পবিপ্রবিতে র‍্যাগিংয়ের দায়ে ২০ শিক্ষার্থী শাস্তির আওতায় ৪ জন একাডেমিক বহিষ্কার

পবিপ্রবি প্রতিনিধি:
র‍্যাগিংয়ের দায়ে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পবিপ্রবি) ২০ শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৪ শিক্ষার্থীকে একাধিক সেমিস্টারের জন্য একাডেমিক বহিষ্কার করা হয়েছে।
শুক্রবার (২৯ নভেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের অনুমোদনক্রমে রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মো. মামুন অর রশিদ স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে এ তথ্য জানানো হয়।
শাস্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের তানভীরুল ইসলাম সিয়াম এবং প্রিতম কারনকে ৩ সেমিস্টার, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের জুনায়েদ হোসাইন ও কৃষি অনুষদের ইউনুস খান ইফতিকে ২ সেমিস্টারের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে।
অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সৌরভ সরকার শাওন, জিহাদ হোসাইন জিম, গোলাম রাব্বি, মো. ওমর ফারুক, খালেদ মাহমুদ রূপক, খালিদ হাসান, ইসতিয়াক আহমেদ রিয়াদ, মো. জুনায়েদ আল হাবিব জিন্নাহ ও সাহিব আহমেদকে ১ বছরের জন্য হল থেকে বহিষ্কার ও নগদ ৫০০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এছাড়াও এ এম জোবায়ের, মো: সোহেল ও সনাতন চন্দ্র রায়কে ৬ মাসের জন্য হল থেকে বহিষ্কার ও নগদ ৩০০০ টাকা জরিমানা এবং ক্যাচিং মং মারমা, মিনহাজুল ইসলাম, মো: নূর মোহাম্মদ সরকারকে ৩০০০ টাকা জরিমানা ও সুপেল চাকমাকে ১০০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে এসব শাস্তি প্রদান করা হয়েছে। অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের একাডেমিক বহিষ্কারকালে ক্যাম্পাসে প্রবেশ এবং হল থেকে বহিষ্কৃতদের হলে অবস্থান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। জরিমানার অর্থ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জমা দিতে ব্যর্থ হলে অতিরিক্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গণরুমে অবস্থানরত ২০২৩-২০২৪ সেশনের নবাগত শিক্ষার্থীদের সাক্ষ্য মতে, “২০২২-২০২৩ সেশনের শিক্ষার্থীরা সিগারেট খেতে খেতে আমাদের গণরুমের ভিতরে ঢুকে পড়ে এবং তারা চিল্লাচিল্লি শুরু করে। সবাইকে ১ মিনিটের মধ্যে রেডি হতে বলে। শার্টের বোতাম গলা পর্যন্ত লাগাতে বলে। সবাইকে জিন্সের প্যান্ট পরতে বলে এবং গায়ে থাকা শীতের কাপড় খুলতে বলে। তিন থেকে চারজন এই কাজে নেতৃত্ব দেয়। সবার মোবাইল ফোনগুলো একটি টেবিলে রাখতে বলে। যাদের মোবাইল রাখতে একটু দেরি হয়েছে-তাদেরকেই অশ্রাব্য গালিগালাজ করতেছিল। সবাইকে দুই হাত খাড়া করে উপরের দিকে ৫ মিনিট রাখতে বলে।
সবাইকে এক দুই করে গুনতে বলে। হাজিরা গুনতে কেউ একজন ভুল করলে পুনরায় প্রথমজন থেকে গুনতে বাধ্য করে। এরপর সবাইকে কান ধরে ওঠ-বস করায়। ১৫০ বারের বেশি কান ধরে উঠতে বসতে বধ্য করে। ওঠা বসা করার সময় যারা পা একটু ফাঁক করে ওঠাবসা করেছে-তাদেরকে আবার নতুন করে ওঠাবসা করিয়েছে। একটু ভুল হলেই গালিগালাজ করেছে। আর মুখের কাছে এসে জোরে জোরে গালি দেয়, এতে ভয়ে আমাদের বুক ধরফর করে উঠে। ২৬ জন ছাত্রকে জানালার গ্রিলে প্রায় পাঁচ থেকে সাত মিনিট ঝুলিয়ে রাখে।
যারা ঠিকমতো ঝুলে থাকতে পারেনি-তাদেরকে মুরগীর মতো বানিয়ে টেবিলের নিচে মাথা ঢুকিয়ে নিচু করে রেখে শাস্তি দেয়। চেয়ার ছাড়া চেয়ারে বসার ভঙ্গিতে শূন্যস্থানে বসে থাকতে বাধ্য করে। প্রায় দেড় থেকে দুই ঘণ্টা ধরে তাদের নির্যাতন চলতে থাকে। সব মিলিয়ে রাত সাড়ে বারোটা থেকে দুইটার পর পর্যন্ত এই ঘটনাটি ঘটে। স্যাররা দুইটার পরে হলে চলে আসে। তারপর তাদের কয়েকজনকে ধরে ফেলে। ঘটনার সময় তারা তাদের নাম গোপন রাখে।
নিজেদের নাম না বলে একে অপরকে তারা কাকা বলে সম্বোধন করে। তারা আমাদেরকে বেয়াদব বলে গালি দেয়। প্রভোস্ট ভাই তোদের বাঁচাতে পারবে না এই বলেও গালি দেয়। এ নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ৬ জন ছাত্র অসুস্থ হয়ে পড়ে। চারজনকে স্যারদের সহযোগিতায় হাসপাতালে নেওয়া হয়। এদের মধ্যে দুইজনের হাঁপানি শুরু হয়ে যায়। একজনের অবস্থা খুবই মারাত্মক হয়ে যায়। তাকে দুমকি উপজেলা হাসপাতাল থেকে পরবর্তীতে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। র‍্যাগ দেয়ার সময় তারা আমাদেরকে অনেকগুলো নিয়ম-কানুন শেখায়।
তারা বলে “সবার আগে ব্যাচমেট, এরপরে ইমিডিয়েট সিনিয়র ভাই, এরপরে আর কেউ নাই”। তারা আমাদেরকে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া নিষিদ্ধ করে। আমাদের জন্য নিষিদ্ধ স্থানগুলো হল-হলের রিডিং রুম, কমনরুম, ক্যান্টিন, হল সংলগ্ন খেলার মাঠ, তালতলা, খেজুরতলা, বকুলতলা, নীলকমল সেতু, প্যারিস রোড, কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ, টিএসসি, সেন্ট্রাল ল্যাবরেটরি, সেন্ট্রাল লাইব্রেরি ও জিমনেসিয়াম। তারা আমাদেরকে বলে আমরা টি শার্ট পড়তে পারব না। ট্রাউজার, লুঙ্গি এগুলোও পড়া যাবে না। হল থেকে একাডেমিক ভবনে আসার সময় ফার্ম বিল্ডিং পর্যন্ত কুকুরের সাথে দেখা হলেও সালাম দিতে হবে। কারণ কুকুরগুলো তোদের চেয়ে সিনিয়র। তারা বলে, গাছপালাকেও সালাম দিতে হবে। কারণ এগুলো তোদের চেয়ে সিনিয়র।”
উল্লেখ্য, গত ২৩ নভেম্বর রাতে এম. কেরামত আলী হলে নবাগত শিক্ষার্থীদের উপর র‍্যাগিং চালানো হয়। নির্যাতনের ফলে কয়েকজন শিক্ষার্থী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে ঘটনা প্রকাশ পায়। জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে হয়রানি করে, যার মধ্যে ছিল শারীরিক শাস্তি, অবমাননাকর ভাষা ব্যবহার, এবং গণরুমে অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি।
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন
বিষয়: * ৪ জন একাডেমিক বহিষ্কার * পবিপ্রবিতে র‍্যাগিংয়ের দায়ে ২০ শিক্ষার্থী শাস্তির আওতায়