উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী, এমপি ও প্রার্থিরা চালাচ্ছেন আচরণবিধি লঙ্ঘনের মহোৎসব
উপজেলা নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণার শুরুতেই আচরণবিধি লঙ্ঘনের মহোৎসব শুরু হয়েছে। বিধি মানছেন না কেউই। অনেক উপজেলায় এমপিদের বিরুদ্ধেও আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। মন্ত্রীর ছেলে বা আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধেও উঠেছে বিধিলঙ্ঘনের অভিযোগ। বিভিন্ন স্থানে সম্ভাব্য প্রার্থীদের হয়রানি করার অভিযোগ তো আছেই। সাবেক এক জন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারকে প্রার্থী না হতে থানায় তলবের ঘটনাও ঘটেছে। বাধ্য হয়ে অনেক প্রার্থী নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কাছে এমপিদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
ইসি থেকে বারবার বিধি মেনে প্রচারণার কথা বলা হলেও প্রভাবশালীরা তা একের পর এক অবজ্ঞা করে চলেছেন। ভোটারদের মন জয় করার পরিবর্তে পুলিশ প্রশাসন ও মাঠ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে মরিয়া প্রভাবশালীরা। বীর মুক্তিযোদ্ধাকে থানায় ডেকে ওসির হুমকি: সম্প্রতি একটি উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধাকে থানায় তলব করেন ওসি। এ বিষয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা বিস্ময় প্রকাশ করে জানান, থানায় গেলে ওসি আমাকে বলেন, ‘আমার বাবাও (ওসির) মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আপনি এখন বয়স্ক মানুষ। ঝামেলার দরকার কি। সামনে ইলেকশন, সেহেতু আপনি বয়স্ক মানুষ নিরিবিলি থাকাই ভালো।’
এ সময় ঊধ্বর্তন পুলিশ কর্মকর্তা এ খবরটি শোনার পর ওসিকে ফোন দিলে তিনি (ওসি) তাকে বলেন, ‘তেমন কিছু না স্যার একটু চায়ের দাওয়াত দিয়েছি।’ পরে থানা থেকে বেরিয়ে ঐ মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘আজকের দিনটি দেখার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না।’ তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন এবং অত্যন্ত স্নেহ করেন। কিন্তু আফসোস এই শেষ বয়সে এসে এই দিন দেখতে হলো! এখন আমায় ঢাকায় থাকতে হচ্ছে? একই এলাকায় ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছে পোষণ করায় উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতাকে মারধর করা হয়েছে। তাছাড়াও আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মহিলা পদে প্রার্থী হওয়ার জন্য জামানতের টাকা জমা দিতে গেলে তাকে মারধর করে কাগজপত্র ছিনিয়ে নিয়ে গেছে একদল সন্ত্রাসী।’
কয়েকজন এমপির বিরুদ্ধে অভিযোগ: উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনি প্রচারণায় অভিযোগ উঠেছে রেলমন্ত্রী জিল্লুর হাকিমের পুত্র আশিক মাহমুদ মিতুল হাকিমের বিরুদ্ধে। বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান ও প্রার্থী মো. ফরিদ হাসান ওদুদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বরাবর মন্ত্রীপুত্রের অবৈধ প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগে তিনি বলেন, মন্ত্রীপুত্র বিভিন্ন জনসভায় প্রকাশ্য আমাকে ও আমার কর্মী-সমর্থকদের হত্যা ও দেখে নেওয়ার হুমকি প্রদান করেছেন। অভিযোগ এসেছে শেরপুর-৩ (শ্রীবরদী-ঝিনাইগাতী) আসনের সংসদ সদস্য এ ডি এম শহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে।
ঐ উপজেলার অন্য চেয়ারম্যান প্রার্থীদের অভিযোগ—সংসদ সদস্য এ ডি এম শহিদুল ইসলাম দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে ঝিনাইগাতী উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শ্রী বিশ্বজিত্ রায়ের পক্ষে নির্বাচনি প্রচারণা চালিয়ে আসছেন। চাঁদপুরের মতলব উপজেলা নির্বাচনে স্থানীয় সংসদ সদস্য কর্তৃক আচরণবিধি লঙ্ঘন করে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ ইসিতে দেওয়া হয়েছে। সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে চেয়ারম্যান প্রার্থী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খলিলুর রহমানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী কাজী শুভ রহমান চৌধুরীকে ব্যাখ্যা দিতে বলেছে রিটার্নিং অফিসার। কাজী শুভ রহমান চৌধুরী ঘোড়াঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য এবং সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান।
কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বী ফজলুল করিমের পক্ষে তাকে নিয়ে কক্সবাজার-১ আসনের সংসদ সদস্য সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান ও সভায় সরাসরি ভোট চাওয়ার অভিযোগ করেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী জাফর আলম। সংশ্লিষ্টদের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন তিনি। নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে জাতীয় পার্টি (জাপা) নেতা ও চেয়ারম্যান প্রার্থী মাকসুদ হোসেনকে শোকজ করেছে জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা। নেত্রকোনার দুর্গাপুরে ওসির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলেছেন সাত জন চেয়ারম্যান প্রার্থীর মধ্যে ছয় জনই। গত শনিবার এ নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বরাবর এক লিখিত অভিযোগ দিয়েছে তারা।
কুমিল্লার নাঙ্গলকোট পৌরসভার মেয়র আব্দুল মালেকের বিরুদ্ধে নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ জমা পড়েছে রিটার্নিং অফিসারের কাছে। এদিকে জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর এজেন্ট কেন্দ্রে ঢুকলে হাত, দাঁত ও চাপার হাড্ডি ভেঙে যমুনা নদীতে নিক্ষেপের হুমকিদাতা আওয়ামী লীগের দুই নেতাকে আটক করেছে ডিবি পুলিশ। এছাড়াও উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী রফিকুল ইসলামকে (আনারস প্রতীক) শোকজ করেছেন নির্বাচন কর্মকর্তা।
টাঙ্গাইলের গোপালপুরে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী মারা যাওয়ায় উপজেলা পরিষদ নির্বাচন স্থগিত করেছে ইসি। আগামী ৮ মে গোপালপুর উপজেলার ভোট হওয়ার কথা ছিল। গতকাল রবিবার নির্বাচন কমিশনের উপসচিব মো. আতিয়ার রহমান স্বাক্ষরিত চিঠিতে গোপালপুর উপজেলা পরিষদের সব পদের নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করা হয়।
গোপালপুর উপজেলা পরিষদের বর্তমান মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মরিয়ম আখতার মুক্তা এবারও প্রার্থী হয়েছিলেন। গত শুক্রবার তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে দ্রুত তাকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। তিনি আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর এবং সাবেক এমপি হাতেম আলী তালুকদারের নাতনি।