সংবিধান সংস্কার নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমেই করা উচিত বলে মনে করে বিএনপি। প্রশাসনসহ নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কারগুলো নির্বাচনের আগেই করার বিষয়ে একমত পোষণ করেছে দলটি। তবে সংস্কার ইস্যুতে ৩১ দফার ভিত্তিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দেওয়া প্রস্তাবনাগুলোর ওপর মতামত তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। এক্ষেত্রে দলটি ও মিত্ররা অভিন্ন বা কাছাকাছি মতামত তুলে ধরার কৌশল নিয়েছে। অবশ্য বিএনপির সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ইতোমধ্যে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক তিনটি দল ঐকমত্য কমিশনে তাদের মতামত জমা দিয়েছে। আগামী সপ্তাহে মতামত জমা দিতে পারে বিএনপিসহ বাকি মিত্ররা।
গত রোববার দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ঐকমত্য কমিশনের পাঠানো সংবিধান ও নির্বাচন কমিশন সংস্কার রিপোর্টের ওপর দলীয় প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করা হয়। বৈঠকে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি সংবিধান সংস্কারের অধিকাংশ প্রস্তাবনার সঙ্গে একমত। তবে দলটির শীর্ষ নেতারা বৈঠকে এই মত প্রকাশ করেছেন যে, সংবিধান সংস্কারের এখতিয়ার একমাত্র নির্বাচিত সংসদের। নির্বাচিত সংসদই সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কার আনবে। এর বাইরে সরকারের নির্বাচন ও প্রশাসনিক সংস্কারের যে প্রস্তাবনাগুলো রয়েছে, সেগুলোর ওপর জোর দিয়েছেন তারা। প্রশাসনিক সংস্কারের মৌলিক বিষয়গুলোতে একমত পোষণ করেছেন নেতারা।
জানা গেছে, বিএনপি তাদের এই দলীয় সংস্কার প্রস্তাবনা ঐকমত্য কমিশনে জমা দেওয়ার পাশাপাশি সংবাদ সম্মেলন করে জাতির সামনেও তুলে ধরবে। সেখানে কেন এবং কোন কারণে দলীয় এই অবস্থান নেওয়া হয়েছে, তার ব্যাখ্যা তুলে ধরবে দলটি।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানা যায়, আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক শুরু করতে যাচ্ছে কমিশন। ওইদিন বেলা ৩টায় সংসদ ভবনের এলডি হলে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। প্রথমদিনের বৈঠকে লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি) অংশ নেবে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য দলের সঙ্গেও আলোচনার সময়সূচি ঘোষণা করা হবে বলে ঐকমত্য কমিশনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়। ঈদের আগে ২৪ মার্চ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সে হিসেবে আগামী সপ্তাহে আরো দুটি দলের সঙ্গে সংলাপে বসতে পারে কমিশন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সূত্রে জানা গেছে, সংস্কারের জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশের বিষয়ে মতামত দেওয়ার জন্য ৩৪টি রাজনৈতিক দল ও ৩টি রাজনৈতিক জোটকে চিঠি দেওয়া হয়। গত ৬ মার্চ দলগুলোর কাছে পাঠানো চিঠিতে মতামত দেওয়ার জন্য ১৩ মার্চ পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। চিঠি পাঠানো ৩৪টি দলের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীসহ ১২টি নিবন্ধিত নয়। তিনটি জোটের মধ্যে কোনো নিবন্ধিত দল আছে কি না জানা যায়নি। গতকাল পর্যন্ত ১৫টি দল মতামত জমা দিয়েছে।
ঐকমত্য কমিশন থেকে চিঠি পাওয়ার পর এটা নিয়ে শরিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে বিএনপি। জানা গেছে, কমিশন থেকে গত ১৩ মার্চের মধ্যে মতামত পাঠাতে বলা হলেও একটু সময় নিয়ে ভালোভাবে কাজটি শেষ করতে চায় দলটি। মিত্রদের সঙ্গে পরামর্শের পাশাপাশি দল ও দলের বাইরে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এক্সপার্টদের সঙ্গে কথা বলে দলীয় মতামত প্রস্তুত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দেওয়া সংস্কার প্রস্তাবনাগুলোর ওপর আমাদের দলীয় মতামত প্রস্তুত করা হয়েছে। এখন যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর সঙ্গে এটা নিয়ে পরামর্শ, আলোচনা করা হচ্ছে। যে কোনো দিন সেগুলো কমিশনে জমা দেওয়া হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা সংস্কার কমিশনগুলোর রিপোর্টের ওপর বিস্তারিত মতামত তুলে ধরব। সঙ্গে স্প্রেডশিটটাও থাকবে।
বিএনপি ইতোমধ্যে সংস্কারবিষয়ক কয়েকটি ইসুতে দলীয় অবস্থান পরিষ্কার করেছে। ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ও ‘গণপরিষদ নির্বাচন’নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে না তারা। দলটি মনে করছে, এর কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। কারণ, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এর একটি সংবিধান রয়েছে। এই সংবিধানের আলোকেই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নিয়েছে। যে সময়ে দেশে কোনো সংবিধান রচিত থাকে না, মানে একটা নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাÑ তখন গণপরিষদের প্রয়োজন হয়। দলটি মনে করে, বিগত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার আমলে সংবিধানে যে ব্যত্যয় বা বিচ্যুতি হয়েছে, সেজন্য সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রয়োজন। রাজনৈতিক মতৈক্যে সে সংস্কার করবে নির্বাচিত সংসদ।
বিএনপির নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলটি সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন ও প্রাদেশিক সরকারের ফর্মুলায়ও রাজি নয়। তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদকালে একসঙ্গে জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচন চাইবে না দলটি। একমত নয় জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও। সংসদীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ন্যূনতম বয়স কমিয়ে ২১ বছর করার বিষয়েও দলটির আপত্তি থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সর্বোচ্চ দুই টার্মে সীমিত করার বিষয়ে দলটি একমত হবে। তবে এ ক্ষেত্রে টানা দুবার না থাকার পক্ষে মত ব্যক্ত করা হবে। আইনসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর কিংবা আইনসভা ভেঙে গেলে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার শপথ না নেওয়া পর্যন্ত একটি অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব পালন করবে-এই বিধানে রাজি নয় বিএনপি। নির্বাচনকালীন ৯০ দিনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার থাকার বিষয়ে দলটি তাদের ঐকমত্যের কথা জানাবে। নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ, দায়িত্ব ও ক্ষমতা এবং স্বার্থের দ্বন্দ্ব স্পষ্টীকরণ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়ন করার বিষয়ে ইতিবাচক মতামত দেবে বিএনপি।