাদের বিচারপ্রক্রিয়া এবং সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে।
সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য জানিয়েছে, এ বিষয়ে তাদের কোনো নির্দিষ্ট এজেন্ডা নেই এবং আওয়ামী লীগ ইস্যুতে তারা কোনও হস্তক্ষেপ করবে না। তবে ছাত্র-জনতা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সিদ্ধান্ত নেবে, এমনটাই জানিয়েছেন সরকারের সিনিয়র সহকারী প্রেস সচিব ফয়েজ আহম্মদ।
এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ আরও অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে, যেখানে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অধিকার নিয়ে বিতর্ক আরও তীব্র হয়ে উঠবে।