ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার হিসাবে যোগদান করেছিলেন আফম আনোয়ার হোসেন খান। তবে যোগদানের মাত্র ৫ মাস না যেতেই অভিযোগের পাহাড় জমা পড়েছে ২৪তম বিসিএস (পুলিশ)-এর এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
চোরাচালান, অবৈধ বালু ব্যবসা, জলমহাল দখল, পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন, পুলিশের বদলি ‘বাণিজ্য’সহ ঘুসের লেনদেন রয়েছে-এমন সব অপরাধের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছেন। শুরু থেকেই অপরাধ দমনের দিকে তেমন কোনো মনোযোগ ছিল না তার। বরং আওয়ামী লীগ সরকার আমলে গড়ে ওঠা অপরাধ সাম্রাজ্য চালু রাখতেই বেশি তৎপর দেখা গেছে এই পুলিশ কর্মকর্তাকে।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবৈধ আয়ের খাত হচ্ছে-সীমান্ত চোরাচালান এবং বহুল আলোচিত জাদুকাটা ও ধোপাজান নদীর অবৈধ বালুমহাল। এছাড়া যোগদানের সাড়ে ৫ মাসেই শুধু ‘বদলি বাণিজ্য’ করেই কামিয়েছেন মোটা অঙ্কের অর্থ। এসব অপকর্মের বিভিন্ন খাত থেকে প্রতি মাসে এসপির পকেটে ঢুকছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। রীতিমতো ‘ঘুসের হাট’ সাজিয়ে বসিয়েছেন তিনি-এমন মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের।
তাদের মতে, সব অপরাধ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে তার (এসপি) সঙ্গী হিসাবে বেছে নিয়েছেন জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম, তাহিরপুরের ইউএনও আবুল হাশেম এবং বিভিন্ন থানার ওসিদের। তারা সবাই এসপির সিন্ডিকেট সদস্য হিসাবে স্থানীয়দের কাছে পরিচিত।
সরকারের একটি বিশেষ সংস্থার গোপন প্রতিবেদন বিশ্লেষণ এবং একটি জাতীয় দৈনিকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন ভয়াবহ চিত্র। পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে প্রতিবেদনটি। সেখানে মন্তব্য করা হয়, ‘পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন খান সুনামগঞ্জে যোগদানের পর জেলার চোরাচালান, নদীর অবৈধ বালু উত্তোলন, অপরাধ কর্মকাণ্ডসহ পুলিশের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। ৫ আগস্টের পর দ্বিতীয় দফায় আবার পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পুলিশের আইজি বাহারুল আলম যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি শুনেছি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। তবে অভিযোগগুলো আমার হাতে এখনো আসেনি। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে কোনো ধরনের সত্যতা পাওয়া গেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, লুটপাটের এই সাম্রাজ্যে নেতৃত্ব দিয়ে এসপি আনোয়ার হোসেন খান সীমান্তবর্তী মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এলাকার সৌন্দর্য ধ্বংস করে দিচ্ছেন। তার এমন কর্মকাণ্ডে জেলাজুড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে এক ধরনের অস্বস্তি। সুনামগঞ্জে বিগত ১৫ বছরে নিয়মিত যেসব অপরাধের সৃষ্টি হয়েছে ৫ আগস্টের পর সেগুলো সমূলে নির্মূল হওয়ার পরিবর্তে আরও বেড়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো ওই বিশেষ প্রতিবেদনের এক স্থানে বলা হয়েছে, আফম আনোয়ার হোসেন খান গত ৮ সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জের এসপি হিসাবে যোগদান করেন। এরপর থেকেই বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে জেলার বিভিন্ন থানায় ওসি পদায়ন, থানা-ফাঁড়িতে এসআই, এএসআই বদলিতে বিশেষ ক্যাশিয়ার দিয়েছেন। তারাই এসপির নামে অবৈধ টাকা তুলে আনেন। এছাড়া ওসি, এসআই পোস্টিং বাণিজ্য নিরাপদ করতে দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত যশোর এসপি অফিসে কর্মরত এক স্টেনোগ্রাফারকে সুনামগঞ্জে এনে রাখেন। তার মাধ্যমেই বিভিন্ন থানায় ওসি পদায়ন করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি।
টাকার খনি জাদুকাটা : অনুসন্ধানে জানা গেছে, নীলপানির নদীখ্যাত মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে জাদুকাটা নদীর যেখানে ইজারা দেওয়া হয়েছে সেখানে বালু উত্তোলন করে না ইজারাদার। কারণ ভারত থেকে বাংলাদেশ সীমান্তে নদীর যে মোহনা মিলেছে সেখানে পাওয়া যায় দেশের সবচেয়ে দামি বালু। তাই বালুখেকোরা জাদুকাটার এই মোহনাকে কেটে রীতিমতো হাওড়ে রূপান্তরিত করে ফেলেছে। তারপরও থেমে নেই বালুখেকোরা। নদীর বাকি যে অংশ আছে, সেসব স্থানও কেটে নিচ্ছেন তারা। সাবেক কয়েকজন জেলা প্রশাসক, এসপি, স্থানীয় তাহিরপুর নির্বাহী কর্মকর্তা ও ওসির কারণে এখন পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে নয়নাভিরাম এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। অথচ নীলপানির সান্নিধ্য পেতে প্রতিবছর কয়েক হাজার পর্যটক জাদুকাটায় ভ্রমণ করেন। আওয়ামী লীগের শাসনামলের বিগত ১৫ বছর এই নদী কেটে ক্ষতবিক্ষত করে শত শত কোটি টাকা লুটে নিয়েছেন দলীয় নেতারা। বালু সিন্ডিকেট হোতাদের অপকর্ম বন্ধ করতে বর্তমান জেলা প্রশাসক আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলেও এই এসপির কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম পলাতক প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা লুটপাটের সব সাম্রাজ্য নিজের মতো করে গুছিয়ে নিয়েছেন। এর আগে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল হুদা মুকুট, সুনামগঞ্জ-১ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, রঞ্জিত সরকার ও জেলা যুবলীগের সভাপতি সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান খায়রুল হুদা চপল, তাহিরপুরের আজাদ হোসেন অপরাধ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন। ৫ আগস্টের পর এরা সবাই পলাতক। এরপর জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলামের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় জেলার এসব অপরাধ সাম্রাজ্য। বিএনপি নেতার এমন লুটপাটে জেলার এসপি আনোয়ার হোসেন খান সহযোগী হলে এই সিন্ডিকেটের শক্তি মহিরুহ রূপ ধারণ করে।
বিশেষ গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এসপির এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিও উঠে এসেছে। এ বিষয়ে বলা হয়, ‘পুলিশ সুপার সুনামগঞ্জে যোগদানের এক সপ্তাহ পর জেলার তাহিরপুর থানার জাদুকাটা নদীর অবৈধ বালু সিন্ডিকেটের হোতা মেসার্স সোহাগ এন্টারপ্রাইজের মালিক আওয়ামী লীগ নেতা রতন মিয়াকে ডেকে আলোচনায় বসেন। এই বৈঠক আয়োজনে সহযোগিতা করেন জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম। আওয়ামী লীগের পতনের পর এই রতন খোলস পালটে বিএনপিপন্থি সেজে নুরুল ইসলামের কাছে আত্মসপমর্পণ করে বালু ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে শেল্টার নেন। এভাবে এসপির সঙ্গে রতনের প্রথম বৈঠকেই অবৈধ বালু ব্যবসা চালিয়ে যেতে ১৪ লাখ টাকা দিয়ে হালখাতার সূচনা করেন। কারণ বালু বোঝাই নৌকা থেকে টোল আদায়ে পুলিশের সহযোগিতা প্রয়োজন হয়। পুলিশ সহযোগিতা না করলে অবৈধ এই বালু ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ হতে বাধ্য।’
সরেজমিন তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, শুধু এই জাদুকাটা নদীই নয়, দেশের সেরা এই বালি পাওয়া যায় সুনামগঞ্জের আরেক আলোচিত ধোপাজান নদীতেও। এই অবৈধ বালু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এসপির বিশেষ সম্পর্কের তথ্যও তুলে ধরা হয়েছে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। এ বিষয়ে সেখানে বলা হয়, ‘সুনামগঞ্জ সদর থানার ধোপাজান নদীতে বালু উত্তোলন বন্ধ করেছে সরকার। এই সুযোগে সেখানে চোরাই বালু ব্যবসার একটি সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। এই চোরাকারবারিরা বিএনপি নেতা নুরুল ইসলামের সহযোগিতা নিয়ে এই নদীর তীর কাটা শুরু করে। নদীর তীর কেটে বালু লুটের ঘটনাটি পুলিশের সহযোগিতায় হয়। এসপি আনোয়ার হোসেন কখনো নিজে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে মৌখিক চুক্তিতে, আবার কখনো নিজের বিশ্বস্ত ক্যাশিয়ারের মাধ্যমে একটি বালু বোঝাই বাল্কহেড থেকে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আদায় করছেন। বর্তমানে প্রতিদিন এই ধোপাজান থেকে সর্বোচ্চ ৩০টি বাল্কহেড থেকে প্রতিদিন ৩ লাখ টাকা আদায় করা হয় শুধু এসপির নামে। ধোপাজানের এই অবৈধ বালুমহাল থেকেই মাসে এসপি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।
জেলা বিএনপির সিনিয়র একাধিক নেতা নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, জেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক কামরুল হাসান রাজু, সদর উপজেলা যুবদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক কালাচাঁন ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সহসভাপতি সোহেল বিএনপির নামে পরিচালিত এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন।
সুনামগঞ্জ জেলা ডিবিতে কর্মরত একজন এসআই এসব তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, পুলিশ সুপার বিএনপি নেতা নুরুল ইসলামের সঙ্গে আঁতাত করে গত ২২ নভেম্বর রাতে ১০টি বড় বালুর বাল্কহেড থেকে দেড় লাখ টাকা তুলে নেন। তাছাড়া তিনি জেলায় যোগদানের পর এই ধোপাজান থেকেই ডিবি পুলিশ ও থানা পুলিশের যৌথ চেকপোস্ট বসিয়ে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা তুলে নিচ্ছেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে কেউ প্রমাণ দিতে পারবে না। শুধু আমি নই, জেলা বিএনপির কোনো নেতার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ নেই।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আসন্ন জেলা বিএনপির কমিটিকে কেন্দ্র করে কেউ এসব অভিযোগ আলোচনায় এনে ফায়দা লোটার চেষ্টা করতে পারে। তবে আমি হারাম খাই না। মিথ্যা অভিযোগ করা হলে আল্লাহ বিচার করবে।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসপি আনোয়ার তাহিরপুর থানার ওসি দেলোয়ার হোসেনের মাধ্যমে জাদুকাটা নদীর অবৈধ বালুমহাল ও চোরাচালান থেকে সাপ্তাহিক ভিত্তিতে ঘুস নেন। এছাড়া সীমান্তবর্তী দোয়ারাবাজার, বিশম্ভরপুর, জামালগঞ্জ, মধ্যনগর থানার ওসিদের মাধ্যমে চোরাচালানের ভাগ নেন। সীমান্তে আছে তার নিজস্ব লাইনম্যান। এসব লাইনম্যান কোন সীমান্ত থেকে কীভাবে চিনি, পেঁয়াজ, কয়লা আসছে তার পরিসংখ্যান তৈরি করেন। সে হিসাবে ভাগাভাগি করা হয় চোরাচালানের টাকা। অবৈধ বালুমহাল থেকে বালু উত্তোলন করা হয় না-এমন মিথ্যা তথ্য জেলা প্রশাসককে নিয়মিত দিয়ে যাচ্ছেন তাহিরপুরের ইউএনও আবুল হাশেম। অথচ এই অবৈধ কাজের জন্য প্রতিদিন ২ লাখ টাকা তার কাছে চলে যায়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তাহিরপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল হাশেম বলেন, জাদুকাটায় ইজারাসংশ্লিষ্ট বালুমহাল আছে। যখন খবর পাই ইজারাবহির্ভূত স্থানে বালু উত্তোলন চলছে সেখানে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে জড়িতদের বিরুদ্ধে জেল-জরিমানা দেওয়া হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি আছিই তো একা। অভিযোগ তো আমার বিরুদ্ধেই হবে। এমপি নাই, উপজেলা চেয়ারম্যান নাই বা কোনো জনপ্রতিনিধিও নাই। তাই আমার বিরুদ্ধেই অভিযোগ হয়। তবে আমি কোনো অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত নই।’
ওসি পদায়ন : অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসপি আনোয়ার জেলা পুলিশের কার্যক্রমে সংস্কারের নামে টাকার বিনিময়ে সব ওসি দ্বিতীয় দফায় পরিবর্তন করেন। জেলার ১২টি থানায় অফিসার যোগদানের ক্ষেত্রে নিরাপদে ঘুস লেনদেন করতে তার বিশ্বস্ত একজনকে সুনামগঞ্জে এনে একটি হোটেলে রাখেন। তার নাম ইকরাম হোসেন। তিনি যশোর এসপি অফিসের স্টেনোগ্রাফার। সিআইভি নং-৯৩১৬১৮৬৭০৭। এই ইকরাম হোসেনের মাধ্যমে ‘ওসি পোস্টিং বাণিজ্য’ সম্পন্ন করা হয়। এসপির পক্ষে তাকে সহায়তা করেন সুনামগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের ক্রাইম শাখায় কর্মরত এএসআই (নিঃ) বিধান দেব এবং স্টেনো-১ সিদ্দিকুর রহমান। এই ইকরাম ৫ আগস্টের পর বদলি, পদায়ন ও চাকরি থাকা না থাকা নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত পুলিশ পরিদর্শকদের বেশ কয়েকজনকে ওসির দায়িত্ব দেওয়ার প্রলোভন দেখান। এই ধারাবাহিকতায় লন্ডন প্রবাসী অধ্যুষিত জগন্নাথপুর থানার তৎকালীন ওসি আজিজুর রহমানকে ডেকে ৩০ লাখ টাকা দাবি করেন। ৫ আগস্টের পর গণবদলির শিকার হয়ে ১৬ আগস্ট তিনি ওই থানায় যোগদান করেছিলেন। অথচ স্বপদে থাকার জন্য তার কাছে এই টাকা দাবি করা হয়। এই টাকা না দেওয়ায় তাকে জেলা পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করে মোকলেছুর রহমান নামে একজন পুলিশ পরিদর্শককে জগন্নাথপুর থানার ওসি করা হয়।
আনোয়ার হোসেন খান এসপি হিসাবে যোগদানের পর জেলার বিভিন্ন থানায় ওসি হওয়ার দৌড় প্রতিযোগিতায় কত টাকা নেওয়া হয়েছে তারও একটি সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করা হয়েছে পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো বিশেষ গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়, মোকলেছুর রহমান আকন্দ জগন্নাথপুর থানার ওসি পদায়ন পেতে ৩০ লাখ টাকা, চোরাচালান, জলমহাল ও অবৈধ বালুমহাল অধ্যুষিত এলাকা হিসাবে পরিচিত তাহিরপুর থানার ওসির পদ পেতে দেলোয়ার হোসেন এক বছরের জন্য ২০ লাখ টাকা, দিরাই থানার ওসি মো. আব্দুর রাজ্জাক ১৫ লাখ টাকা, বিশ্বম্ভরপুর থানার ওসি মো. কাউছার আলম ১০ লাখ টাকা, ছাতক থানার ওসি গোলাম কিবরিয়া হাসান ৩০ লাখ টাকা, সুনামগঞ্জ সদর থানার ওসি নাজমুল হক এবং ডিবি ওসি আহমেদ উল্লাহ ভুঁইয়ার পোস্টিং বাবদ নেওয়া হয় ৯০ লাখ টাকা। আরেক চোরাচালানখ্যাত সীমান্তবর্তী দোয়ারাবাজার থানার ওসি পদে পদায়নের জন্য জাহিদুল হককে দিতে হয় ৩০ লাখ টাকা। এই জাহিদুল হককে এক সপ্তাহের মধ্যে তিন থানায় বদলি করেন এই এসপি আনোয়ার হোসেন। যা নজিরবিহীন। তিন দফায় কেন তাকে বদলি করা হয়-এর একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হয় ওই গোপন প্রতিবেদনে। এ বিষয়ে বলা হয়, প্রথমে ১৯ সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জ জেলা আদেশ নং-৮৩/২০২৪-মূলে তাকে ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে দিরাই থানায় বদলি করা হয়। পরে আব্দুর রাজ্জাক দিরাই যেতে ১৫ লাখ টাকা দিয়ে পদ বাগিয়ে নেন। এরপর জাহিদুলকে দিরাই থানার পরিবর্তে ২২ সেপ্টেম্বর নং-৮৪/২০২৪ আদেশমূলে নবগঠিত শান্তিগঞ্জ থানার ওসি করা হয়। এ অবস্থায় শান্তিগঞ্জ থানায় কাজ করে পোস্টিংয়ের টাকাই ওঠে কিনা-এমন আশঙ্কা থেকে জাহিদুল হক চোরাচালানখ্যাত দোয়ারাবাজার থানায় যেতে ৩০ লাখ টাকায় পদটি লুফে নেন। ২৪ সেপ্টেম্বর নং-৮৮/২০২৪ আদেশমূলে তাকে বদলি করা হয়।
পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন : সাধারণ মানুষের পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনেও ঘুস নেন এসপি আনোয়ার হোসেন খান। এ বিষয়ে ওই গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়, জেলার পাসপোর্ট আবেদনকারীদের তথ্য যাচাই করেন থানার ডিএসবি সদস্যরা। আগে প্রতিটি পাসপোর্ট তদন্ত শেষে রিপোর্ট জমাকালীন ১৫০ টাকা হারে ডিআইও (ডিটেক্টিভ ইন্টেলিজেন্স অফিসার) এসপিকে দিতেন। আনোয়ার হোসেন এসপি হিসাবে যোগদানের পর প্রতিটি পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনের জন্য ২৫০ টাকা নির্ধারণ করে দেন। এ খাত থেকে কত টাকা নেন এসপি তারও একটি ধারণা তুলে দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়, পাসপোর্ট পেতে প্রতি মাসে সুনামগঞ্জ জেলায় আনুমানিক চার থেকে সাড়ে ৪ হাজার আবেদন করা হয়। ডিএসবিতে কর্মরত কনস্টেবল হানিফ আলী প্রতি মাসে ৪ হাজার পাসপোর্টের জন্য আড়াইশ টাকা হারে ১০ লাখ টাকা এসপিকে পৌঁছে দেন।
কর্মী ভিসায় বিদেশে যেতে সাধারণ মানুষের পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের প্রয়োজন হয়। এই আনোয়ার হোসেন কতগুলো পুলিশ ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হয় থানা থেকে তার হিসাব নিয়ে টাকা গুনে নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়, ‘জেলার মোট ১২টি থানায় প্রতি মাসে গড়ে ২ হাজার ৫শ থেকে ৩ হাজার পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট দিতে হয়। এই পুলিশ ক্লিয়ারেন্স থেকে এসপি ২শ টাকা হারে আদায় করেন। ডিএসবি কনস্টেবল হানিফই এই খাত থেকে মাসে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টাকা এসপিকে দেন।
টেন পার্সেন্ট ঘুস ছাড় : পুলিশ সুপার প্রতিটি পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন থেকে ২৫০ টাকা এবং ক্লিয়ারেন্স থেকে ২০০ টাকা হারে ঘুস নিলেও বিশেষ বিবেচনায় টেন পার্সেন্ট ছাড় দেন। এ বিষয়ে বলা হয়, মোট পাসপোর্ট ও ক্লিয়ারেন্স সনদে মোট সংখ্যার টেন পার্সেন্টের বেশি কোনো ঘুস নেন না। কারণ বিভিন্ন তদবির, রাজনৈতিক সুপারিশ, পরিচিত ব্যক্তির সুপারিশ থাকার বিবেচনায় নেন এসপি আনোয়ার। যেমন কোনো পুলিশ কর্মকর্তাকে ৯০০টি পাসপোর্টের তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হলে তার কাছ থেকে টেন পার্সেন্ট বাদ দিয়ে ৮১০টি পাসপোর্টের হিসাব করেন।
উল্লিখিত সব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সুনামগঞ্জের এসপি আফম আনোয়ার হোসেন খান যুগান্তরকে বলেন, জাদুকাটা নদীর বালুমহাল ইজারা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। এখানে আমার ওপর অভিযোগ অবান্তর। ধোপাজান নদীতে বালু উত্তোলন বন্ধ। সীমান্তে চোরাচালান পুরোটাই বিজিবির নিয়ন্ত্রণে। এখানে পুলিশের কোনো ভূমিকা নেই। বদলি বাণিজ্য বিষয়ে জানতে চাইলে এসপি বলেন, ৫ আগস্টের পর ওসির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জোর করে। কেউ দায়িত্ব নিতে রাজি হয়নি। টাকা নেওয়ার বিষয়ে অভিযোগ সঠিক নয়। আর কাজ করতে গেলে অভিযোগ আসতেই পারে। এসব মেনে নিয়েই দায়িত্ব পালন করতে হয়।