ঘূর্ণিঝড় মিধিলি’র এক বছরে স্বজন হারানোর কান্না থামেনি এখনও

 রাঙ্গাবালী  পটুয়াখালী:
 তিন বোনের তিন ছেলে সাইফুল, তামিম ও জিসান। পেটের তাগিদে ভয়কে জয় করেছিলেন তারা। জীবনের ঝুঁকি জেনেও উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিতে শিখে গিয়েছিলেন। সংসারের  খরচ জোগাতে গভীর সাগরে মাছ ধরতে যাওয়াই ছিল তাদের একমাত্র পেশা। কিন্তু  এই সমুদ্র যাত্রায় গিয়ে  এমন বিপদ ডেকে  আনবে তা জানা  ছিল না কারও। ঘূর্ণিঝড় মিধিলি’র এক বছর হয়েছে । ২০২৩ সালের   গভীর বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছিলেন পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীর তিন ট্রলারের ২৫ জেলে। নিখোঁজদের মধ্যে সাইফুল, তামিম ও জিসানও রয়েছেন। এফবি হাসান নামক ট্রলারে একসাথে মাছ ধরতে গিয়ে এই তিন খালাতো ভাই নিখোঁজ হয়েছিলেন।
তাদের কারও সন্ধান মেলেনি আজও। তাইতো কান্না থামছে না সাইফুল, তামিম ও জিসানের পরিবারে। তাদের  ফিরে আসার প্রতীক্ষায় এখনও পরিবার। উপার্জনক্ষম তিন সদস্যকে হারিয়ে তিন পরিবারের দিন কাটছে চরম অভাব-অনটনে। সরেজমিনে গিয়ে এমন তথ্য জানা যায়। বুকে পাহাড়সমান কষ্ট নিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত পার করছেন সাইফুলের মা জাহানারা বেগম। রাঙ্গাবালীর ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়নের নয়াভাংগুনী আবাসনে অবস্থিত তাদের বাড়িতে কেউ পা রাখলেই তিনি ভাবেন হয়তো তার ছেলের কোন খবর নিয়ে এসেছেন কেউ। বাড়িতে গিয়ে নিখোঁজ ছেলে প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দু’ চোখের অশ্রু ফেলে কান্নায় ভেঙে পড়েন জাহানারা বেগম।
পরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘নাতি জিজ্ঞেস করে আমার বাবা কই? কিন্তু আমারতো কোন জবাব নাই। কোথা থেকে তার বাবাকে এনে দিব? অনেক জায়গায় খোঁজাখুজি করছি। পাথরঘাটা, সুন্দরবনসহ বহু জায়গায় খুঁজছি। কোন জায়গায় খবর পাই নাই ছেলের। উপজেলায় যাই। কাগজপত্র দেই। কিন্তু তারা কোন খবর আমাদের দিতে পারে নাই। কাগজপত্র কি তারা উপারে পাঠায় নাকি ফাইলে ফেলে রাখে তা জানি না।
শাশুড়ীর পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন সাইফুলের স্ত্রী কবিতা। এক বছর সাত মাস বয়সী ছেলে ইসানকে নিয়ে কবিতা নিরুপায় হয়ে স্বামী সাইফুলের ফিরে আসার প্রহর গুনছেন। কাঁদতে কাঁদতে যেন চোখের পানিই শুকিয়ে গেছে তার। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাকে আর তার শিশু সন্তানকে। কবিতা বলেন, ‘এক বছরেও আমার স্বামীর কোন খোঁজ পাইনি। সারাক্ষণ ছেলেটা বাবা বাবা বলে ডাকে। আল্লাহ যেন আমার স্বামীকে ফিরে দেয় এই শিশু সন্তানের জন্য হলেও।
সাইফুলের খালাতো ভাই জিসানের পরিবারও উৎকণ্ঠায় রয়েছেন। জিসানের মা নারজু বেগম পথ চেয়ে থাকেন ছেলে ফিরে আসবে এমন বিশ্বাস নিয়ে। ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়নের কোড়ালিয়া গ্রামে বসবাসরত টানাপোড়নের সংসারে মা-বাবা, দুই ভাই-বোনসহ পাঁচ সদস্যের সংসারে জিসান ছিল তাদের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ। এখন অসুস্থ বাবা ঝিলাম প্যাদা দিনমজুরের কাজ করে ধরেছেন সংসারের হাল।
প্রতিবেদক জিসানের বাড়িতে গেলে কান্নায় ভেঙে পড়েন মা নারজু বেগম। তিনি বলেন, ‘জিসানের আয়ের টাকায় সংসার চলতো। এখন অনেক কষ্টে আছি। কিস্তির জ্বালা, সংসারের খরচ, ছেলে-মেয়ে পড়ানোর খরচ ঠিকমত  চালাতে পারছি না। না খেয়েও যদি থাকি, তবুও ছেলেকে ফিরে পেলে মনে কোন কষ্ট থাকবে না। আমার ছেলেকে ফিরে পেতে চাই।’
ভিন্নতা নেই সাইফুল-জিসানের আরেক খালতো ভাই তামিমের পরিবারেও। একই ইউনিয়নের নয়াভাংগুনি গ্রামের আবাসনে ছেলের উপার্জনের টাকায় চলতো তামিদের সংসার। ছেলে নেই, এখন মা রাস্তায় মাটির কাজ করে চালান সংসার। ছেলের শোকে কাতর সেও।
শুধু সাইফুল, তামিম আর জিসান নয় নিখোঁজ বাকি ২২ জেলে পরিবারও একই শোক বয়ে বেড়াচ্ছে। দিনের পর দিন গিয়ে মাসের পর মাস গড়িয়ে বছর হলেও ২৫ জেলের কারও সন্ধান মেলেনি এখনও। তারা কোথায় আছেন, কিভাবে আছেন? বেঁচে আছে কিনা মরে গেছেন সেই প্রশ্ন খুঁজছেন পরিবারের লোকেরা। সংসারের উপার্জনক্ষমত এই মানুষগুলোর কোন সন্ধান না পাওয়ায় দিশেহারা তারা। তবুও প্রিয়জন ফিরে আসার প্রতীক্ষায় আজও পথ চেয়ে আছেন কারও মা-বাবা, কারও ভাই-বোন এবং কারও স্ত্রী-সন্তান। এখনও নিখোঁজদের  কথা মনে করে চোখের অশ্রু ফেলছেন তারা, কেউ হয়েছেন শোকে পাথর। তবে অনেকেরই ধারণা-বেঁচে থাকলে হয়তো ঝড়ের তান্ডবে প্রতিবেশী  কোন দেশের (ভারত-মিয়ানমার) জলসীমায় প্রবেশ করায় সে দেশের জেলহাজতে আছেন তারা।
জানা গেছে, গতবছরের ১৭ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় মিধিলিতে রাঙ্গাবালীর ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়নের কাউখালী গ্রামের হাসান জোমাদ্দারের মালিকানাধীন জেলে ট্রলারের ৮জন, মৌডুবি ইউনিয়নের কাজিকান্দা গ্রামের দিদার মৃধার ট্রলারের ৮জন এবং একই এলাকার হিমু হাওলাদারের মালিকানাধীন ট্রলারের ৯ জন নিখোঁজ হয়েছিলেন। উপজেলা মেরিন ফিশারিজ কর্মকর্তা মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘নিখোঁজ জেলেদের তালিকা মৎস্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। তাদের সন্ধানের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিখোঁজ জেলেদের পরিবারকে বিভিন্ন সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ, একোয়াকালচার ও মেরিন সায়েন্স অনুষদের শিক্ষক ও গবেষক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘গভীর সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া ট্রলারগুলোর অবস্থান নির্ণয়ের জন্য জিপিএস ট্র্যাকার থাকা দরকার। পাশাপাশি এমন একটি ডিভাইস থাকা দরকার, যাতে তারা বিপদে পড়লে সেই সংবাদ জানাতে পারে।  এছাড়া জেলেদের নিরাপত্তায় লাইফ জ্যাকেট কিংবা লাইফ বয়া নিশ্চিত করা। গভীর সাগরে মোবাইল নেটওয়ার্ক সুবিধা চালু এবং আবহাওয়ার পূর্বাভাসের জন্য রেডিও সিস্টেমেরও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

বিষয়: * ঘূর্ণিঝড় মিধিলি’র এক বছরে স্বজন হারানোর কান্না থামেনি এখনও