তুরস্কের ইস্তাম্বুলে শহরের বিরোধী দলের মেয়র একরেম ইমামোগলুর গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে শুক্রবার (১৫ মার্চ) রাতে কয়েক লাখ মানুষ বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে। প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও বিশাল জনসমাগম ঘটে, যেখানে তিনি সতর্ক করেছিলেন যে, তুরস্ক “রাস্তার সন্ত্রাস” সহ্য করবে না।
এটি ছিল টানা তৃতীয় রাত, যখন বিক্ষোভকারীরা ইস্তাম্বুলসহ বিভিন্ন শহরে জড়ো হয়েছে। গত এক দশকের মধ্যে এটি তুরস্কের সবচেয়ে বড় গণবিক্ষোভের রূপ নিয়েছে।
প্রধান বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টির (CHP) নেতা ওজগুর ওজেল জানান, ইস্তাম্বুল নগর ভবনের সামনে অনুষ্ঠিত সমাবেশে অন্তত তিন লাখ মানুষ অংশ নিয়েছে।
তিনি বলেন, “এটি শুধুমাত্র CHP-এর বিক্ষোভ নয়, বরং এখানে সব দলের মানুষ এসেছেন একরেম ইমামোগলুর প্রতি সংহতি প্রকাশ করতে এবং গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়াতে।”
ওজেল আরও অভিযোগ করেন যে, এরদোয়ান বিচার বিভাগকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ইমামোগলুর ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন এবং ইস্তাম্বুল নগর ভবন নিজেদের দখলে নিতে চাইছেন। তবে CHP ও বিক্ষোভকারীরা জানিয়েছেন, তারা নগর ভবন সরকার-নিযুক্ত ট্রাস্টির কাছে হস্তান্তর করবেন না।

ইস্তাম্বুলের পাশাপাশি রাজধানী আঙ্কারা ও পশ্চিম উপকূলীয় শহর ইজমিরেও পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। পুলিশের ছোঁড়া টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেটে কয়েকজন সাংবাদিকও আহত হয়েছেন।
বিক্ষোভকারীরা এরদোয়ানের বিরুদ্ধে শ্লোগান দেন এবং হাতে ব্যানার বহন করেন, যেখানে লেখা ছিল— “ভয় পেয়ো না, জনগণ এখানে!” এবং “আইন, অধিকার, ন্যায়বিচার চাই!”
৫৬ বছর বয়সী এক নারী বিক্ষোভকারী নেজলা বলেন, “আমরা জোরপূর্বক রাস্তায় নামিনি। আমরা এখানে এরদোয়ানের কারণে এসেছি।”
তিনি আরও বলেন, “আমি ইমামোগলুর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ বিশ্বাস করি না। তার মতো সৎ মানুষ আর নেই।”
বিক্ষোভ প্রসঙ্গে এরদোয়ান বলেন, “তুরস্ক কখনোই রাস্তার সন্ত্রাসের কাছে মাথা নত করবে না।”
তিনি CHP নেতা ওজেলকে “গুরুতর দায়িত্বহীনতার” জন্য অভিযুক্ত করেন এবং ইঙ্গিত দেন যে, তিনি নিজেও আইনি প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হতে পারেন।
শুক্রবার তুরস্কের কর্তৃপক্ষ আঙ্কারা ও ইজমিরে বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করে এবং ইস্তাম্বুল নগর ভবনের প্রধান সড়কগুলো বন্ধ করে দেয়, যার মধ্যে গালাতা ব্রিজ ও আতাতুর্ক ব্রিজও ছিল।
বৃহস্পতিবার রাতে পুলিশের টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেটের হামলায় আঙ্কারায় অন্তত ৮৮ জন বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলি ইয়েরলিকায়া জানান, সংঘর্ষে ১৬ জন পুলিশ আহত হয়েছেন এবং “বিদ্বেষ উসকে দেওয়ার” অভিযোগে অনলাইনে পোস্ট দেওয়ার জন্য ৫৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তুরস্কের সরকারি কৌঁসুলিরা অভিযোগ এনেছেন যে, ইমামোগলু “সন্ত্রাসী সংগঠনকে সহায়তা করেছেন”— বিশেষ করে নিষিদ্ধ ঘোষিত কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী (PKK)-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আনা হয়েছে।
এছাড়া, তাকে ও আরও ১০০ জন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে দুর্নীতির অভিযোগেও তদন্ত করা হচ্ছে।
ইমামোগলুর গ্রেপ্তারের পরই তুরস্কের মুদ্রা লিরার দরপতন ঘটে এবং শুক্রবার দুপুরে BIST 100 স্টক এক্সচেঞ্জ ৮ শতাংশ কমে যায়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন এবং এর প্রভাব অর্থনীতিতে পড়তে শুরু করেছে।
ইমামোগলুর গ্রেপ্তার সত্ত্বেও CHP ঘোষণা করেছে যে, রবিবার তারা তার নাম আনুষ্ঠানিকভাবে ২০২৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য CHP-এর প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করবে।
দলটি জানিয়েছে, “এটি কেবল একটি দলের অভ্যন্তরীণ ভোট নয়, বরং জনগণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।” CHP জনগণকে ভোট দিতে আহ্বান জানিয়ে বলেছে— “ব্যালট বাক্সে এসে এই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ‘না’ বলুন!”
তুরস্কের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এরদোয়ান CHP-এর এই প্রক্রিয়া বন্ধ করার চেষ্টা করতে পারেন, কারণ ইমামোগলুর প্রতি জনসমর্থন বাড়তে থাকলে তা তার সরকারকে আরও চাপে ফেলবে।
মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের গবেষক গনুল টল বলেন, “যদি বিপুলসংখ্যক মানুষ ইমামোগলুর পক্ষে ভোট দেন, তবে এটি তাকে আরও জনপ্রিয় করে তুলবে এবং এরদোয়ান যা চান না, পরিস্থিতি সেই দিকেই যেতে থাকবে।”

সংক্ষেপে:
- ইমামোগলুর গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে ইস্তাম্বুলে ৩ লাখের বেশি মানুষ বিক্ষোভে অংশ নেয়।
- ৪০টির বেশি প্রদেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
- পুলিশের টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেট হামলায় আঙ্কারায় ৮৮ জন গ্রেপ্তার।
- CHP ইমামোগলুকে ২০২৮ সালের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ঘোষণা করতে যাচ্ছে।
- তুর্কি লিরার মূল্য হ্রাস ও শেয়ারবাজারে ধস।
- এরদোয়ানের হুঁশিয়ারি— “রাস্তার আন্দোলন ব্যর্থ হবে।”
তুরস্কের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
এই আন্দোলন তুরস্কের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করছে। ইমামোগলু এখন শুধুমাত্র CHP-এর নেতা নন, বরং তিনি এরদোয়ানের দীর্ঘ সময়ের শাসনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছেন।
এই উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে তুরস্কে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কোন দিকে মোড় নেয়, তা এখন সারা বিশ্ব পর্যবেক্ষণ করছে।