বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি দ্রুত উন্নয়নশীল দেশ। অর্থনীতি, অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রযুক্তি ও মানবসম্পদ খাতে ধারাবাহিক অগ্রগতি বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলছে। অনেক অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশ যথাযথ কৌশল গ্রহণ করলে ভবিষ্যতে এশিয়ার অন্যতম পরাশক্তিতে পরিণত হতে পারে। তবে ভারতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত হস্তক্ষেপ বাংলাদেশের এই সম্ভাবনাকে বারবার বাধাগ্রস্ত করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ভারতের সাথে বাংলাদেশের ভৌগোলিক ও কৌশলগত সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক বন্ধন থাকলেও, বাস্তবতায় দেখা যায় যে বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই ভারতীয় আধিপত্যের শিকার হচ্ছে। ভারতের একতরফা নীতি, কূটনৈতিক চাপ, বাণিজ্য বৈষম্য, পানি বণ্টন নিয়ে অন্যায্য আচরণ এবং সামরিক প্রভাবের কারণে বাংলাদেশকে তার স্বাভাবিক উন্নয়ন পথ থেকে সরে আসতে হচ্ছে বলে অনেক বিশ্লেষকের মত। এই প্রতিবেদনটি ভারতের বিভিন্ন হস্তক্ষেপ ও তার প্রভাব বিশ্লেষণ করবে।
অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও বাণিজ্য বৈষম্য
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে ভারসাম্যহীন। বাংলাদেশের প্রধান আমদানি উৎস ভারতের কাছ থেকে আসা পণ্য, তবে রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক কম সুবিধা পায়।
বাণিজ্য ঘাটতি ও অসম চুক্তি
- বাংলাদেশ ভারত থেকে বছরে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে, যেখানে ভারতের কাছে বাংলাদেশের রপ্তানি মাত্র ২ বিলিয়ন ডলারের মতো।
- বাংলাদেশ ভারতীয় পণ্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, যা স্থানীয় শিল্পের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
- ভারতের সাথে যেসব বাণিজ্য চুক্তি করা হয়েছে, তার বেশিরভাগই ভারতের জন্য বেশি সুবিধাজনক।
ট্রানজিট সুবিধার অসম ব্যবহার
- বাংলাদেশ ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দিলেও, ভারত বাংলাদেশকে একই ধরনের সুবিধা দেয় না।
- ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশকে ব্যবহার করা হলেও, বাংলাদেশের রপ্তানির ক্ষেত্রে ভারত বাধা সৃষ্টি করে।
- বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ভারত ব্যবহার করলেও, বাংলাদেশ তার বিনিময়ে পর্যাপ্ত বাণিজ্যিক সুবিধা পায়নি।
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও অভ্যন্তরীণ প্রভাব
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব ব্যাপক। ভারতের কূটনৈতিক ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বাংলাদেশে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
নির্বাচনী রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা
- বাংলাদেশে নির্বাচনের সময় ভারতের অবস্থান সবসময়ই বিতর্কিত।
- ভারতের কূটনৈতিক তৎপরতা ও বিশেষ সম্পর্কের কারণে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রভাবিত হয়।
- বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর ভারতের কূটনৈতিক ও গোপন সংস্থাগুলোর বিশেষ প্রভাব কাজ করে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
কূটনৈতিক চাপ ও নীতিনির্ধারণে প্রভাব
- ভারত বাংলাদেশের বিদেশ নীতিতে ব্যাপক হস্তক্ষেপ করে, বিশেষ করে চীন ও পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক নিয়ে।
- প্রতিরক্ষা, জ্বালানি, পানিবণ্টন ও সীমান্ত নীতির ক্ষেত্রে ভারত নিজের স্বার্থকে সবসময় অগ্রাধিকার দেয়।
- অনেক আন্তর্জাতিক ইস্যুতে বাংলাদেশ নিরপেক্ষ অবস্থান নিতে চাইলেও ভারতের চাপে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়।
পানি ও নদী ব্যবস্থাপনায় ভারতের একতরফা নীতি
বাংলাদেশের প্রধান নদীগুলোর অধিকাংশই ভারত থেকে প্রবাহিত। ভারত একতরফাভাবে পানি নিয়ন্ত্রণ করায় বাংলাদেশের কৃষি, জীববৈচিত্র্য ও অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
তিস্তা ও অন্যান্য নদীর পানি চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়া
- তিস্তা চুক্তি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে, ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষি ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
- ভারত গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা ও অন্যান্য নদীর প্রবাহ একতরফাভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, যা বাংলাদেশের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
- বর্ষার সময় অতিরিক্ত পানি ছেড়ে বন্যা সৃষ্টি করা এবং শুষ্ক মৌসুমে পানি আটকে রাখা ভারতের দীর্ঘদিনের নীতি।
ফারাক্কা বাঁধ ও পানি সংকট
- ভারতের ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মা নদীর পানিপ্রবাহ কমে গেছে, যার ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মরুকরণের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
- পানির অভাবে কৃষিজ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি।
সীমান্ত নিরাপত্তা ও সামরিক হস্তক্ষেপ
সীমান্ত হত্যা, সামরিক চুক্তি ও কৌশলগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতীয় আধিপত্য বাংলাদেশের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ।
সীমান্ত হত্যা ও বিএসএফের আগ্রাসন
- বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে প্রতি বছর শতাধিক বাংলাদেশিকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (BSF) হত্যা করে।
- আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বারবার নিন্দা জানালেও ভারত তার সীমান্ত নীতির পরিবর্তন করেনি।
- সীমান্ত এলাকায় অবৈধ চোরাচালান বন্ধের নামে সাধারণ নাগরিকদের লক্ষ্য করে গুলি চালানোর ঘটনা নিয়মিত ঘটে।
সামরিক চুক্তি ও নিরাপত্তা হুমকি
- ভারত বাংলাদেশকে সামরিক চুক্তির মাধ্যমে নির্ভরশীল করতে চায়, যা বাংলাদেশের কৌশলগত স্বাধীনতার পরিপন্থী।
- বাংলাদেশ যদি চীন বা তুরস্কের সাথে সামরিক সম্পর্ক বাড়াতে চায়, তবে ভারত এর বিরোধিতা করে।
- প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনার ক্ষেত্রেও ভারত চায় বাংলাদেশ যেন তার উপর নির্ভরশীল থাকে।
বাংলাদেশ কি এশিয়ার পরাশক্তি হতে পারবে?
বাংলাদেশের অর্থনীতি, অবকাঠামো ও মানবসম্পদের বিকাশের ফলে দেশটি এশিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় আসতে পারে। তবে ভারতের কৌশলগত হস্তক্ষেপ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, পানি সংকট এবং রাজনৈতিক প্রভাব বাংলাদেশকে তার সম্ভাবনার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছাতে দিচ্ছে না।
যদি বাংলাদেশ এই চ্যালেঞ্জগুলো অতিক্রম করতে চায়, তাহলে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে—
- বাণিজ্যে ভারসাম্য আনতে ভারতের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে অন্যান্য দেশের সাথে সম্পর্ক বাড়াতে হবে।
- স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি নিশ্চিত করতে কৌশলগতভাবে ভারতীয় চাপে না পড়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
- সীমান্ত হত্যা বন্ধে আন্তর্জাতিক কূটনীতির মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করতে হবে।
- পানির ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক ফোরামে ভারতকে চাপে রাখতে হবে।