দেশে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে ক্যানসারের রোগী। বর্তমানে প্রতি লাখে ১০৬ জন মানুষ ভুগছেন দীর্ঘস্থায়ী এই জটিল রোগে। এমনকি দেশের মোট মৃত্যুর ১২ শতাংশই ক্যানসারে। আক্রান্তদের বেশিরভাগই নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ। দেশের বিশেষায়িত একমাত্র ক্যানসার হাসপাতাল ছাড়াও বিভাগীয় মেডিকেলে আলাদা বিভাগ থাকলেও রোগীর তুলনায় অপ্রতুল। ফলে বড় অংশ চলে যান দেশের বাইরে।
বাংলাদেশে প্রচলিত ব্যবস্থায় ক্যানসার ডায়াগনোসিস ও চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এক্ষেত্রে ইউরোপসহ উন্নত দেশগুলোর ন্যায় প্রেসিশন মেডিসিনের অংশ থেরানস্টিক্সের মাধ্যমে ক্যানসার চিকিৎসায় বিপ্লব ঘটানো সম্ভব বলে জানিয়েছেন জাপানের প্রখ্যাত গবেষক ডা. শুইচি শিরাতোরি। তিনি জানিয়েছেন, ‘এই পদ্ধতিতে ক্যানসার সঠিক জায়গায় সঠিকভাবে নির্ণয় সম্ভব। একই সঙ্গে চিকিৎসায় পূর্ণাঙ্গভাবে সুস্থ হওয়া সম্ভব।’
বৃহস্পতিবার দুপুরে গুলশানে আমার দেশের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। সাক্ষৎকার নিয়েছেন স্টাফ রিপোর্টার আজাদুল আদনান।
ডা. শিরাতোরি জাপান এবং থাইল্যান্ডে ২০ বছর ধরে ক্যানসার থেরাপি নিয়ে কাজ করছেন। বর্তমানে থাইল্যান্ডের সরকারি প্রতিষ্ঠান সিরিরাজ হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সরকার চাইলে বাংলাদেশের চিকিৎসকদের এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা জানিয়েছেন এই চিকিৎসা বিজ্ঞানী।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করেছেন ডা. শিরাতোরি। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত চতুর্থ আন্তর্জাতিক মেডিকেল ফিজিক্স ইন রেডিয়েশন অনকোলজি অ্যান্ড ইমেজিং কনফারেন্স-এর মূল বক্তা ছিলেন। এ সময় তিনি ক্যানসার চিকিৎসায় পারমাণবিক চিকিৎসা ও থেরানস্টিক্সের রূপান্তরকারী সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন।
ডা. শিরাতোরি বলেন, ‘থেরানস্টিক্স হলো একটি উদ্ভাবনী পদ্ধতি যা ডায়াগনস্টিক ইমেজিং এবং টার্গেটেড থেরাপিকে রেডিও ফার্মাসিউটিক্যালস ব্যবহার করে একত্রিত করে। থেরানস্টিক্সের প্রাথমিক লক্ষ্য ক্যানসার কোষগুলোকে সুনির্দিষ্টভাবে লক্ষ্য করে ধ্বংস করা এবং সুস্থ টিস্যুগুলোর ক্ষতি কমিয়ে আনা। ইমেজিংয়ের মাধ্যমে ক্যানসার বায়োমার্কারগুলো চিহ্নিত করে, থেরানস্টিক্স বিকিরণ থেরাপির সঠিক প্রয়োগের অনুমতি দেয়, যা কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসহ আরও কার্যকর চিকিৎসা ফলাফলের দিকে নিয়ে যায়।
ক্যানসার চিকিৎসায় প্রেসিশন মেডিসিনের প্রভাব কেমন জানতে চাইলে ডা. শিরাতোরি বলেন, ক্যানসার চিকিৎসায় বিপ্লব ঘটিয়েছে প্রেসিশন মেডিসিন। কারণ এটি রোগীর জেনেটিক এবং আণবিক প্রোফাইলের ভিত্তিতে চিকিৎসাকে মানানসই করে। এই পদ্ধতি শুধুমাত্র থেরাপির কার্যকারিতা বাড়ায় না, বরং প্রতিকূল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো কমিয়ে আনে। বিশেষ করে প্রোস্টেট ক্যানসার চিকিৎসায় অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছে।’
প্রেসিশন মেডিসিন ও থেরানস্টিক্স বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও, প্রেসিশন মেডিসিন ও থেরানস্টিক্স গ্রহণের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে উচ্চ খরচ, সীমিত অবকাঠামো এবং বিশেষায়িত প্রশিক্ষণের অভাব। নিয়ন্ত্রণমূলক বাধা এবং গুণগত মান নিয়ন্ত্রণও উল্লেখযোগ্য বাধা সৃষ্টি করে। তবে ডা. শিরাতোরি বিশ্বাস করেন যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, বিশেষ করে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সির মতো সংস্থাগুলোর সাথে সহযোগিতার মাধ্যমে বাধাগুলো দূর করা সম্ভব।’
ক্যানসার চিকিৎসার ভবিষ্যৎ বদলে যাবে এমন আশার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘থেরানস্টিক্স ভবিষ্যতে ক্যানসার ব্যবস্থাপনার জন্য একটি গেম চেঞ্জার হয়ে উঠবে। তবে তিনি স্বীকার করেন, এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য গবেষণা, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং প্রশিক্ষণে স্থায়ী বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। এই উন্নত চিকিৎসাগুলোকে আরও সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী করতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
এই পদ্ধতিতে পারমাণবিক চিকিৎসা ও প্রচলিত ক্যানসার চিকিৎসার মধ্যে বেশ ফারাক রয়েছে বলেও জানান তিনি। এই চিকিৎসক বলেন, ‘প্রচলিত ক্যানসার চিকিৎসায় সাধারণত সার্জারি, বিকিরণ এবং কেমোথেরাপি জড়িত থাকে, যা প্রায়ই উল্লেখযোগ্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং রোগীর বেঁচে থাকার অনিশ্চয়তা নিয়ে আসে। বিপরীতে, পারমাণবিক চিকিৎসায় থেরানস্টিক্স টার্গেটেড রেডিওফার্মাসিউটিক্যালস ব্যবহার করে ক্যানসার কোষগুলোকে সুনির্দিষ্টভাবে লক্ষ্য করে, সুস্থ কোষকে অক্ষত রাখে। এই পদ্ধতি শুধুমাত্র চিকিৎসার কার্যকারিতা উন্নত করে না, বরং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও হ্রাস করে, রোগীদের একটি উন্নত জীবনযাত্রার মান প্রদান করে।’
থেরানস্টিক্সের বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে জানতে চাইলে অভিজ্ঞ এই চিকিৎসক ও গবেষক বলেন, ‘থেরানস্টিক্স বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ায় ইতিমধ্যেই স্বীকৃত এটি। থাইল্যান্ড ইতিমধ্যেই এটি স্বীকৃত ক্যানসার চিকিৎসায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।
বাংলাদেশে থেরানস্টিক্স ও এর সম্ভাবনার কথা জানতে চাইলে ডা. শিরাতোরি বলেন, ‘বাংলাদেশে পারমাণবিক চিকিৎসা ও থেরানস্টিক্সের মাধ্যমে ক্যানসার চিকিৎসার রূপান্তরের সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও দেশের স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো শক্তিশালী তারপরও সাফল্যের চাবিকাঠি হলো স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারদের মানসিকতা পরিবর্তন করা এবং তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান। থেরানস্টিক্সে ইতিমধ্যেই অভিজ্ঞ দেশগুলোর সাথে সহযোগিতা এই উন্নত চিকিৎসা বাংলাদেশে আনার ক্ষেত্রে অপরিহার্য হবে।’
সাশ্রয়ী মূল্য নিয়ে কিছুটা সংশয় প্রকাশ করে ডা. শিরাতোরি বলেন, ‘যদিও থেরানস্টিক্সের প্রাথমিক খরচ বেশি হতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদী সুবিধা বিবেচনায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হ্রাস এবং উন্নত বেঁচে থাকার হারের কারণে এটি ব্যয়-সাশ্রয়ী হিসেবে কার্যকর বিকল্প হতে পারে।’
বাংলাদেশি স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারদের আহ্বান জানিয়ে ডা. শিরাতোরি বলেন, বাংলাদেশে পারমাণবিক চিকিৎসা ও থেরানস্টিক্স গ্রহণ করা উচিত। সফলভাবে এই উন্নত চিকিৎসা বাস্তবায়নের জন্য প্রশিক্ষণ, সহযোগিতা এবং ধারণার স্পষ্ট বোঝাপড়ার ওপর জোরও দেন।
ডা. শুইচি শিরাতোরির বাংলাদেশ সফর দেশটিতে অত্যাধুনিক ক্যান্সার চিকিৎসা গ্রহণের পথে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। পারমাণবিক চিকিৎসায় থেরানস্টিক্স সম্পর্কে তার অন্তর্দৃষ্টি এমন একটি ভবিষ্যতের আশা দেখায়, যেখানে ক্যান্সার রোগীরা আরও কার্যকর, ব্যক্তিগতকৃত এবং অ-আক্রমণাত্মক চিকিৎসা পেতে পারেন। অব্যাহত বিনিয়োগ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে, বাংলাদেশ এই অঞ্চলে পারমাণবিক চিকিৎসা ও থেরানস্টিক্সের ক্ষেত্রে নেতা হয়ে উঠতে পারে।