কিয়েভ, ২৫ ফেব্রুয়ারি: ইউক্রেনে ইতিহাসের বৃহত্তম ড্রোন হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। শনিবার রাতে রাশিয়া একযোগে ২৬৭টি ড্রোননিক্ষেপ করে, যা ইউক্রেনের যুদ্ধে এখন পর্যন্ত একক বৃহত্তম ড্রোন হামলা বলে উল্লেখ করেছেন ইউক্রেনের বিমান বাহিনীর মুখপাত্র ইউরি ইগ্নাত।
তিনি জানান, ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ১৩৮টি ড্রোন ভূপাতিত করেছে, আর ১১৯টি ড্রোন সিগন্যাল জ্যামিংয়ের কারণে নিখোঁজ হয়ে গেছে, ফলে সেগুলো কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। যদিও অনেক হামলা প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছে, তবে বিভিন্ন অঞ্চলে হামলার কারণে অগ্নিকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনা ঘটেছে।
🔥 তৃতীয় বর্ষপূর্তির আগেই ভয়াবহ হামলা
এই হামলা এমন এক সময় হলো, যখন রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আগ্রাসনের তিন বছর পূর্তির মাত্র একদিন বাকি। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এটিকে ইরানি-নির্মিত ড্রোন ব্যবহার করে রাশিয়ার বৃহত্তম আক্রমণ বলে উল্লেখ করেছেন।
এক বিবৃতিতে জেলেনস্কি জানান, এই সপ্তাহে রাশিয়া প্রায় ১,১৫০টি আক্রমণাত্মক ড্রোন, ১,৪০০টিরও বেশি নির্ভুল নির্দেশিত বোমা এবং ৩৫টি বিভিন্ন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। তিনি বলেন, “আমাদের অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইউক্রেনের জন্য ন্যায়সঙ্গত ও স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করতে হবে।”
🇷🇺 ইরানি ড্রোনের ব্যবহার ও বিতর্ক

পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মতে, রাশিয়া ২০২২ সালের শরৎকাল থেকে ইরানি-নির্মিত ‘শাহেদ-১৩৬’ (কামিকাজে) ড্রোন ব্যবহার করছে।
প্রাথমিকভাবে এসব ড্রোন ইউক্রেনের খারকিভ অঞ্চলে সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে ব্যবহার করা হলেও, পরবর্তীতে বেসামরিক জনগোষ্ঠী এবং জ্বালানি অবকাঠামোর উপর হামলার জন্য এগুলো ব্যবহার করা হয়।
ইরান দাবি করেছে যে তারা যুদ্ধ শুরুর আগেই রাশিয়াকে ‘সংখ্যায় সীমিত’ ড্রোন সরবরাহ করেছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইরানকে নিয়মিতভাবে ড্রোন সরবরাহ করার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে।
🕊️ প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির চিত্র
এখনও পর্যন্ত সঠিকভাবে মৃত্যুর সংখ্যা জানা যায়নি, তবে ইউক্রেনের জরুরি পরিষেবার তথ্য অনুযায়ী কমপক্ষে তিনজন নিহত হয়েছেন।
- খেরসন শহরের একটি আবাসিক ভবনে হামলায় দুইজন নিহত হন, যাদের মধ্যে একজন পুরুষ এবং এক মা ছিলেন, যিনি যমজ সন্তানের মা ছিলেন।
- ক্রিভি রিহ শহরে হামলায় এক ব্যক্তি নিহত এবং অন্তত তিনজন আহত হয়েছেন।
- জাপোরিঝঝিয়া শহরে ৫৩ বছর বয়সী এক নারী আহত হয়েছেন এবং তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
- রাজধানী কিয়েভেও ব্যাপক হামলা হয়েছে, দমকল কর্মীরা একাধিক স্থানে আগুন নেভাতে কাজ করেছেন।
কিয়েভের মেয়র ভিতালি ক্লিচকো জানিয়েছেন যে, ড্রোন হামলার কারণে বেশ কিছু বাড়ি ও গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তবে এখনও পর্যন্ত সেখানে কোনও হতাহতের তথ্য পাওয়া যায়নি।
💥 রাশিয়া ও ইউক্রেনের পাল্টা হামলা
ইউক্রেনের কর্মকর্তারা জানান, ১৩টি অঞ্চলে রাশিয়ার ড্রোন হামলা প্রতিহত করা হয়েছে, যার মধ্যে খারকিভ, পোলতাভা, সুমি, কিয়েভ, চেরনিহিভ, মাইকোলাইভ ও ওডেসা অন্যতম।
এছাড়া, রাশিয়া রাতভর ইউক্রেনের উপর তিনটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রও নিক্ষেপ করেছে।
অন্যদিকে, রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দাবি করেছে যে, ইউক্রেন থেকে নিক্ষিপ্ত ২০টি ড্রোন তারা সফলভাবে ধ্বংস করেছে।
🌍 কূটনৈতিক অস্থিরতা ও ভবিষ্যৎ সংকট
সোমবার এই যুদ্ধের তৃতীয় বছর পূর্তি হবে। কিন্তু তার আগেই যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও রাশিয়ার মধ্যে কূটনৈতিক টানাপোড়েন তীব্র আকার ধারণ করেছে।
- সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া আলোচনা থেকে ইউক্রেন ও ইউরোপীয় নেতাদের বাদ দেওয়া হয়, যা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
- ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সোমবার ওয়াশিংটন সফর করবেন, যেখানে তিনি ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করবেন।
- যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমারও বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন, যেখানে তিনি ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যুক্তরাজ্যের ‘দৃঢ় সমর্থন’ ব্যক্ত করবেন।
🕊️ পোপ ফ্রান্সিসের বার্তা
এদিকে, বর্তমানে গুরুতর অসুস্থ পোপ ফ্রান্সিস এক বিবৃতিতে বলেছেন, “যুদ্ধের তৃতীয় বর্ষপূর্তি বিশ্বমানবতার জন্য লজ্জার একটি অধ্যায়।”
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তৃতীয় বছরে প্রবেশ করতে চলেছে, কিন্তু সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রা দিন দিন আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে।শনিবার রাতের হামলা এই যুদ্ধে নতুন এক ভয়ংকর মোড় নিয়ে এসেছে, যেখানে বেসামরিক মানুষ আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বিশ্বনেতারা এখন কীভাবে এই সংকট নিরসনের পথে এগোবেন, সেটাই দেখার বিষয়। তবে স্পষ্টতই, এই যুদ্ধের সমাপ্তি এখনো দিগন্তের অনেক দূরে।