মোহরানা না তালাকানা
রিদা(ছদ্মানাম), ৮০র দশকে শিশুকালে বাবার মৃত্যুর পর মায়ের সাথে আরো কয়েক ভাইবোন সহ গ্রাম ছেড়ে যার জায়গা হয় ঢাকা শহরের বস্তিতে। মা মানুষের বাসায় এবং ভায়েরা তৎকালীন টেম্পুতে হেল্পারীসহ ভিভিন্ন কাজ করে সংসার খরচ জোগাড় করলেও রিদার সুযোগ হয় দশম শ্রেণি অব্ধি পড়ার। এরপর বিয়ে হয় পাবনা জেলার এক ছেলের সাথে সেখানে এক কন্যা সন্তানের জন্ম হওয়ার পর হয় বিচ্ছেদ।
তারপর বিয়ে হয় নড়াইল জেলায়। সে ঘরে জন্ম হয় আরেক কন্যার। সেখানেও বিবাহ বিচ্ছেদ হলে তৃতীয়বারের মত আরেকটি বিয়ে হয় যার সাথে তারও গ্রামে স্ত্রী সন্তানসহ আরেকটি পরিবার রয়েছে এবং সে দ্বিতীয় স্ত্রী রিদাকে নিয়ে ঢাকা শহরেই থাকে।
রিদার প্রথম ঘরের কন্যার বয়স এতদিনে ১৬/১৭ এবং দ্বিতীয় ঘরের কন্যার বয়স ১০/১২ বছরে পৌঁছেছে। এটি একটি স্বাভাবিক ঘটনা হলেও রিদার তৃতীয় বিয়ে হওয়ার পরও দ্বিতীয় স্বামীর পরিবারে যাওয়া—আসা রয়েছে। এমনকি প্রত্যেক ঈদেই প্রায় দ্বিতীয় স্বামীর পবিারের সাথে সময় অতিবাহিত করে। দ্বিতীয় স্বামী ও তার পরিবার রিদার তৃতীয় বিয়ের খবর জানেনা। যদিও দ্বিতীয় স্বামীর সাথে তার যোগাযোগ হয়না।
সর্বশেষ তথ্যমতে তৃতীয় স্বামীর সাথেও বিচ্ছেদ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু বিচ্ছেদ হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা শুধু দেনমোহর। কেননা বিয়ের সময় দেনমোহর আদায় করা হয়নি। রিদা তালাক দিলে সে ধার্যকৃত দেনমোহর পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে এই আশঙ্কায় নিজে তালাক না দিয়ে তার স্বামীকে তালাক দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। আবার রিদার স্বামীও নিজে তালাক দিলে দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে তাই রিদাকেই তালাক দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে।
অন্যদিকে ডলির(ছদ্মনাম) চার বিয়ে হয় এবং আমার দর্শক হিসেবে উপস্থিত থাকার সুযোগ হয় তিনবারই। এছাড়াও নাকি আরেকটি বিয়ে হয়েছে যেটি আমি শুনেছি মাত্র। প্রতিবারই বিচ্ছেদের সময় দেনমোহর পরিশোধ করা নিয়ে পারিবারিক, সামাজিক বিশৃঙ্খলা তৎপর্বর্তীতে শালিশ বিচার করতে হয়েছে।
আবার টুনটুনির বিয়ে হয় আইন-আদালতের মাধ্যমে ২০১৪ সালের দিকে ১০ আখ টাকা দেনমোহর ধার্য করে। বিয়ের সময় ১ টাকা দেনমোহরও পরিশোধ করা হয়নি। বিয়ের পূর্বের ন্যায় পরেও তাদের ঝামেলা চলতে থাকে। প্রায় ১০ বছর ধরে অনেক বিশৃঙ্খলা এবং শালিশ বিচার হয়েছে। তবে বিচ্ছেদ হয়নি শুধু দেনমোহর পরিশোধ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে। অবশেষে টুনটুনির পরিবার ধৈর্য হারা হয়ে দেনমোহরের আশায় না থেকে অক্টোবর ২০২৪ তালাক পাঠিয়ে দিয়েছেন।
মাঝে মধ্যে কাজীর দায়ীত্ব পালন করার কারণে এরকম অনেক তথ্য জানতে হয়। কিছু দিন আগে এক বিয়ের রেজিস্ট্রেশন করতে গিয়ে জানতে পারলাম কন্যার আগেও দুই তিনবার বিয়ে হয়েছিল। প্রত্যেকবারই বিয়ের সময় নয় বরং বিচ্ছেদর সময় বিশৃঙ্খলার পর ধার্যকৃত দেনমোহর পরিশোধ করা হয়েছে শালিশ বিচারের মাধ্যমে।
বাংলাদেশে দেনমোহর পরিশোধ না করার অথবা বিচ্ছেদের সময় পরিশোধ করার এক সামাজিক রীতিতে পরিনত হয়েছে। দেনমোহর এখন আর মোহরানা নয় তালাকানায় পরিনত হয়েছে। দেনমোহর সময়মতো আদায় না করার কারণে অহরহ মামলা মোকদ্দমা সামাজিক বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে। এমনকি বিচ্ছেদের সময় মোহরানা এড়াতে খুন খারাবি পর্যন্ত হচ্ছে।
মোহরানা সঠিকভাবে আদায় না করার সামাজিক কিছু কুফল পরিলক্ষিত হলো। মোহরানা বিষয়ে মহান আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা পবিত্র কোরআনে যে হুকুম নাজিল করেছেন সেটি জানার চেষ্টা করি।
‘অতএব (স্ত্রীদের)তাদের নিকট থেকে তোমরা যে আনন্দ উপভোগ করেছ (সে কারণে) তাদের ধার্যকৃত মোহর তাদেরকে প্রদান করবে। আর মোহর নির্ধারিত থাকার পরও কোনো বিষয়ে পরস্পর সম্মত হলে তাতে তোমাদের কোনো অপরাধ হবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা নিসা: আয়াত ২৪)
আল্লাহ তায়ালা মোহরানা বিষয়ে নারীদের একচ্ছত্র অধিপত্য ঘোষণা করে বলেন ‘আর তোমরা নারীদের সন্তুষ্টচিত্তে তাদের মোহর দিয়ে দাও, অতঃপর যদি তারা তা থেকে খুশি হয়ে তোমাদের জন্য কিছু ছাড় দেয়, তাহলে তোমরা তা স্বানন্দে গ্রহন কর।’ (সুরা নিসা: আয়াত ৪)
আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা বৈধ অবিভাবকদের অনুমতিক্রমে বিয়ে করে মোহরানা দিতে জোর দিয়েছেন ‘সুতরাং তোমরা তাদেরকে তাদের মালিকদের অনুমতিক্রমে বিয়ে করো এবং ন্যায়সঙ্গতভাবে তাদেরকে তাদের মোহর দিয়ে দাও।’ (সুরা নিসা: আয়াত ২৫)
মোহরানা শুধু সাধারণ মানুষ নয় নবি রাসুলের জন্যও ফরজ করে ঘোষণা করেন ‘হে নবী! আপনার জন্য আপনার স্ত্রীগণকে হালাল করেছি, যাদের আপনি মোহরানা প্রদান করেন।’ (সুরা আহযাব : আয়াত ৫০)
মোহরানা যদিও স্ত্রীদের সাথে আনন্দ উপভোগ করার বিনিময় স্বরূপ। তথাপি স্ত্রীকে স্পর্শ না করলেও বা মোহরানা ধার্য করা না হলেও কিছু পরিমাণ মোহরানা দিতে আদেশ করে মহান আল্লাহ আরো বলেন ‘স্ত্রীদেরকে স্পর্শ করার আগে এবং কোন মোহরানা সাব্যস্ত করার পূর্বেও যদি তালাক দিয়ে দাও, তবে তাতেও তোমাদের কোন পাপ নেই। তবে তাদেরকে কিছু খরচ দেবে। আর সামর্থ্যবানদের জন্য তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী এবং কম সামর্থ্যবানদের জন্য তাদের সাধ্য অনুযায়ী। যে খরচ প্রচলিত রয়েছে তা সৎকর্মশীলদের উপর দায়িত্ব।’ (সূরা আল বাক্বারাহ: আয়াত ২৩৬)
আর মোহরানা সাব্যস্ত হলে এবং স্ত্রীকে স্পর্শ না করলেও ধার্যকৃত মোহরানার অর্ধেক দিয়ে দেওয়ার হুকুম নাজিল করেছেন ‘আর যদি মোহর সাব্যস্ত করার পর স্পর্শ করার পূর্বে তালাক দিয়ে দাও, তাহলে যে, মোহর সাব্যস্ত করা হয়েছে তার অর্ধেক দিয়ে দিতে হবে। অবশ্য যদি নারীরা ক্ষমা করে দেয় কিংবা বিয়ের বন্ধন যার অধিকারে সে (অর্থাৎ, স্বামী) যদি ক্ষমা করে দেয় তবে তা স্বতন্ত্র কথা। আর তোমরা পুরুষরা যদি ক্ষমা কর, তবে তা হবে পরহেযগারীর নিকটবর্তী। আর পারস্পরিক সহানুভূতির কথা বিস্মৃত হয়ো না। নিশ্চয় তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ সেসবই অত্যন্ত ভাল করে দেখেন।’ (সূরা আল বাক্বারাহ: আয়াত ২৩৭)
স্ত্রীদের প্রদত্ত মোহরানা ফেরত নিতে নিষেধ করেছেন আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা বলেন ‘যদি তোমরা এক স্ত্রীর স্থলে অন্য স্ত্রী পরিবর্তন করতে ইচ্ছা কর এবং তাদের একজনকে প্রচুর ধন-সম্পদ প্রদান করে থাক, তবে তা থেকে কিছুই ফেরত গ্রহণ করো না। তোমরা কি তা অন্যায়ভাবে ও প্রকাশ্য গোনাহর মাধ্যমে গ্রহণ করবে?’ (সূরা আন নিসা: আয়াত ২০)
যেহেতু মোহরানা স্ত্রীদের সাথে আনন্দ করার বিনিময় সেহেতু স্ত্রীদের স্পর্শ করলে তাদের কে প্রদত্ত মোহরানা আর ফেরত নেওয়া যাবেনা ‘তোমরা কিরূপে তা গ্রহণ করতে পার, অথচ তোমাদের একজন অন্য জনের কাছে গমন এবং নারীরা তোমাদের কাছে থেকে সুদৃঢ় অঙ্গীকার গ্রহণ করেছে।’ (সূরা আন নিসা: আয়াত ২১)
মোহরানা দিয়েও কিছু নারীকে বিয়ে করা হারাম এবং যাদের কে বিয়ে করা যাবে তাদের মোহরানা দেওয়া ফরজ করেছেন মহান আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা ‘উল্লেখিত (অবৈধ) নারীগণ ব্যতীত অন্যান্য নারীগণকে তোমাদের জন্য বৈধ করা হয়েছে, শর্ত এই যে, তোমরা তোমাদের স্বীয় অর্থের বিনিময়ে তাদেরকে তলব করবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য, ব্যভিচারের জন্য নয়। তাদের মধ্যে যাদেরকে তোমরা উপভোগ করবে তাদেরকে নির্ধারিত মোহর অর্পণ করবে।’ (সূরা আন-নিসা: আয়াত ২৪)
মোহরানা সঠিকভাবে আদায় না করার কারণে সামাজিক বিশৃঙ্খলা যেমন হচ্ছে তেমন স্ত্রীকে স্পর্শ করার পূর্বেই দেনমোহর পরিশোধ করা ইসলামের হুকুম ফরজ ভঙ্গকারী জিনাকারী হিসাবে সাব্যস্ত হচ্ছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে আইন করে সামাজিক বিশৃঙ্খলা রোধ এবং মিনাকারীর শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি।
লেখক:
এমফিল গবেষক(এবিডি)
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।