রংপুরের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত সম্প্রতি এক বিতর্কিত ঘটনা নিয়ে আলোচিত হয়ে উঠেছে, যেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠেছে। এই ঘটনাটি গত কিছুদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সংবাদ মাধ্যম এবং স্থানীয় রাজনীতিতে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। তবে, বর্তমানে জমির মালিক আজহারুল ইসলাম ভূঁইয়া তাঁর পক্ষে সংবাদ সম্মেলন করে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। তিনি দাবী করেছেন যে, তাঁর জমি দখল হয়ে গেছে এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা এ বিষয়টি নিয়ে সরেজমিন তদন্ত করতে আসেন, যেখানে কিছু পরিস্থিতি মিথ্যা ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
আজহারুল ইসলাম ভূঁইয়া রংপুর নগরের কেরানিপাড়ার বাসিন্দা এবং তাঁর দাবি অনুসারে গঙ্গাচড়ার পূর্ব খলেয়া মৌজায় তাঁর ৪ একর ৫৯ শতাংশ জমি রয়েছে। ২০১৯ সালে, তাঁর ভাই আতিকুল ইসলাম ও মঞ্জুরুল ইসলাম গংরা জাল রিটের মাধ্যমে ওই জমি দখল করে নেয়। এর বিরুদ্ধে তিনি আদালতে মামলা করেন এবং সিআইডি তদন্তে প্রমাণিত হয় যে, এটি একটি জালিয়াতি ছিল। যদিও জমির দখল অব্যাহত ছিল এবং সেখান থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছিল, আজহারুল ইসলাম তা প্রতিরোধের জন্য প্রশাসনে বারবার অভিযোগ করেন, কিন্তু কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
এই পরিস্থিতিতে, আজহারুল ইসলাম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে সাহায্যের জন্য অনুরোধ করেন। তিনি দাবী করেন যে, ওই আন্দোলনের নেতারা ঘটনাস্থলে গিয়ে সত্যতা যাচাই করেন এবং প্রলোভন ছাড়া পরিস্থিতি ত্যাগ করেন। তবে পরবর্তীতে কিছু অসত্য ভিডিও এবং অপ্রচার তাঁকে এবং ওই ছাত্র আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
গত শনিবার একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে তা রংপুরের রাজনীতি ও সমাজে নতুন করে আলোচনার সৃষ্টি করে। ভিডিওতে দেখা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রংপুর মহানগরের মুখপাত্র নাহিদ হাসান খন্দকার এক ব্যক্তির সাথে টাকা নিয়ে দরকষাকষি করছেন। এই ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ার পর চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠে, এবং নাহিদ হাসান খন্দকারকে সংগঠন থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়।
নাহিদ হাসান এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং বলেছেন যে, এই ভিডিওটি যুবলীগের একটি অংশ সাজিয়েছে, যাতে তাঁকে এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়। তিনি দাবি করেন, তিনি কখনও অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন না এবং এটি একটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র।
এই ঘটনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো রাজনৈতিক প্রভাব। আজহারুল ইসলাম ভূঁইয়ার জমি দখল এবং অবৈধ বালু উত্তোলন নিয়ে অভিযোগ রয়েছে, এবং তিনি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন যে, তাঁর ভাইয়েরা রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে অবৈধ বালু উত্তোলন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন এবং প্রশাসনও যথাযথ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এসব অভিযোগ তুলে এনে তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের কাছে সাহায্য চান, কিন্তু তারপরেই তাঁরা এই ধরনের বিতর্কিত পরিস্থিতিতে জড়িয়ে পড়েন।
এটি সমাজের একটি বড় ধরনের প্রভাব সৃষ্টি করে, যেখানে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক প্রভাবের মধ্যে সম্পর্ক এবং তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার কতটা গভীর এবং তা সমাজে কী ধরনের ক্ষতি ডেকে আনে, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ভিডিওটি, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, তা সম্পর্কে একাধিক পক্ষে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ইকোপার্কের পরিচালক বেলাল হোসেন দাবি করেছেন, তিনি জেলা প্রশাসককে ভয় দেখানো, চাঁদা দাবি করা এবং ভিডিওটি তোলার ঘটনা সম্পর্কে স্পষ্ট কথা বলেছেন। তবে, ভিডিওটি ফেসবুকে ছড়িয়ে না দেওয়ার দাবি করেছেন তিনি। অন্যদিকে, নাহিদ হাসান জানিয়েছেন, তিনি কখনও চাঁদা দাবি করেননি এবং এটি একটি ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছু নয়।
এই ভিডিওটি সমাজের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। একদিকে, যারা চাঁদাবাজির অভিযোগ করছেন তারা এই ভিডিওকে একটি প্রমাণ হিসেবে দেখছেন, অন্যদিকে নাহিদ হাসান ও তার সমর্থকরা এটি মিথ্যা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, যেটি সাধারণত ছাত্র সমাজের অধিকার রক্ষা এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে, তারও একটি স্পষ্ট অবস্থান রয়েছে। সংগঠনটি বলেছে যে, তারা কোনও প্রকার অবৈধ কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দেয় না এবং এই ধরনের ঘটনা তাদের মূল্যবোধের সঙ্গে সম্পূর্ণ অসঙ্গতিপূর্ণ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব থেকে নাহিদ হাসানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে, যা থেকে পরিষ্কার হয় যে, সংগঠনটি চায় এই ধরনের কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত কেউ তাদের মধ্যে না থাকুক।
এদিকে, নাহিদ হাসান এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আতিকুল ইসলাম বলেছেন যে, তিনি শিগগিরই আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এটি নিশ্চিত করে যে, এই ধরনের অভিযোগের যথাযথ তদন্ত হবে এবং যারা অভিযুক্ত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই বিষয়টি একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াতে পারে, যেখানে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে পারে এবং সেক্ষেত্রে সামাজিক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দও সেই ধরনের বিতর্কিত অবস্থায় পড়তে পারেন।
রংপুরের এই ঘটনা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি বড় পরীক্ষার সময় এসেছে। এটি তাদের প্রতিষ্ঠিত নীতিমালা এবং আদর্শের প্রতি কর্তব্য ও দায়বদ্ধতা পরীক্ষা করবে। একই সাথে, এই ঘটনা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অস্বচ্ছতা এবং তাদের প্রভাবের অপব্যবহারকে সামনে আনছে। যতই সময় এগোবে, এই অভিযোগের সঠিক তদন্ত এবং আইনগত পদক্ষেপের মাধ্যমে বিষয়টির সুরাহা আশা করা যায়।
এটি একটি স্মারক হয়ে থাকবে যে, রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে মতবিরোধ এবং ব্যক্তি বিশেষের স্বার্থ বাস্তবায়নে যে ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে, তাতে সাধারণ জনগণের মধ্যে একটি বিভ্রান্তি এবং বিশ্বাসের অভাব সৃষ্টি হয়, যা সমাজের মধ্যে অস্থিরতা ও অস্বস্তি তৈরি করতে পারে।