সিটিটিসি-র্যাব-এটিউ এর কথিত জঙ্গি-বিরোধী লড়াই যতটুকু না আদর্শিক, তার চেয়েও বেশি রিজিকের লড়াই। কথিত জঙ্গিদমনের আড়ালে কোটি কোটি টাকার অর্থ বাণিজ্যের সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে র্যাব-সিটিটিসি।
র্যাব-পুলিশের অফিসারদের বিলাসী জীবন, বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট, দামী গাড়ি, স্ত্রীদের দামী গহনা, সন্তানদের টপ-ক্লাস স্কুল-ইউনিভার্সিটির সম্পূর্ন খরচ আসে এই কথিত জঙ্গি-খাত থেকে।
এই ইউনিটের অফিসাররা এক্সট্রা-ভার্জিন অলিভ অয়েল ছাড়া তরকারি খেতে পারেনা। নাভিশ্বাস তোলা দামের এই বাজারেও তাদের খাবার টেবিলে থাকে হরেক পদের তরকারি। সবসময়ই লেটেষ্ট আইফোন থাকে তাদের পকেটে। নিজ ও পরিবারের সদস্যদের নাম একাধিক জমি, গাড়ি এবং দেশে বিদেশে বহু যায়গায় বাড়ি রয়েছে।
কিন্তু পে-স্কেলের দিকে তাকালে এই হিসেব মিলতে চায়না। আমরা হিসেব মেলানোর জন্য একটু গভীরে যেতে চাই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন পুলিশ কর্মকর্তা গল্পের ছলে আমাকে জানিয়েছিলেন “ভাই, প্রতিমাসে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে গ্রেফতারের টার্গেট দেওয়া হয় আমাদেরকে। যেমন শিবিরের ১০ জন, হিযবুত তাহরীরের ২ জন, বিএনপির ৬ জন, চাঁদাবাজ ২ জন, ছিনতাই ২ জন ইত্যাদি কোটা থাকে। কেবল প্রমোশন ও বোনাসের লোভে নয়, বরং জবাবদিহীতা থেকে বাঁচতে হলেও এই টার্গেট আমাদের পুরন করতে হয়।”
এই বিপুল সংখ্যক আটককৃতদের বেশিরভাগকেই আদালত পর্যন্ত গড়াতে হয়না। গুম থেকে শুরু করে মামলার আসামী বানানো, রিমান্ড আবেদন, জামিন এমনকি তদন্ত প্রতিবেদন জমা পর্যন্ত সকল খাতে সুনির্দিষ্ট পরিমানের “খরচ” রয়েছে।
বিভিন্ন অযুহাতে কথিত আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী দ্বারা কী ধরনের সম্পদ লুট হতো সেটা তুলে ধরছি।
১। গুমের সময় ভুক্তভোগীর মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ট্যাবসহ ডিজিটাল ডিভাইস জব্দ করা হতো। তবে এগুলোর কোনোটাই জব্দতালিকায় স্থান পেতোনা। এসব জব্দকৃত সম্পদ আদালতে সোর্পদ করাও হতোনা, ফলে পরবর্তীতেও এগুলো ফেরত পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। এই জিনিসগুলোর ভাগ সাধারনত কনস্টবল, নায়েক, এএসআইরা পেতো।
২। গুম থাকাবস্থায় ব্যবসায়ী ও ধনী ব্যক্তিদের থেকে অভিনব কায়দায় হাতিয়ে নেওয়া হতো টাকা। ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে করা হতো চাঁদাবাজি। এই রেট ৪০ লাখ থেকে কয়েক কোটি টাকা পর্যন্ত। এছাড়াও রাজনৈতিক ও ব্যাবসায়িক প্রতিপক্ষকে “ক্রসফায়ার” দেওয়ার জন্য ভাড়াতে খুনির কাজ করতো র্যাব।
এই টাকা পেত কমান্ডিং অফিসাররা ও অন্যান্য সদস্যরা। নারায়নগঞ্জের সাত খুন মামলায় অভিযুক্ত র্যাব কর্মকর্তাদের নূর হোসেন প্রতি মাসে ১০ লাখ টাকা দিতো যা আদালতে প্রমাণিত। আমাদের অনুসন্ধানে র্যাব সর্বনিম্ন ৩০ হাজার টাকায় ব্যবসায়ীকে ক্রসফায়ার দিয়েছে।
৩। বন্দীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও মোবাইল ব্যাংকিং সেবার তথ্য নিয়ে সেখান থেকেও টাকা তুলে ফেলা হতো। এক বন্দীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে জমি বিক্রয়ের জমাকৃত কয়েক লাখ টাকা আত্মসাৎ করে ডিবি। বন্দীকে সাথে করে নিয়ে “অভিযান” এর নামে বের হয়ে বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে পরিবারের সদস্যদের স্মার্ট ফোন, ক্যাশ টাকা এমনকি পছন্দের দামী আসবাব নিয়ে আসতো তারা। এক বন্দীর বাসায় হামলা চালিয়ে টেবিলে থাকা কলমও চুরি করেছে বলে জানা গেছে।
৪। মামলা দেওয়ার ক্ষেতেও বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে আলাদা আলাদা রেট রয়েছে। রেট নির্ভর করতো কী ধরনের মামলা দেওয়া হবে সেটার উপরও। ৫৪ বা সন্দেহবশত গ্রেফতারের মামলার ক্ষেত্রে ২৫ লাখ, সাধারন হত্যা মামলার জন্য ১০ লাখ, অস্ত্র আইনে মামলার জন্য ৭ লাখ ইত্যাদি। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে বা সামর্থ্য না থাকলে সন্ত্রাস বিরোধী আইন অথবা বিষ্ফোরক আইনে মামলা দেওয়া হতো। রাজনৈতিক পরিচয় থাকলে ভাংচুর ও ককটেল বিষ্ফোরনের মামলা দেওয়া হতো। কারও ক্ষেত্রে দেওয়া হতো ব্লগার হত্যা মামলা! এই টাকার ভাগ সাধারনত কমান্ডিং অফিসার, এসআই বা ইন্সপেক্টরা পেত।
৫। মামলা দেওয়ার পর আদালতে সোর্পদের সময় পুনরায় রিমান্ড আবেদন করা হবে কিনা সেই ডিলের রেট ভিন্ন। মামলাভেদে এই রেট ৫০০০০ থেকে শুরু করে ১০ লাখ পর্যন্ত। অফিসারদের বাসায় এই টাকা পৌঁছে দিতে হতো। ফলে আদালতে সোর্পদের দিন তারা নতুন করে রিমান্ডের আবেদন করতোনা।
৬। শেখ হাসিনার আমলে রিমান্ড আবেদনের শুনানি খোলা আদালতে হলেও মঞ্জুর করা হতো গোপনে। গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে রিমান্ড মঞ্জুরের আদেশ নিয়ে আসতো এবং সেই আদেশ বলেই যেকোন মামলায় ইচ্ছামত রিমান্ড মঞ্জুর করিয়ে নিতো।
৭। রিমান্ড মঞ্জুর হওয়ার পর চলতো আরেক দফা বাণিজ্য। রিমান্ডে বন্দীকে টর্চার করা হবে কি না সে জন্য নেওয়া হতো আলাদা টাকা। তাদের ভাষায় এটা “রিমান্ড কাটানোর খরচ”। এই ক্যাটাগরিতেই সবচেয়ে বেশি অর্থ বাণিজ্য হয়েছে। ৫ হাজার থেকে শুরু করে ৫০ লাখ পর্যন্ত যার কাছ থেকে যেমন পেয়েছে তারা নিয়েছে। রিমান্ডে মারধর না করার শর্তে টাকা নেয়নি এমন কোন নজির নেই।
৮। বন্দির পক্ষে আদালতে জামিন আবেদন করলে পাবলিক প্রসিকিউটর আপত্তি জানাবে নাকি জানাবেনা সেটার জন্যও ছিলো আলাদা ডিল। আবার জামিন মঞ্জুর হবে কি হবেনা সেটার জন্যও “পেশকার” এর মাধ্যমে বিচারকের সাথে চুক্তি করা হতো। চুক্তির অর্ধেক টাকা জামিনের পূর্বে ও বাঁকি অর্ধেক জামিন মঞ্জুরের পর দিতে হতো। এই অর্থের পুরোটাই পেত প্রসিকিউটর, পেশকার ও বিচারক। যেসব বিচারক এসবে রাজি হতোনা তাদের আজীবন নিম্ন আদালতেই কাটাতে হতো।
৯। জামিনের পরও ভোগান্তি পোহাতে হতো অনেককে। জামিনের আদেশ কারাগারে পৌঁছানোর সাথে সাথে স্পেশাল ব্রাঞ্চের গোয়েন্দা সংস্থাদের জানাতে হতো, গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন কারাফটক থেকেই আবার বন্দিকে গুম করে ফেলতো। আর এই ন্যাক্কারজনক কাজ সরাসরি সাব-জেলার, জেলার বা জেল সুপার করে থাকে। কিন্তু পূর্বেই চুক্তি করে নিলে এই ঝামেলা থেকে রেহাই পাওয়া যেত। অর্ধেক টাকা জামিনের কাগজ হাতে পেয়ে দিতে হতো, বাঁকি অর্ধেক দিতে হতো কারা ফটক থেকে বের হওয়ার পর। এই রেট ব্যক্তি ও মামলা ভেদে একেকরকম, যা পুরোটাই সাবজেলার, জেলার ও সুপারের পকেটে উঠতো।
১০। আবার গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন পুনরায় গ্রেফতার করতো এই টাকার জন্যই। উপস্থিত সদস্যের সাথে চুক্তি করে তবেই বাড়ি ফেরা সম্ভব হতো। যারা টাকা দিতে পারতোনা বা দিতে অস্বীকৃতি জানাতো তাদের ভোগান্তি শেষ ছিলোনা। তাদের পুনরায় গুম করে অথবা মামলা দিয়ে কারাগারে প্রেরণ করা হতো। এবং শুরু থেকে প্রতিটি ক্যাটাগরিতে অর্থ বাণিজ্যের দ্বার উন্মোচিত হতো।
উপরের উল্লেক্ষিত খাত ছাড়াও আরও অনেক খাতে ভুক্তভোগীকে টাকা দিতে হতো। জামিনের কাগজ দ্রুত কারাগারে প্রেরণ, এজাহার, এফআইআর ও তদন্ত প্রতিবেদনে নাম না রাখা, “জব্দ তালিকা”য় কোন “নিষিদ্ধ বই” অথবা “অস্ত্র” না দেখানো ইত্যাদি নানা খাতে টাকা নেওয়া হতো।
গুম খুন মামলাগুলোর জন্য কথিত শান্তিপ্রিয় উন্নত দেশগুলো থেকে বিশাল ফান্ড আসত। “ওয়ার অন টেরর” এর ব্যানারে এই ফান্ডের ধারা অব্যহত রাখতে র্যাব-সিটিটিসি নিয়মিত এই নাটক চালিয়ে গেছে। কিন্তু ২০২০ সালে সারা বিশ্বব্যাপী ইউএসএ ওয়ার অন টেররের বয়ান থেকে সরে এসে ফান্ডিং বন্ধ করে দেয়, তখন থেকে এদেশেও এর ধারাবাহিকতা তলানিতে নেমে আসে।
একজন বন্দির পুরো প্রিজন-লাইফসাইকেলে গড়ে আনুমানিক ১৫/২০ লাখ হাতিয়ে নিতো গুমের সাথে জড়িত ব্যক্তিরা, আর এই টাকা মামলা পরিচালনার খরচের বাইরের হিসাব। ফলে রাতারাতি তারা অনেক টাকার মালিক বনে গেছে। এমন লাভজনক ব্যবসা ছেড়ে তারা অন্য ইউনিটে যেতে চাইতোনা। মোটা অংকের টাকায় ট্রান্সফার এমনকি “অন্য ইউনিটে প্রমোশন” পর্যন্ত আটকে দিতো নিজেদের।
পুরো সিন্ডিকেটের ভাঁজে ভাঁজে ঘাপটি মেরে বসে থাকা ব্যক্তিরা কখনোই চাইবেনা এই দেশে গুমের সংস্কৃতি পুরোপুরি বন্ধ হোক। কারন দেশে গুম বন্ধ হওয়া মানে তাদের পেটে লাথি পড়া। আগের লাইফস্টাইল মেইনটেইন করা বর্তমানে কঠিন হয়ে পড়েছে। রাস্তাঘাটে গোয়েন্দা বাহিনীর লোকেরা এখন আর আগের মত সাদা ধবধবে ইস্ত্রি করা শার্ট পরে ঘুরে বেড়ায়না।
ফ্যাসিজমের মানসকন্যা শেখ হাসিনা পলায়নের পর সরকারি বাহিনীর মধ্যে সর্বপ্রথম কর্মবিরতি দেয় পুলিশ। আর নিজেদের অপরাধ লুকিয়ে “অভ্যুত্থানের পক্ষে ছিলাম” বলে দাবী করে র্যাব। এরপর পোষাক পরিবর্তন, অরাজনৈতিকরণ, বেতন বৃদ্ধিসহ ইত্যাদি নানা দফা দাবী নিয়ে হাজির হয় তারা।
আমরা যখনই আয়নাঘরের তথ্যগুলো প্রকাশ করতে শুরু করি তখনই তারা নানান ঘটনা ঘটিয়ে আমাদের লক্ষ্যবিচ্যুত করার চেষ্টা করে। পুলিশ-র্যাব থেকে শুরু করে আইনজীবী, বিচারক, কারা কর্তৃপক্ষের সিন্ডিকেট আয়নাঘরে গুমের ঘটনা কৌশলে এড়ানোর নানা ফন্দি এঁটেছে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তে সবার নাম বেরিয়ে আসবে এই ভয়েই তারা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিগত ছয় মাস যাবৎ প্রধান উপদেষ্টাকে আয়নাঘর পরিদর্শনে বাধা দিয়েছে তারা। আয়নাঘরের পার্টিশন ভেঙ্গেছে, পরিষ্কার করে, রং করে এরপর মাত্র কিছু অংশ সামনে আসতে দিয়েছে। ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে মূল হোতারা। এদের মুখোশ আমাদেরই উন্মোচন করতে হবে। সকলের কাছে ছড়িয়ে দিতে হবে যেন তাদের সকল ষড়যন্ত্র ভেস্তে যায়।
©জাফ্রান হাসান