মুহাম্মদ আল্-হেলাল
সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এক কুরআনের শাসিত এক মুসলিম উম্মাহকে একই দিনে রমদানুল মুবারক, ঈদ, আরাফার সিয়াম পালনের যে প্রস্তাবনা দিয়েছেন সেটি কুরআন হাদীস বা সমসাময়িক বিষয়ের আলোকে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
প্রথমে দেখা যাক হজ্জ বা আরাফার সিয়াম ভিন্ন ভিন্ন দিনে হলে কি ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
মহান আল্লাহ হজ্জ কে মহা সম্মেলন এবং নিরাপত্তা স্থল হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন।
وَ اِذۡ جَعَلۡنَا الۡبَیۡتَ مَثَابَۃً لِّلنَّاسِ وَ اَمۡنًا ؕ وَ اتَّخِذُوۡا مِنۡ مَّقَامِ اِبۡرٰهٖمَ مُصَلًّی ؕ وَ عَهِدۡنَاۤ اِلٰۤی اِبۡرٰهٖمَ وَ اِسۡمٰعِیۡلَ اَنۡ طَهِّرَا بَیۡتِیَ لِلطَّآئِفِیۡنَ وَ الۡعٰكِفِیۡنَ وَ الرُّكَّعِ السُّجُوۡدِ ﴿۱۲۵﴾
‘যখন আমি কাবা গৃহকে মানুষের জন্যে সম্মিলন স্থল ও শান্তির আলয় করলাম, আর তোমরা ইব্রাহীমের দাঁড়ানোর জায়গাকে নামাযের জায়গা বানাও এবং আমি ইব্রাহীম ও ইসমাঈলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তওয়াফকারী, অবস্থানকারী ও রুকু-সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখ।’ (সূরা আল বাক্বারাহ:১২৫)
আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা হজ্জ কে সম্মেলন স্থল বলে আখ্যায়িত করেছেন। আর সেই সম্মেলনে টি হয় আরাফার ময়দানে। আরাফার ময়দানে অবস্থান করা বা মহাসম্মেলনে যোগদান করা হজ্জের অন্যতম প্রধান কাজ। সেটি যেহেতু সারা বিশ্বের মহাসম্মেলন সেখান থেকে বিশ্ব পরিচালনার পরবর্তী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সামরিক ইত্যাদি কর্মসূচি বাঞ্ছনীয়। এই সম্মেলনে যারা উপস্থিত থাকবেন তারা তো মহা কর্মযজ্ঞের অংশিদার। আর যারা উপস্থিত হতে পারেননি তাদের জন্যও রয়েছে কর্মসূচি।
আরবি ১২ মাসের মধ্যে জিলহজ অত্যন্ত গুরুত্ব ও ফজিলতপূর্ণ একটি মাস। বিশেষ করে এ মাসের প্রথম ১০ দিন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে এ মাসের প্রথম ১০ রাতের কসম খেয়েছেন।
وَ الۡفَجۡرِ ۙ﴿۱﴾
وَ لَیَالٍ عَشۡرٍ ۙ﴿۲﴾
‘শপথ ফজর-কালের এবং ১০ রাতের’। (আল ফাজর: ১-২) মুফাসসিরিনদের মতে, ওই ১০ রাত বলতে জিলহজের প্রথম ১০ দিন উদ্দেশ্য।
এই দশ দিনে বিশেষ কিছু ইবাদত বা কর্মসূচি রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম সকল মুসলমানের জন্য ঈদূল আযহা, সামর্থবানদের হজ্জ এবং যারা অসার্থবান তাদের জন্য আরাফার দিনে সিয়াম পালন।
হাদীস শরীফে ঘোষণা এসেছে আবু কাতাদাহ রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আরাফার দিনের রোজা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী, ইহা পূর্ববর্তী এক বছর ও পরবর্তী এক বছররে গুনাহর কাফফারা হবে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো আমরা বাংলাদেশিরা কি এই মহা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি? আমাদের দেশে প্রকৃতপক্ষে আরাফার দিনে সিয়াম না রেখে তার পরের দিন সিয়াম পালন করা হয়। যুক্তি হিসেবে বলা হয় আমাদের দেশে সাউদি আরাবিয়ার পরের দিন চাঁদ দেখা যায় সেই জন্য আমরা পরের দিন সিয়াম পালন করি। যদিও হাদীস শরীফে আরাফার দিন সিয়াম পালনের কথা বলা হয়েছে এবং আরাফার ময়দানও একটি আর আরাফার দিবসও একটি।
আবার আমরা রমদানুল মুবারকের সিয়াম বা ঈদসহ বিভিন্ন কর্মসূচিও পরের দিন থেকে পালন করি। কেননা একটি হাদীস আছে ‘তোমরা চাঁদ দেখে সিয়াম রাখ চাঁদ দেখে সিয়াম ছাড়।’
একসময় বর্তমান যুগের ন্যায় এত তথ্য প্রযুক্তির বিপ্লব ছিলনা সঙ্গত কারণে স্থানীয় ভাবে চাঁদ দেখে সকল কর্মসূচি পালন করা হতো। এখন যেহেতু পৃথিবীর একপ্রান্তের মানুষ চাঁদ দেখলে অন্য প্রান্তে দ্রুত পৌঁছে যায় এবং পৃথিবীও একটি তাহলে কেন একদিনে সকল কর্মসূচি পালন করা হবেনা।
এ প্রসঙ্গে জার্মান ভিত্তিক দ্য মিরর এশিয়া পত্রিকার সম্পাদক জার্মান প্রবাসী মারুফ মল্লিকের ফেসবুক পোস্ট প্রণিধানযোগ্য প্রথম যখন ইউরোপে আসি তখন এখানে আরব ও তুর্কিশরা পৃথক দিনে রোজা শুরু করতো। পৃথক দিনে ঈদ পালন করতো। একই দেশে দুইদিন ঈদ। আরব ও তুরস্কের মধ্যে ভৌগলিক ব্যবধান খুব বেশি নাই। তারপরও আলাদা দুইদিনে রোজা ও ঈদ পালন করায় আমরা পড়তাম বিপাকে। কোন দিন থেকে রোজা শুরু করবো। কাদের সঙ্গে ঈদ পালন করবো। দুইটাই বড় কমিউনিটি। কোন মসজিদের ঘোষণা শুনবো।
এঙ্গেলা মেরকেল চ্যান্সেলর থাকার সময় ঈদে মুসলমানদের ছুটি দেওয়ার কথা হয়েছিল একবার। কিন্তু তিনি বলেছিলেন একদিনে ঈদ হলে ছুটি দিতে সুবিধা হবে। আপনারা সিদ্ধান্ত নেন। সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসে দুই ধারার কমিউনিটি। বার্লিনে তারা বসে সিদ্ধান্ত নেয় একই দিনে রোজা ও ঈদ পালন করার। বিগত ৫/৬ বছর ধরে একই দিনে রোজা শুরু হয় এবং ঈদ পালন করা হয়। আমরা সবাই এখন একই দিনে ঈদ করি।
ইউরোপ এখন মক্কার নির্দেশ অনুসরন করে। আরব ও তুর্কিশরা মক্কায় চাঁদ দেখা গেলে রোজা রাখা শুরু করে এবং ঈদ পালন করে।
আমার মনে হয় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যথার্থই বলেছেন যে সারা বিশ্বের সঙ্গে একই দিনে ঈদ পালন করা যায় কিনা। তিনি বলেছেন, ‘সারাদেশে অনেক জ্ঞানী ওলামা মাশায়েখ রয়েছেন। আমরা চিন্তা করে দেখতে পারি কি না— বাংলাদেশের মানুষ সারা বিশ্বের মানুষের সঙ্গে মিল রেখে একই দিনে আমরা রোজা এবং ঈদ পালন করতে পারি কি না। বিজ্ঞানের যুগে এটি সম্ভব কি না, কোনো উপায় আছে কি না চিন্তা করার অনুরোধ।’
সারা বিশ্বের মুসলমানদের এক উম্মাহ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এই উম্মাহর ঈমান, আমল এক। বলা হয়েছে চাঁদ দেখে রোজা শুরু ও ঈদ পালন করতে। মুসলমানদের মধ্যে একজন চাঁদ দেখলে সম্মিলিত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে অন্যরা একই দিনে ঈদ পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। ভৌগলিক পার্থক্য থাকলেও বিজ্ঞানের এই যুগে একই দিনে রোজা শুরু করা ও ঈদ পালন করা অসম্ভব কিছু না। মেরু অঞ্চলে অনেক এলাকায় গ্রীস্মে সূর্য ডুবে না। তারা কি তাহলে ২৪ ঘণ্টাই রোজা রাখবে? তারা মক্কার সময় অনুসারে রোজা রাখে।
বিশ্বের সর্বত্রই সবাই রোজা রাখা ও ঈদ পালনের ক্ষেত্রে মক্কার মসজিদুল হারামের ইমামের নির্দেশ মেনে চলবে। সেখান থেকেই রোজা শুরু করার ও ঈদ পালনের ঘোষণা দেওয়া হবে। এমনটা হলে ভালোই হবে।
অন্যদিকে আমি ২০২২ সালে রমদানুল মুবারক শেষ করে থাইল্যান্ডে ঈদের সালাত আদায় করে পরের দিন বাংলাদেশে এসে দেখলাম এদেশে ঈদ উদযাপিত হচ্ছে। সাউদি আরাবিয়া থেকে বাংলাদেশ পূর্ব দিকে তার থেকেও পূর্ব দিকে থাইল্যান্ড তারা সাউদি আরাবিয়ার সাথে ইসলামী সকল কর্মসূচি পালন করতে পারলে আমরা কেন পারবনা?
আমরা এক নবির মুসলিম উম্মাহ আমরা পৃথিবী নামক এক গ্রহে বাস করি এক কুরানের শাসন মেনে চলি এক চাঁদ দেখে ইবাদত বন্দেগী করি তাহলে আমাদের কেন এত ভেদাভেদ থাকবে? বাংলাদেশ, সাউদি আরাবিয়া, পাকিস্তান, আফঘানিস্তান কোন প্রাকৃতিক সীমানা নয় এগুলো মানুষের তৈরি সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী সীমানা যে কোন সময় এমন আরো সীমানা হতে পারে যেমন এক কোরিয়া বর্তমান উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়া নামে বিভক্ত। আবার সীমানা বিলুপ্তও হতে পারে যেমন বার্লিন দেওয়ালের পতনের মধ্য দিয়ে পূর্ব এবং পশ্চিম জার্মানি এখন এক জার্মানী। আবার শিয়া, সূন্নী, হানাফী, শাফেয়িও আমাদের সৃষ্টি শ্রেনী বিভাগ।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন প্রত্যেক মুসলমান ভাই ভাই। আবার সারা বিশ্বের মুসলমান একটি শরীরের মত। কাশ্মীর, আফঘানিস্তান, সিরিয়া, ইরাকের মুসলমানের রক্তক্ষরণ হলে শুধু বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইন্ডিয়া নয়, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যে বা পৃথিবীর যে প্রান্তেই প্রকৃত মুসলমান থাকুক তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। আবার কোন মুসলমানের আনন্দের খবরে প্রকৃত মুসলমান পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক সেও উল্লসিত হয়।
অন্যদিকে আল্লাহ সকল মুসলমান কে একত্র হতে এবং বিচ্ছিন্ন না হতে নির্দেশ দিয়ে বলেন
وَ اعۡتَصِمُوۡا بِحَبۡلِ اللّٰهِ جَمِیۡعًا وَّ لَا تَفَرَّقُوۡا ۪ وَ اذۡكُرُوۡا نِعۡمَتَ اللّٰهِ عَلَیۡكُمۡ اِذۡ كُنۡتُمۡ اَعۡدَآءً فَاَلَّفَ بَیۡنَ قُلُوۡبِكُمۡ فَاَصۡبَحۡتُمۡ بِنِعۡمَتِهٖۤ اِخۡوَانًا ۚ وَ كُنۡتُمۡ عَلٰی شَفَا حُفۡرَۃٍ مِّنَ النَّارِ فَاَنۡقَذَكُمۡ مِّنۡهَا ؕ كَذٰلِكَ یُبَیِّنُ اللّٰهُ لَكُمۡ اٰیٰتِهٖ لَعَلَّكُمۡ تَهۡتَدُوۡنَ ﴿۱۰۳﴾
‘আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং বিভক্ত হয়ো না। আর তোমরা তোমাদের উপর আল্লাহর নিয়ামতকে স্মরণ কর, যখন তোমরা পরস্পরে শত্রু ছিলে। তারপর আল্লাহ তোমাদের অন্তরে ভালবাসার সঞ্চার করেছেন। অতঃপর তাঁর অনুগ্রহে তোমরা ভাই-ভাই হয়ে গেল। আর তোমরা ছিলে আগুনের গর্তের কিনারায়, অতঃপর তিনি তোমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করেছেন। এভাবেই আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ বয়ান করেন, যাতে তোমরা হিদায়াতপ্রাপ্ত হও। ‘ (সূরা আল-ইমরান-১০৩)
ইসলাম উদার ও মানবিকতাসম্পন্ন পূর্ণাঙ্গ দ্বীন। কোনোরূপ সংকীর্ণতা বা বাড়াবাড়ির জায়গা ইসলামে নেই। মানব জাতির বৃহত্তর কল্যাণের নিমিত্তে ইসলামের আগমন। অন্ধকার ও জাহালত থেকে মুক্ত করে মানব জাতিকে সত্যের দিশা দিতে মহামহিম আল্লাহ ইসলামকে নির্বাচন করেছেন। আল্লাহ বলেন,
وَ جَاهِدُوۡا فِی اللّٰهِ حَقَّ جِهَادِهٖ ؕ هُوَ اجۡتَبٰىكُمۡ وَ مَا جَعَلَ عَلَیۡكُمۡ فِی الدِّیۡنِ مِنۡ حَرَجٍ ؕ مِلَّۃَ اَبِیۡكُمۡ اِبۡرٰهِیۡمَ ؕ هُوَ سَمّٰىكُمُ الۡمُسۡلِمِیۡنَ ۬ۙ مِنۡ قَبۡلُ وَ فِیۡ هٰذَا لِیَكُوۡنَ الرَّسُوۡلُ شَهِیۡدًا عَلَیۡكُمۡ وَ تَكُوۡنُوۡا شُهَدَآءَ عَلَی النَّاسِ ۚۖ فَاَقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ وَ اٰتُوا الزَّكٰوۃَ وَ اعۡتَصِمُوۡا بِاللّٰهِ ؕ هُوَ مَوۡلٰىكُمۡ ۚ فَنِعۡمَ الۡمَوۡلٰی وَ نِعۡمَ النَّصِیۡرُ ﴿۷۸﴾
‘আর তোমরা আল্লাহর পথে জিহাদ কর যেভাবে জিহাদ করা উচিৎ। তিনি তোমাদেরকে মনোনীত করেছেন। দীনের ব্যাপারে তিনি তোমাদের উপর কোন কঠোরতা আরোপ করেননি। এটা তোমাদের পিতা ইবরাহীমের দীন। তিনিই তোমাদের নাম রেখেছেন ‘মুসলিম’ পূর্বে এবং এ কিতাবেও। যাতে রাসূল তোমাদের জন্য সাক্ষী হয় আর তোমরা মানুষের জন্য সাক্ষী হও। অতএব তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত দাও এবং আল্লাহকে মজবুতভাবে ধর। তিনিই তোমাদের অভিভাবক। আর তিনি কতই না উত্তম অভিভাবক এবং কতই না উত্তম সাহায্যকারী!’ (সুরা হজ, আয়াত ৭৮)
ইসলাম সংকীর্ণ নয় বরং বিশ্বজনীন। সুতরাং বর্তমান পৃথিবীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সামরিক, শিয়া, সুন্নী, হানাফী, শাফেয়ী, ইন্ডিয়া, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইরাক, ইরান, যুক্তরাষ্ট্র, সাউদি আরাবিয়া ইত্যাদি সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী সীমানা ভুলে গিয়ে আমরা কি সারা বিশ্বে একই দিনে আরাফা দিবসের সিয়াম, ঈদ, রমদানুল মুবারকসহ সকল ধরনের ইবাদত বন্দেগী একভাবে পালন করতে পারিনা?
এমফিল গবেষক (এবিডি)
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়