বর্ণবাদ বিরোধী লড়াইয়ের বিশ্বের নন্দিত কিংবদন্তী মহান নেতা কমরেড নেলসন ম্যান্ডেলা লাল সালাম
বিশ্বের জননন্দিত অবিসংবাদিত নেতা ও রাষ্ট্রনায়ক কমরেড নেলসন ম্যান্ডেলার ১১ম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। বর্ণবাদবিরোধী লড়াইয়ের এক কিংবদন্তী ও বিশ্ব ইতিহাসেরও মহানায়ক তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতি। একই সাথে দেশটিতে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত প্রথম রাষ্ট্রপতি।
বিশ্ব ইতিহাসে যারা মানবমুক্তির পথ দেখিয়ে সভ্যতার আলোক প্রজ্জ্বলিত রেখেছেন, সেই স্বল্পসংখ্যক মহানায়কদেরই একজন নেলসন ম্যান্ডেলা, যিনি মাদিবা নামেও পরিচিত। অন্ধকারাচ্ছন্ন আফ্রিকার কালো মানুষদের তিনি মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। শৃঙ্খলিত দক্ষিণ আফ্রিকাকে তিনি মুক্ত করেছেন। সাদা চামড়ার ঔপনিবেশিক শোষকদের দ্বারা লালিত বর্বর বর্ণবাদকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে সকল জাতি-বর্ণের মানুষকে তিনি শিখিয়েছেন ভ্রাতৃত্ব, ঐক্য ও সংহতির মহৎ আদর্শ। এইভাবে তিনি হয়ে উঠেছেন কেবল দক্ষিণ আফ্রিকারই নয়, সারা বিশ্বের মানবজাতির মুক্তির সেনানী, অগ্রপথিক। একাধারে সংগ্রামী মানুষ, অপরদিকে শান্তির ও সম্প্রীতির অগ্রদূত। মাত্র পাঁচ বছর আগেও যে মার্কিন প্রশাসনের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তালিকায় নাম ছিল নেলসন ম্যান্ডেলার, সেই মার্কিন প্রশাসনের সর্বোচ্চ ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলতে বাধ্য হয়েছেন, “ম্যান্ডেলা এখন সময়েরও ঊর্ধ্বে।” তিনি ম্যান্ডেলাকে তুলনা করেছেন মহাত্মা গান্ধী, মার্টিন লুথার কিং, আব্রাহাম লিংকনের সঙ্গে। অথচ শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পাবার পনের বছর পরও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা রচিত তালিকায় তিনি ছিলেন “সন্ত্রাসবাদী”।
বর্ণবাদ ছিল শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদীদের মতাদর্শগত হাতিয়ার। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও সাম্রাজ্যবাদের লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম আসলে একই সূত্রে গাথা। তাই ম্যান্ডেলার সংগ্রামের ইতিহাস জানতে হলে সাম্রাজ্যবাদের শোষণ-লুণ্ঠনের ইতিহাসও জানতে হবে।
সভ্যের বর্বর লোভ
আফ্রিকা মহাদেশের ইতিহাস হলো ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদ কর্তৃক চরম অমানবিক শোষণ, লুণ্ঠন, ধর্ষণের ইতিহাস। তারা কেবল মহাদেশটি দখলই করেনি, আফ্রিকা থেকে মানুষ শিকারের ব্যবসা চালিয়েছিল কয়েক শতাব্দী ধরে। আমেরিকা মহাদেশে ও কৃষ্ণ আফ্রিকায় ইউরোপীয় বুর্জোয়ারা যা করেছিল তা ছিল ইতিহাসের বর্বরতম অধ্যায়। একেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “সভ্যের বর্বর লোভ”।
ইউরোপীয় দস্যুর দল পশু শিকারের মতো মানুষ শিকার করত আফ্রিকায়, তারপর তাদের হাতে পায়ে গলায় শিকল পরিয়ে আমেরিকায় ‘দাসের হাটে’ বিক্রি করত। এদেরকেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, মানুষ ধরার দল। সপ্তদশ শতাব্দীতেই প্রতি বৎসর আমেরিকার দাসের বাজারে গড়ে বিক্রি হতো পঞ্চান্ন হাজার আফ্রিকার কালো মানুষ। পরবর্তী শতাব্দীতে এই দাস ব্যবসা আরো বৃদ্ধি পায়। আফ্রিকায় মানুষ শিকারের সংখ্যাও দারুণভাবে বৃদ্ধি পায়। বুর্জোয়াদের জন্য এটা ছিল লাভজনক ব্যবসা। শুধুমাত্র ব্রিটিশ কলোনিতেই ১৬৮০ থেকে পরবর্তী একশ বছরে ২১ লাখ আফ্রিকানকে দাস বানিয়ে চালান দেয়া হয়েছিল।
পুঁজিবাদ আধুনিক যুগে নতুন করে প্রবর্তন করল দাসশ্রম। কার্ল মার্কস তার বিখ্যাত “পুঁজি” গ্রন্থে এই চরম অমানবিক দাস ব্যবসা ও লুণ্ঠনকে ইউরোপীয় পুঁজিপতিদের জন্য আদি পুঁজি সঞ্চয়ের উৎস হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সামির আমিনও বলেছেন যে, “পশ্চিম ইউরোপের বুর্জোয়ার সম্পদ সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে অধীনস্ত লাতিন আমেরিকা। আর কৃষ্ণ আফ্রিকা পরিধিরও পরিধিতে (periphery of the periphery) অবস্থান করে আমেরিকার বড় বড় খামার বাগানে দাস শ্রম সরবরাহ করেছিল।”
খোদ আফ্রিকাতে যে ব্রিটিশ ও অন্যান্য ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের বর্বর লোভ নিষ্ঠুর লুণ্ঠন করেছে, মানুষ শিকার করেছে, রক্তাক্ত করেছে আফ্রিকার মাটি, সেই দস্যুদল সম্পর্কে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন,
“এল ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে
নখ যাদের তীক্ষ্ণ তোমার নেকড়ের চেয়ে
এল মানুষ ধরার দল
গর্বে যারা অন্ধ তোমার সূর্যহারা অরণ্যের চেয়ে
সভ্যের বর্বর লোভ
নগ্ন করলো আপন নির্লজ্জ অমানুষতা।”
মানুষ ধরার দল মূলত এসেছিল আফ্রিকার পশ্চিম পাশে। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে মানুষ চালানের ঘটনা তেমন না থাকলেও শ্বেতাঙ্গ দস্যুর দল সেখানে আফ্রিকানদের নিজ দেশেই দাস বানিয়েছিল। পুঁজিবাদী ইউরোপ থেকে লুণ্ঠনকারীরা দক্ষিণ আফ্রিকায় এসেছিল উনবিংশ শতাব্দীতে। প্রথমে এসেছিল অ-ইংরেজ অন্যান্য শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়রা। এদেরকে বলা হতো বুয়ার্স। পরে আসে ইংরেজরা। লুণ্ঠনকারীদের নিজেদের মধ্যে লুটের ভাগ নিয়ে মারামারি ছিল। বুয়ার্সরা কালো মানুষদের উচ্ছেদ করে রিপাবলিক গঠন করেছিল ট্রান্সভালে।
এদিকে ঐ অঞ্চলের প্রতি নজর পড়ে ইংরেজদের। ১৮৬০-এর দশকে অরেঞ্জ রিভারে হীরকের খনি এবং ১৮৮০-এর দশকে ট্রান্সভালে স্বর্ণের খনি আবিষ্কারের পর ব্রিটিশদের লোভ আরো বেড়ে গেল। উপরন্তু সমগ্র আফ্রিকাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য তারা কায়রো থেকে কেপটাউন পর্যন্ত- উত্তর থেকে দক্ষিণে দীর্ঘ রেললাইন স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সেইজন্য দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বুয়ার্সদের সরিয়ে এই অঞ্চলকে নিজ দখলে নেয়া দরকার মনে করল ইংরেজরা। এই কারণেই বুয়ার্সদের সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ হয়। ১৮৯৯ থেকে ১৯০২ সাল পর্যন্ত চলে এই যুদ্ধ। বড়ই নির্মম ছিল এই যুদ্ধ। বুয়ার্স যুদ্ধের বীভৎসতা রবীন্দ্রনাথকে বেদনাহত করেছিল। তিনি লিখেছিলেন,
“… দয়াহীন সভ্যতানাগিনী
তুলেছে কুটিল ফনা চক্ষের নিমেষে
গুপ্ত বিষদন্ত তার ভরি তীব্র বিষে।”
এই যুদ্ধে বুয়ার্সরা তীব্র প্রতিরোধ সৃষ্টি করলেও সেখানে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষরা যোগদান করেননি। কারণ সাদা চামড়ার বুর্য়াসরাও তো ছিল পরদেশী লুণ্ঠনকারী ও নিষ্ঠুর শোষক।
একইভাবে দেখা যায়, প্রায় কাছাকাছি সময়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের নিয়ে মহাত্মা গান্ধী যে ইংরেজ শাসনের বর্ণবাদ ও বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করেছিলেন তার সঙ্গেও কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। সেই ভারতীয়রা শোষক ছিল না, তারা ছিল নিরীহ ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী ইত্যাদি। মহাত্মা গান্ধীও আফ্রিকানদের জড়ো করার চেষ্টা করেননি। অন্যদিকে আফ্রিকানদের মধ্যে তখনো যথেষ্ট সচেতনতা তৈরি হয়নি। সচেতন করে তোলার ক্ষেত্রে ম্যান্ডেলার বিশেষ ভূমিকা ছিল।
বুয়ার্সদের পরাজিত করার পর ইংরেজরা দক্ষিণ আফ্রিকার পুরো অঞ্চলটি দখলে আনল। ১৯১০ সালে ট্রান্সভাল, অরেঞ্জ ফ্রি স্টেট এবং ইতিপূর্বে দখলকৃত কেপ কলোনি ও নাটালকে একত্রিত করে দক্ষিণ আফ্রিকার ইউনিয়ন নামে এক নতুন ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাসের রাষ্ট্রের জন্ম দিল। পরে তারা দেশটিকে স্বাধীনতা দিয়েছিল এই অর্থে যে, জনগোষ্ঠীর মাত্র চার শতাংশ শ্বেতাঙ্গের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়েছিল। কৃষ্ণবর্ণের মানুষরা নিজ দেশেই পরাধীন হয়ে রইল। বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার ছিল চরমভাবে ফাসিস্ত। এমনকি হিটলারের চেয়েও নিকৃষ্ট। কৃষ্ণবর্ণ আফ্রিকান জনগণের কোনো অধিকারই ছিল না। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ দেশটির জনগণ ছিল শোষিত ও চরমভাবে দরিদ্র। তাদের জন্য না ছিল স্বাস্থ্যসেবা, না ছিল শিক্ষার সুযোগ। বর্ণবাদ ছিল নিকৃষ্ট ধরনের।
বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধেও দুইটি দেশেই বর্ণবাদ চালু ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ আফ্রিকায়। ষাটের দশক পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রিকান আমেরিকানদের কোনো নাগরিক অধিকার ছিল না। এমনকি তাদের হত্যা করাও কোনো অপরাধ বলে গণ্য হতো না। গাছের সঙ্গে বেঁধে গরু-ছাগলের মতো চামড়া ছিলে হত্যা করার ঘটনাও ছিল অসংখ্য, গত শতাব্দীর পঞ্চাশ-ষাটের দশকেও। এই প্রক্রিয়ায় হত্যাকে বলা হতো লিনচিং। বিখ্যাত সাহিত্যিক মার্ক টোয়াইন তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাম দিয়েছিলেন United Lynching State।
মতাদর্শ (প্রতিক্রিয়াশীল ও বর্ণবাদী) এক হওয়ায় দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শাসকদের পরিপূর্ণ সমর্থন দিয়ে এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ব্রিটেন, ফ্রান্স প্রভৃতি ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদও বর্ণবাদী রাষ্ট্রকে মদদ দিয়ে এসেছে। বস্তুত দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী রাষ্ট্র তো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদেরই তৈরি। এইরকম এক ঘোর বর্ণবাদী ঔপনিবেশিক যুগে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা, ১৯১৮ সালে।
দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তি সংগ্রাম এবং নেলসন ম্যান্ডেলা
সেই সময় কৃষ্ণ আফ্রিকানদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার হয়নি। অধিকাংশ কালো মানুষ ছিল সস্তা শ্রমের সরবরাহকারী। তখন অল্পসংখ্যক আফ্রিকান, যারা শিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন ম্যান্ডেলা তাদের একজন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে ডিগ্রি লাভ করেন এবং আইন ব্যবসা শুরু করেন জোহেন্সবার্গে। এই সময় তিনি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে (ANC) যোগদান করেন; ১৯৪৪ সালে।
আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস ছিল কৃষ্ণ আফ্রিকানদের বৈধ সংগঠন, যারা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রচার করতেন। ১৯১২ সালে এই সংগঠনটির জন্ম হয়েছিল। অবশ্য ১৯২৩ সালে তা আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস নামটি গ্রহণ করেছিল। তিনি এই সংগঠনের যুব সংস্থা গড়ে তোলেন। তাঁর নেতৃত্বে এএনসি’র যুব সংগঠন সারা দেশে বিস্তৃতি লাভ করেছিল। বর্ণবাদ ও উপনিবেশবাদবিরোধী চেতনা দৃঢ়তর ও গভীরতর হয়েছিল তরুণ কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে। এএনসি দীর্ঘসময় শান্তিপূর্ণ প্রচারমূলক সংগ্রাম পরিচালনা করেছে। বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামই ছিল তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি। এর বাইরে অন্যকিছু নয়।
নেলসন ম্যান্ডেলা একই সঙ্গে শ্রমিক আন্দোলনেও জড়িয়ে পড়েন এবং নেতৃত্ব প্রদান করেন, যে কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার ফাসিস্ত সরকার তাঁর বিরুদ্ধে আনীত মামলায় “শ্রমিকদের উসকানি”র অভিযোগও এনেছিল। পঞ্চাশের দশকে ম্যান্ডেলা মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং পরে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। ১৯৫০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। কয়েক বৎসর পর আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসও নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। পঞ্চাশের দশকে আন্দোলনও যেমন তীব্র হয়ে উঠেছিল, তেমনই সরকারের দমন-পীড়নও বাড়তে থাকে। ‘সাপ্রেশন অফ কমিউনিজম অ্যাক্ট’ নামে আইনটি এই সময় প্রণীত হয়েছিল।
১৯৬১ সালে নেলসন ম্যান্ডেলা আত্মগোপনে যান। ১৯৬২ সালে গ্রেফতার হবার সময় তিনি কেবল এএনসির নেতা ছিলেন তাই-ই নয়, তিনি গোপন কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যও ছিলেন।
ইতোমধ্যে এএনসি ও কমিউনিস্ট পার্টি উভয়ই সশস্ত্র সংগ্রামের লাইন গ্রহণ করে। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সশস্ত্র শাখা উমখোনতো উই সিজোয়ের প্রতিষ্ঠা হয়, যার প্রধান ছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা।
সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রশিক্ষণ চাই, অস্ত্র চাই। কয়েকটি আফ্রিকান দেশ এএনসির সশস্ত্র যোদ্ধাদের আশ্রয় ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল। আর অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া) ও চীনসহ সমাজতান্ত্রিক শিবির। আফ্রিকার সশস্ত্র বিপ্লবী যুদ্ধে কমরেড ফিদেল কাস্ট্রোর নেতৃত্বাধীন কিউবারও বড় ভূমিকা ছিল।
১৯৬২ সালের ১১ জানুয়ারি ম্যান্ডেলা গোপনে ডেভিড মোৎসামাই ছদ্মনামে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে আসেন। সশস্ত্র সংগ্রামে সমর্থন জোগাড় করার জন্য তিনি আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেন। ইংল্যান্ডেও গিয়েছিলেন। নিজে গেরিলা যুদ্ধের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ নেন ইথিওপিয়া ও মরক্কোতে অবস্থিত আলজিরিয়ান ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের বিভিন্ন শিবিরে। পরে রিভোনিয়া মামলায় ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, “আফ্রিকায় আমাকে বেন বেল্লার মানুষ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, আলজিরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট বেন বেল্লা সেদিন আমাকে ওউজদায়, আলজিরিয়ান ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের সদর দফতরে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।” ১৯৬২ সালের জানুয়ারিতে প্যান আফ্রিকান ফ্রিডম মুভমেন্ট অফ ইস্ট অ্যান্ড সেন্ট্রাল আফ্রিকার সম্মেলনে তিনি ভাষণ দান করেছিলেন।
ছয় মাস বিদেশে থাকার পর ম্যান্ডেলা ১৯৬২ সালের জুলাইয়ে দেশে ফিরে আসেন। ম্যান্ডেলার গতিবিধির ওপর নজর রাখছিল যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। ম্যান্ডেলাকে গ্রেফতার করার ব্যাপারে যে সিআইএর ভূমিকা ছিল তা এখন মার্কিন পত্রপত্রিকাতেও বলা হচ্ছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস (১০ জুন, ১৯৯০) বলছে, “নেলসন ম্যান্ডেলার ১৯৬২-তে গ্রেফতারের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল সিআইএ।” নিউজ উইক পত্রিকাও একই কথা জানিয়েছে।
সিআইএ তাদের বন্ধু সরকার দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকারকে তথ্য সরবরাহ করে এবং তারই ভিত্তিতে ম্যান্ডেলাকে গ্রেফতার করা হয়। তারপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় প্রিটোরিয়ায়। শুরু হয় রাজদ্রোহের মামলা, যা ‘রিভোনিয়া ট্রায়াল’ নামে পরিচিত। ম্যান্ডেলার বিরুদ্ধে আনীত এই অভিযোগ ছাড়াও আরো ছিল শ্রমিক ধর্মঘটে উসকানি দেয়া ও বেআইনিভাবে দেশত্যাগের অভিযোগ। বর্ণবাদী ফাসিস্তদের বিচারে তাঁকে দেয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদন্ড (১২ জুন, ১৯৬৪)। ২৭ বছরের জেলজীবনে তাকে অধিকাংশ সময় নিঃসঙ্গ থাকতে হয়েছিল। নির্যাতনও কম হয়নি। ওরা তাঁকে মেরেই ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ ফ্যাসীবাদের ইচ্ছানুযায়ী ইতিহাস পরিচালিত হয় না। এএনসি ও কমিউনিস্ট পার্টির যৌথ সংগ্রাম, সমাজতান্ত্রিক শিবিরের কার্যকর সহযোগিতা, তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের দৃঢ় সমর্থন এবং বিশ্বজনমতের পরিপ্রেক্ষিতে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও দক্ষিণ আফ্রিকার ফাসিস্ত সরকার পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৯০ সালে মাদিবা মুক্তিলাভ করেন। যৌবনে কারাগারে গিয়ে বৃদ্ধ হয়ে বের হলেন।
কারাগারে থাকলেও নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের হৃদয়ে। তিনি ছিলেন সশস্ত্র সংগ্রামীদের প্রেরণাদাতা। ১৯৯৪ সালে সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গ শাসনের বদলে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হলো। ম্যান্ডেলা ছিলেন প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। ১৯৯৯ সালে তিনি বয়সের কারণে স্বেচ্ছায় প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে আসেন। এরপর সরাসরি রাজনীতি না করলেও আফ্রিকার সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে ভাবতেন এবং কাজও করতেন। বিশ্ব সমস্যা নিয়েও তিনি ভাবতেন এবং কথা বলতেন। তাঁর সেই সকল মতামতের মূল্য ছিল অপরিসীম।
গান্ধীবাদী না মার্কসবাদী
নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যুতে সারাবিশ্ব শোকাভিভূত। জোহেন্সবার্গে অনুষ্ঠিত ম্যান্ডেলার স্মরণসভায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ছাড়াও ছিলেন তিন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট- জিমি কার্টার, বিল ক্লিনটন ও জর্জ ডব্লিউ বুশ। সেই আমেরিকার সাবেক ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট, যে আমেরিকা কিছুদিন আগেও বলেছিল, “ম্যান্ডেলা সন্ত্রাসবাদী”। এসেছিলেন ব্রিটিশ রানীর প্রতিনিধি রাজকুমার চার্লস এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামারুন। লন্ডনের ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছিল। সেই ব্রিটিশ সরকার, যারা দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকারকে মদদ দিয়ে এসেছিল এবং ম্যান্ডেলার মৃত্যুই কামনা করেছিল। তাহলে কী হঠাৎ করে সাম্রাজ্যবাদীদের মানসিক পরিবর্তন ঘটেছে?
মানসিক পরিবর্তন না হলেও বিশ্ব জনমত ও প্রবল গণসংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে তারা পূর্বের অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছে। সেদিন যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, “ম্যান্ডেলা সন্ত্রাসবাদী”। এখন ওবামা বলছেন, “আমরা হারিয়েছি বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী, নির্ভীক, নির্ভেজাল একটি ভালো মানুষকে।” মাত্র সেদিন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বর্ণবাদকে উৎসাহিত করেছিল, সমর্থন দিয়েছিল ম্যান্ডেলার কারাদন্ডকে। এখন ডেভিড ক্যামারুন বলছেন, “বর্তমান যুগের সর্বোচ্চ নেতাকে আমরা হারালাম। নিভে গেল একটি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক।”
যাই হোক, এই পরিবর্তনকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে মনে রাখতে হবে যে, এই পরিবর্তনের পেছনেও একটা কৌশল কাজ করে। তারা ম্যান্ডেলাকে দেখাতে চান একজন “ভালো মানুষ” হিসেবে, যিনি সাদা চামড়ার প্রাক্তন শাসকদের প্রতি উদার মনোভাব দেখিয়েছেন, প্রতিহিংসার মনোভাব দেখাননি এবং জাতীয় সামঞ্জস্যবিধানের (National Reconciliation) নীতি গ্রহণ করেছিলেন। তাই তারা ম্যান্ডেলাকে আজ গান্ধীবাদী হিসেবে চিহ্নিত করতে চায়। এমনকি ম্যান্ডেলাকে “দক্ষিণ আফ্রিকার গান্ধী” নামে অভিহিত করা হয় কখনো। তিনি যে আগাগোড়া বিপ্লবী ছিলেন, এই ধারণাটা ভুলিয়ে দিতে চায় ওরা। তাই এটা সাম্রাজ্যবাদের চাতুর্যপূর্ণ কৌশলও বটে।
মহাত্মা গান্ধীকে যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ নির্যাতন করেছিল এবং যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতার কারণে মহান শান্তিবাদী গান্ধীকে শান্তির জন্য নোবেল প্রাইজ দেয়া সম্ভব হয়নি (তার মানে নোবেল প্রাইজ কমিটিও ছিল সাম্রাজ্যবাদের লেজুড়), সেই ব্রিটিশ ও অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদ এখন সেই গান্ধীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তারা নিপীড়িত ও শোষিত মানুষকে বলতে চায়, বিপ্লব নয়, গান্ধীর মতো অহিংস পথে এসো।
এই প্রসঙ্গে লেনিনের একটি বক্তব্য খুবই প্রণিধানযোগ্য। বিখ্যাত “রাষ্ট্র ও বিপ্লব” গ্রন্থটি তিনি শুরুই করেছেন নিম্নোক্ত বাক্যগুলো দিয়ে- “শোষিত শ্রেণীসমূহের মুক্তিসংগ্রামের নেতা ও বিপ্লবী চিন্তাবিদদের শিক্ষার ক্ষেত্রে ইতিহাসে বারংবার যা ঘটেছে, আজ মার্কসের শিক্ষার ক্ষেত্রে তাই ঘটছে। মহান বিপ্লবীদের জীবদ্দশায় শোষকশ্রেণীরা তাদের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছিল। বর্বরতম বিদ্বেষ, ক্রোধান্বিত ঘৃণা এবং মিথ্যা ও কুৎসার সর্বাধিক শঠতাপূর্ণ প্রচার দ্বারাই তাদের শিক্ষাকে তুলে ধরেছিল। তাদের মৃত্যুর পরে প্রচেষ্টা নেয়া হয় তাদেরকে অক্ষম প্রতিমায় রূপান্তরিত করা, তাদেরকে সিদ্ধপুরুষ হিসেবে চিত্রিত করা এবং শোষিত শ্রেণীসমূহের ‘সন্তুষ্টি’র জন্য তাদের নামকে ঘিরে এক ধরনের মহিমান্বিত ভাব তৈরি করা। শোষিতশ্রেণীকে প্রতারিত করার প্রয়োজনে তারা একই সঙ্গে এই বিপ্লবীদের শিক্ষার বিষয়সমূহকে বিচ্ছিন্ন করে শিক্ষার ধারকে ভোঁতা করে দেয় এবং বিকৃত করে।”
একই কথা ম্যান্ডেলা প্রসঙ্গেও খাটে। ম্যান্ডেলার বিপ্লবী ভূমিকাকে আড়াল করে তাকে একজন “সাধুপুরুষ” বলে চিত্রিত করতে চায় পাশ্চাত্যের মিডিয়া ও রাজনীতিবিদগণ। কিন্তু ম্যান্ডেলা বারবার বলেছেন, “আমি কোনো সাধুপুরুষ (Saint) নই, আমি সংগ্রামের একজন কর্মী মাত্র।” এই কথার মধ্যে সত্যতা থাকলেও, তার বিনয়ী চরিত্রটিও বোঝা যায়।
নেলসন ম্যান্ডেলা মহাত্মা গান্ধীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, কিন্তু শান্তিবাদী গান্ধীবাদী ছিলেন না। তিনি ছিলেন সশস্ত্র বিপ্লবী। উপরন্তু তিনি মার্কসবাদী কমিউনিস্টও বটে। ১৯৬২ সালে যখন তিনি গ্রেফতার হন, তখন তিনি ছিলেন গোপন কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।
একটা পর্যায় পর্যন্ত এএনসি এবং ম্যান্ডেলা নিজেও মহাত্মা গান্ধীর অহিংস সংগ্রামের ধারণা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে গান্ধীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেও তাঁর অহিংস পথে আর চলেননি।
রিভোনিয়া মামলায় সুপ্রিম কোর্টে দাঁড়িয়ে ম্যান্ডেলা অকপটে বলেছেন, “শুরুতে এমনভাবে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করেছিলাম, যাতে কোনোপ্রকার হিংসাত্মক উপায় নিতে না হয়। তার বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা জারি করার আইন তৈরি হলো। এবং তারপর যখন সরকারি নীতির বিরোধিতা করার শাস্তি হিসেবে সরকার বলপ্রয়োগের পথ নিল, তখনই আমরা স্থির করলাম, হিংসার জবাব আমরা দেব হিংসার ভাষাতেই।”
পঞ্চাশের দশকে ম্যান্ডেলা মার্কসবাদে দীক্ষা গ্রহণ করেন, যার প্রতি আজীবন নিষ্ঠাবান ছিলেন। এ কথা সত্য যে, প্রথম জীবনে তিনি কমিউনিস্টবিরোধী ছিলেন। তার কারণ এএনসিতে তখন শুধুমাত্র কৃষ্ণাঙ্গদের প্রবেশাধিকার থাকলেও দক্ষিণ আফ্রিকান কমিউনিস্ট পার্টিতে সাদা কালোর মধ্যে কোনো প্রভেদ করা হতো না। কমিউনিস্ট পার্টিতে সাদা চামড়ার কমরেডরাও ছিলেন বলে এএনসির সদস্যরা তখন এই পার্টিকে অপছন্দ করতেন। ম্যান্ডেলাও ব্যতিক্রম ছিলেন না। পরে যখন তিনি মার্কসবাদী হয়ে উঠলেন, তখন তাঁর ভুল ভাঙল।
বলাই বাহুল্য যে, কমিউনিস্ট পার্টিতে যে সকল সাদা চামড়ার সভ্য ছিলেন তাঁরা বর্ণবাদ, ফাসিস্ত সরকার ও শ্রেণীশোষণের বিরুদ্ধে নিষ্ঠার সঙ্গে সংগ্রাম করেছেন এবং আত্মত্যাগও করেছেন। কমিউনিস্ট পার্টি এএনসির আগেই নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল ১৯৫০ সালে। এবং প্রায় একই সময় এএনসি ও কমিউনিস্ট পার্টি সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে (১৯৬১) সালে। তারা পরস্পরের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে এবং যৌথভাবে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করেছিলেন।
আদালতে দাঁড়িয়ে ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, “আমি শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছি, আমার সংগ্রাম কৃষ্ণাঙ্গ আধিপত্যের বিরুদ্ধেও। আমি সযত্নে লালন করেছি একটি গণতান্ত্রিক ও মুক্ত সমাজের ধারণাকে, যেখানে সমস্ত মানুষ থাকবেন একসঙ্গে, থাকবে সম্প্রীতি-সংহতি, সমান সুযোগ-সুবিধা।”
ম্যান্ডেলা যে গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য (এমনকি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য) ছিলেন, এই কথাটা তিনি সংগ্রাম চলাকালে গোপন করেছিলেন। প্রশ্ন করা হলে এড়িয়ে গেছেন। তবে রিভোনিয়া মামলায় তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, “আজ আমি শ্রেণীহীন সমাজের প্রতি আকৃষ্ট। এবং এই আকর্ষণ জন্মেছে কিছুটা মার্কসবাদ পড়ে আর কিছুটা এসেছে এ দেশের প্রাচীন আফ্রিকান সমাজের কাঠামো ও সংগঠন প্রণালির প্রতি শ্রদ্ধাভাব থেকে।… এ কথা সত্য যে, আমি মার্কসবাদী ভাবধারা দ্বারা প্রভাবিত।”
২৭ বছর কারাবাসের পর মুক্তিলাভ করার পর সম্ভবত তিনি আর আনুষ্ঠানিকভাবে কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ছিলেন না। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যে তাঁর আন্তরিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এবং এএনসির যে দৃঢ় মৈত্রী ছিল, সে ঘটনা তো সবার জানা আছে।
আজীবন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ম্যান্ডেলা
নেলসন ম্যান্ডেলা যে বর্ণবাদবিরোধী ছিলেন তাই-ই নয়, তিনি ছিলেন সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদবিরোধীও। কারণ তিনি তো মার্কসবাদ গ্রহণ করেছিলেন।
তাছাড়াও দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেছে সোভিয়েত-চীনসহ সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব। ষাট ও সত্তরের দশকে সমাজতান্ত্রিক শিবিরে বিভাজন সত্ত্বেও সকল সমাজতান্ত্রিক দেশই বর্ণবাদ উপনিবেশবাদবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের প্রতি নৈতিক, রাজনৈতিক ও বস্তুগত (অস্ত্র ও অর্থ) সাহায্য অব্যাহত রেখেছিল।
আফ্রিকা মহাদেশে মুক্তি সংগ্রামের ক্ষেত্রে কিউবার একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল। আফ্রিকার মুক্তি সংগ্রামে বিশেষ করে কঙ্গো ও এঙ্গোলায় কিউবা সরাসরি সৈন্য ও সশস্ত্র গেরিলা যোদ্ধা পাঠিয়ে সাহায্য করেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সপক্ষে। আফ্রিকার আরেক মহানায়ক কঙ্গোর স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা প্যাট্রিস লুমুম্বাকে হত্যা করেছিল বিশ্বের সকল সাম্রাজ্যবাদ মিলিতভাবে। তারপর সেই দেশে যে সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম শুরু হয়েছিল তাতে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন কিউবার আন্তর্জাতিক গেরিলারা। সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন চে গুয়েভারা ও কিউবার আরেক বিপ্লবী নেতা হোসে রিসকেট। এই প্রসঙ্গে কমরেড হায়দার আকবর খান রনো ভাইয়ের একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করতে চাই।
১৯৯০ সালে হাভানায় কমরেড হোসে রিসকেটের সঙ্গে কমরেড হায়দার আকবর খান রনো ভাইয়ের দীর্ঘ আলোচনার সুযোগ হয়েছিল। কথা প্রসঙ্গে তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “আপনারা যে আফ্রিকায় সৈন্য পাঠাচ্ছেন বিপ্লবীদের সমর্থনে, এটাকে কি বিপ্লবের রফতানি বলা চলে না, যা মার্কসবাদ অনুমোদন করে না?” হায়দার আকবর খান রনো ভাই লিখেছেন, উত্তরে তিনি যা বলেছিলেন তা আমাকে অভিভূত করেছিল। কমরেড হোসে রিসকেট বললেন, “কিউবার জনগণের ৪০ শতাংশ হচ্ছে কৃষ্ণবর্ণের। আপনি কি জানেন, কারা এদের পূর্বপুরুষ? এদের পূর্বপুরুষ ছিলেন আফ্রিকাবাসী, যাদের ইয়াংকি ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ হাতে পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে নিয়ে এসেছিল দাস হিসেবে। আমরা যখন আফ্রিকায় যাই, তখন আমরা বহিরাগত হিসেবে যাই না। আমরা আমাদের আফ্রিকান রক্তের ডাকে সাড়া দিই। যারা একদা আমাদের পূর্বপুরুষদের দাস বানিয়েছিল আমরা সেই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেই লড়াই করতে যাই।”
কমরেড হায়দার আকবর খান রনো ভাই বলছেন, সত্যিই আমি অভিভূত হয়েছিলাম এমন উত্তর শুনে। কিউবার আন্তর্জাতিক যোদ্ধারা এঙ্গোলায় মোকাবিলা করেছিলেন আগ্রাসী দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকারের ফাসিস্ত বাহিনীকে। ১৯৮৭-এর শেষ ভাগে “আফ্রিকার স্তালিন গ্রাড” নামে পরিচিত কুইটো কুয়ানাভালে সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত হয়েছিল বর্ণবিদ্বেষী ফাসিস্ত বাহিনী। এই ঘটনা যেমন এঙ্গোলার জনগণের জন্য বিজয় এনেছিল, তেমনই তা নামিবিয়ার স্বাধীনতার পথকে প্রশস্ত করেছিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকারকেও দুর্বল করেছিল।
মুক্তি লাভের পর দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি হিসেবে নেলসন ম্যান্ডেলার দেখা হয়েছিল কিউবার বিপ্লবের মহান নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে। ম্যান্ডেলা কিউবার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে বলেছিলেন, “আমাদের এই মহাদেশে (আফ্রিকা) কিউবানরা এসেছিলেন চিকিৎসক, শিক্ষক, সহযোদ্ধা, কৃষিবিশেষজ্ঞ হিসেবে- ঔপনিবেশিক হিসেবে নয়। তারা এসেছিলেন উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। তারা আমাদের সঙ্গে এক তাঁবুতে থেকে লড়াই করেছেন। শত শত কিউবান জীবন দিয়েছেন।… এমন নিঃস্বার্থ আন্তর্জাতিকতাবাদের বিরল নিদর্শন আমরা কখনো ভুলব না।”
অন্যদিকে ১৯৮৭ সালেও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার এএনসি ও ম্যান্ডেলাকে বলেছিলেন, ‘সন্ত্রাসবাদী’। ১৯৮৬ সালে মার্কিন কংগ্রেসে পাস হওয়া বর্ণবিদ্বেষবিরোধী আইনে ভেটো দিয়েছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান।
এই সকল ঘটনা প্রমাণ করে, পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ কত নিকৃষ্ট ও অমানবিক। অন্যদিকে সমাজতন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে। অন্যান্য দিক ছাড়াও মানকিক দিক দিয়েও সমাজতন্ত্র অনেক শ্রেষ্ঠ। পুঁজিবাদ মৌলিকভাবে শোষণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত বলেই বর্ণবাদ ও বর্ণবিদ্বেষ লালন করে। অন্যদিকে সমাজতন্ত্র হচ্ছে এ যাবৎকালের ইতিহাসের সবচেয়ে মানবিক সমাজব্যবস্থা- যা গোটা বিশ্বে সব ধরনের নিপীড়ন শোষণ বৈষম্য বিদ্বেষের বিরুদ্ধে সাম্য ভ্রাতৃত্ব মৈত্রীর মহান আদর্শকে বাস্তবে রূপদান করে।
ম্যান্ডেলার বন্ধু ছিলেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো, লিবিয়ার গাদ্দাফি এবং ইয়াসির আরাফাত।
সশস্ত্র সংগ্রামের সপক্ষে সাহায্য সংগ্রহের জন্য যখন (১৯৬১ সালে) এএনসির সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে নেলসন ম্যান্ডেলা গোপনে আলজিরিয়া গিয়েছিলেন তখন তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল চে গুয়েভারার।
পরে ম্যান্ডেলা তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, পশ্চিমা দেশগুলোর কাছেও তিনি সাহায্য চেয়েছিলেন। কেউ সাহায্য করেনি। দুই একজন ছোটখাটো মন্ত্রী ছাড়া আর কারোর সাক্ষাৎ পর্যন্ত পাননি। কিন্তু কিউবার শীর্ষস্থানীয় নেতারা তাকে স্বাগত জানিয়ে বলেছিলেন, “কী কী প্রয়োজন ও জরুরি, তা বলুন।” তাঁরা সব ধরনের সাহায্যের অঙ্গীকার করেছিলেন এবং বাস্তবে সেই সাহায্য এসেছিল।
সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের প্রতি ম্যান্ডেলার চরম ঘৃণা ছিল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। রাষ্ট্রপতি হিসেবেও এবং পরবর্তীতেও ম্যান্ডেলা তার সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছিলেন।
মার্কিন উপরাষ্ট্রপতি ডিক চেনিকে তিনি বলেছিলেন ‘ডাইনোসর’। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, ১৯৮৫ সালে মার্কিন কংগ্রেসে ম্যান্ডেলার মুক্তির আরজি জানিয়ে একটি বিল আসলে চেনি তার বিরোধিতা করেছিলেন।
ইরাক যুদ্ধের ব্যাপারে তিনি মার্কিন ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা জানিয়েছিলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সম্পর্কে ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, “লোকটা কোনো ভালো চিন্তাই করতে পারে না। তিনিই বিশ্বে গণহত্যা চালাবেন। আর সবকিছুই করছেন ইরাকের তেলের জন্য।” বুশের তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’র তীব্র সমালোচক ছিলেন ম্যান্ডেলা। তিনি মার্কিন দেশের বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। ১৯৯০ সালে নিউইয়র্কে কৃষ্ণবর্ণের আমেরিকানদের সমাবেশে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামের প্রশংসা করেছিলেন।
ইজরাইল নিয়ে মার্কিনের ভন্ডামিপূর্ণ ভূমিকার তীব্র নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেছিলেন (২০০২ সাল, নিউজ উইক পত্রিকা), “বুশ বা টনি ব্লেয়ার, কেউই ইরাকে কোনো গণবিধ্বংসী অস্ত্রের প্রমাণ দিতে পারেননি। আমরা জানি, গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে ইজরাইলের কাছে। কিন্তু এ নিয়ে কেউ কথা বলে না।”
সাম্রাজ্যবাদের চোখ রাঙানিকে ভয় পাবার মানুষ নন তিনি, যিনি জীবনের ২৭ বছর ওদের পোষ্য বর্ণবাদীদের কারাগারে নির্যাতিত হয়েছেন। তাছাড়া সাম্রাজ্যবাদ- বিরোধিতা ছিল তাঁর মতাদর্শ ও রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
রাষ্ট্রনায়ক ম্যান্ডেলা: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার উদ্বোধন: লক্ষ্য সমাজতন্ত্র
নেলসন ম্যান্ডেলা কেবল সংগ্রামী নেতাই ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ ও দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক। তিনি সাধারণ রাজনীতিবিদ নন, তাঁর মধ্যে ছিল সেই স্টেটসম্যানশিপের গুণাবলি, যা বিশ্ব ইতিহাসে স্বল্পসংখ্যক রাষ্ট্রনায়কের মধ্যে ছিল।
তিনি বর্ণবাদী সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার উচ্ছেদ ঘটিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার উদ্বোধন ঘটালেন। সংখ্যালঘু কিন্তু দীর্ঘসময়ের অত্যাচারী শ্বেতাঙ্গদের প্রতি তিনি প্রতিহিংসামূলক আচরণ করেননি, যা করাটা অস্বাভাবিক বলে বিবেচিত হতো না। কারণ শ্বেতাঙ্গদের এতকালের আচরণ ও অত্যাচার এতই বর্বর ছিল যে, সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত কৃষ্ণাঙ্গরা তার কিছুটা প্রতিশোধ নেবে না, এমনটা ভাবা যায় না। কিন্তু শ্বেতাঙ্গরা তো পরাজয় বরণ করে নিয়েছে। ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে এবার কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানরা তাদের প্রতি অনুরূপ আচরণ না করে বরং ক্ষমা প্রদর্শনের মতো মহত্ত দেখাতে পেরেছিলেন। এই প্রসঙ্গেই নেলসন ম্যান্ডেলা ‘জাতীয় পুনর্মিত্রতা বা সামঞ্জস্য বিধানে’র (National Reconciliation) নীতির উদ্বোধন ঘটিয়েছিলেন। এটি ছিল একটি নতুন ধারণা, যার তাৎপর্য ছিল যুগান্তকারী ও আন্তর্জাতিক।
কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানরা এইভাবে সভ্যতার একটা নতুন মান সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অন্যদিকে বর্ণবিদ্বেষী শ্বেতাঙ্গরা ইতিহাসের পাতায় নিকৃষ্ট হিসেবেই স্থান পাবে, তারা নিজেদেরকে সভ্যতার স্তরে উন্নীত করতে পারেনি।
বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পশ্চিমা শ্বেতাঙ্গদের আফ্রিকায় চরম বর্বর আচরণের জন্য পশ্চিমা সাদা চামড়ার কবির প্রতি আহ্বান রেখেছিলেন-
“বলো, ক্ষমা করো
হিংস্র প্রলাপের মধ্যে
সেই হোক তোমার সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী।”
শক্তিগর্বে মত্ত পশ্চিমা সাদারা তা পারেনি। কিন্তু ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকায় কৃষ্ণাঙ্গরা পরাজিত শোষক সাদাদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে সভ্যতার উন্নততর ধাপ তৈরি করলেন।
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে পশ্চিমা শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদীরা জনগণের সংগ্রামের কাছে মার খেয়ে এশিয়া-আফ্রিকা থেকে, উপনিবেশ দেশ থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। সবশেষে মুক্ত হলো দক্ষিণ আফ্রিকা। সংখ্যালঘু শাসনের অবসান। বর্ণবাদ থেকে মুক্ত। ফাসিস্ত শাসন থেকে মুক্ত। এই মুক্তিকে সংহত করা খুব সহজ কাজ ছিল না। দক্ষিণ আফ্রিকার সমাজেও বহু ট্রাইব আছে, তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও সংস্কৃতি আছে। উপরন্তু চার শতাংশ শ্বেতাঙ্গ আছে। সর্বোপরি দেশটিতে কোনো গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ও প্রতিষ্ঠান ইতিপূর্বে গড়ে ওঠেনি।
কিন্তু এত সত্ত্বেও দুই দশক ধরে সেই দেশে গণতান্ত্রিক শাসন চলে আসছে। সাদা কালো সকল মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার স্বীকৃত। নিয়মিত নির্বাচন হচ্ছে। যদিও এএনসি ও কমিউনিস্ট পার্টি যৌথভাবে বিজয়ী হয়ে আসছে, তবু সেটাকে একদলীয় শাসন বলা যাবে না। বহু দল ও মতের বৈধ অস্তিত্ব আছে। আফ্রিকার অনেক দেশেই যখন একদলীয় শাসন, সামরিক শাসন, গোত্রগত সংঘর্ষ, নৈরাজ্য ছিল বা এখনো বিরাজ করছে, তখন সেখানে দক্ষিণ আফ্রিকায় চালু রয়েছে চমৎকার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা।
ম্যান্ডেলা National Reconciliation-এর নীতি গ্রহণ করলেও (যে কারণ পাশ্চাত্যের মিডিয়া ও রাজনীতিবিদরা এখন প্রশংসায় পঞ্চমুখ) তিনি কিন্তু এর দ্বারা বর্ণগত ও শ্রেণীগত বৈষম্যকে মেনে নেননি। এইরূপ ভুল বোঝার কোনো অবকাশ নেই।
National Reconciliation-এর নীতি সম্পর্কে দক্ষিণ আফ্রিকান কমিউনিস্ট পার্টি ব্যাখ্যা করেছে এইভাবে-
“The South African Communist Party supported Madibas pioneering of national reconciliation, but national reconciliation for him never meant avoiding tackling the class and other social inequalities in our society, as some would have us believe today. For Comrade Madiba, national reconciliation was a platform to pursue the objective of building a more egalitarian South African society, free of the scourge of racisism, patriarcly and gross inequalities. And true national reconciliation shall never be achieved in a society still charecterized by gaping inequalities and capitalish exploitation.”
হ্যাঁ, ম্যান্ডেলা পুঁজিবাদী শোষণ ও শ্রেণী বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছিলেন। তার রাজনৈতিক কর্মনীতির দুইটি বড় স্তম্ভ ছিল- ১. সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যাভিমুখী আর্থব্যবস্থা, ২. কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে দৃঢ় ঐক্য।
মুক্তি অর্জনের পর থেকেই এএনসি ও কমিউনিস্ট পার্টি জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করে আসছে এবং প্রত্যেকবার বিজয়ী হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সরকার গঠন করে আসছে। ম্যান্ডেলা যে ধারার প্রবর্তন করে গিয়েছিলেন, তা এখনো অব্যাহত আছে।
ম্যান্ডেলা ও তাঁর অনুগামীরা সকলেই সমাজতন্ত্রের প্রশ্নে আন্তরিকভাবে অঙ্গিকারবদ্ধ। অনেক দেশে দেখা গেছে, কখনো কখনো বুর্জোয়া নেতারাও জনগণকে ধোঁকা দেবার জন্য ভুয়া সমাজতন্ত্রের স্লোগান তোলেন। না, তেমনটি ছিল না ম্যান্ডেলার ক্ষেত্রে। এই ক্ষেত্রে বিশ্বের আরেক রাষ্ট্রনায়ক সান-ইয়েৎ-সেনের সঙ্গে ম্যান্ডেলাকে তুলনা করা চলে। উভয় নেতাই কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে দৃঢ় ঐক্যকে তাদের রাজনৈতিক নীতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ বলে ঘোষণা করেছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ঐক্য প্রসঙ্গে ম্যান্ডেলা বলেছেন, “দীর্ঘ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে এই ঐক্য মজবুত হয়েছে। বহু শহীদের রক্তের অক্ষরের লিখিত এই মৈত্রী।”
সমাজতন্ত্র লক্ষ্য হলেও ম্যান্ডেলা সরাসরি সমাজতন্ত্রের পথ নেননি। আফ্রিকান জনগণের বিশেষ পশ্চাৎপদতার কারণে সরাসরি সমাজতন্ত্রের পদক্ষেপ নেয়া বাস্তবে সম্ভব হয়নি। এমনকি এখনো অর্থনীতির মূল কয়েকটি জায়গা শ্বেতাঙ্গদের হাতে রয়েছে। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের একাংশের মধ্যে সমালোচনা আছে। কিন্তু আমার বিবেচনায় এইরকম সমালোচনা সঠিক নয়। ম্যান্ডেলা একই সঙ্গে আদর্শবাদী ও বাস্তববাদী। দক্ষিণ আফ্রিকা সমাজতন্ত্রের পথেই অগ্রসর হবে, তবে ধীরগতিতে।
ম্যান্ডেলার উত্তরাধিকার
নেলসন ম্যান্ডেলার আরেকটি বড় গুণ যে, তিনি ভুল করলে তা স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করতেন না। অত্যন্ত বিনয়ী অমায়িক এই মানুষটি নিজেই বলেছেন, “সংগ্রামের চলার পথে আমি অনেক ভুলও করেছি, কারণ আমি কোনো সিদ্ধপুরুষ (Saint) নই, আমি আন্দোলনের কর্মী মাত্র।” লেনিনও বলেছেন, ভুল করে না এমন মানুষ নেই। কিন্তু তিনিই যথার্থ বিপ্লবী, যিনি দ্রুত ভুল ধরতে পারেন, স্বীকার করেন এবং শোধরানোর চেষ্টা করেন। একই কথা ম্যান্ডেলাও অনেকবার বলেছেন।
নেলসন ম্যান্ডেলার আরেকটি ব্যক্তিগত গুণ হলো, তার বিনয়ী ভাব। বিপুল জনপ্রিয়তা তাঁর মধ্যে মতিভ্রম সৃষ্টি করেনি অথবা তাঁকে অহঙ্কারী করে তোলেনি। ব্যক্তিবাদ যাতে কোনোভাবে তৈরি না হয় সেজন্য তিনি নিজেই সজাগ, সচেতন ও সক্রিয় ছিলেন। তাঁর মধ্যে এই ধরনের যে বিরল গুণাবলি ছিল, তা ইতিহাসের কম রাষ্ট্রনায়কের মধ্যে পাওয়া যাবে।
ম্যান্ডেলা রেখে গেছেন তাঁর নিজ দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য এক সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার। তিনি বিশ্বমানবের জন্য রেখে গেছেন অনুকরণীয় মহান দৃষ্টান্ত। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের শেষপ্রান্তে এসে (১৯৪১ সালে) আশা করেছিলেন প্রাচ্যের দেশ থেকেই উচ্চারিত হবে “সভ্যতার দৈববানী”। (সভ্যতার সংকট) সেই বানী উচ্চারণ করেছেন এশিয়া থেকে মাওসেতুং-হোচিমিন এবং আফ্রিকা থেকে পেট্রিস লুলুম্বা ও নেলসন ম্যান্ডেলা।
ম্যান্ডেলার মৃত্যুর পর দক্ষিণ আফ্রিকান কমিউনিস্ট পার্টি তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে মাও সেতুং-এর সেই বিখ্যাত বক্তব্যটি উদ্ধৃত করেছে। “সকল মানুষকেই মরতে হবে। তবে কোনো কোনো মৃত্যু থাই পাহাড়ের চেয়ে ভারি আর কোনো কোনো মৃত্যু পালকের চেয়েও হালকা। জনগণের জন্য মৃত্যুবরণ হচ্ছে থাই পাহাড়ের চেয়ে ভারি। কিন্তু যারা ফ্যাসিবাদের জন্য কাজ করে এবং শোষক ও অত্যাচারীর সেবা করতে গিয়ে মরে, সে মৃত্যু পালকের চেয়ে হালকা।” এরপর দক্ষিণ আফ্রিকান কমিউনিস্ট পার্টি বলছে, “কমরেড মাদিবা জনগণের জন্য মৃত্যুবরণ করেছেন এবং অবশ্যই তাঁর মৃত্যু সর্বোচ্চ পাহাড়ের চেয়েও ভারি।”
১৯৯৪ সালের নির্বাচনে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হন প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এর আগে ১৯৯৩ সালে এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্কের সঙ্গে যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান তিনি।
তাঁর অসমসাহস, দক্ষ নেতৃত্ব ও নিঃস্বার্থ নীতির জন্য সারা বিশ্বের মানুষ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল। শান্তির সপক্ষে কাজ করা এবং আফ্রিকার নবজাগরণে ভূমিকা রাখার জন্য গত চার দশকে তিনি ২৫০টির বেশি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। সেই সঙ্গে জাতিসংঘ ঘোষিত ‘নেলসন ম্যান্ডেলা আন্তর্জাতিক দিবস’ পালন করা হয়। এই মহান নেতাকে সম্মান জানিয়ে ১৮ জুলাইকে ম্যান্ডেলা দিবস ঘোষণা করেছে জাতিসংঘ। আমরাও শ্রদ্ধা জানিয়ে বলি, ক্রান্তিকালের শ্রেষ্ঠ মত বিপ্লবীরা ধারণ করে। যুগে যুগে বিপ্লবীরা, তারাই যুগের শ্রেষ্ঠ মানব। বিশ্ব ইতিহাসে মানবমুক্তির পথ প্রদর্শকদের অন্যতম, জননন্দিত অবিসংবাদিত নেতা ও রাষ্ট্রনায়ক কমরেড নেলসন ম্যান্ডেলা লাল সালাম।
সৈয়দ আমিরুজ্জামান
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট;
বিশেষ প্রতিনিধি, সাপ্তাহিক নতুনকথা;
সম্পাদক, আরপি নিউজ;
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, জাতীয় কৃষক সমিতি;
সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, মৌলভীবাজার জেলা;
‘৯০-এর মহান গণঅভ্যুত্থানের সংগঠক ও সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী।
সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ খেতমজুর ইউনিয়ন।
সাধারণ সম্পাদক, মাগুরছড়ার গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ আদায় জাতীয় কমিটি।
প্রাক্তন সভাপতি, বাংলাদেশ আইন ছাত্র ফেডারেশন।