সিটিজেন জার্নালিজম বা নাগরিক সাংবাদিকতা প্রসঙ্গে
গণমাধ্যমকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। অপর তিনটি স্তম্ভ হচ্ছে, আইনসভা, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ। বোঝাই যাচ্ছে গণমাধ্যমের গুরুত্ব ও অবস্থান কোথায়! জনস্বার্থ অভিমুখী মুক্ত গণমাধ্যম ছাড়া একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পূর্ণতা পায় না। সরকার ও প্রশাসনের অসঙ্গতি ধরিয়ে দেওয়াসহ জনগণের সংগ্রামের সহযোদ্ধা হিসেবে গণমাধ্যমকে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করতে হয়।
আসলে গণমাধ্যম হচ্ছে জনগণের সংগ্রামের সহযোদ্ধা, নীতি-আদর্শের যৌথ প্রচারক ও যৌথ আন্দোলনকারী, জনস্বার্থ ও রাষ্ট্রের পাহারাদার। গণমাধ্যমই সঠিক পথ বাতলে দেয় যাতে সরকার, প্রশাসন ও জনগণ সঠিক পথে পরিচালিত হতে পারে। গণমাধ্যম সরকার, প্রশাসন ও জনগণের প্রতিপক্ষ নয়; তবে জনস্বার্থে নজরদারী করবে। কাজেই বলিষ্ট ও শক্তিশালী গণমাধ্যম ছাড়া জনস্বার্থের রাষ্ট্রব্যবস্থা শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারে না।
রাষ্ট্রের অন্য তিনটি স্তম্ভ নড়বড়ে হয়ে গেলেও চতুর্থ স্তম্ভ শক্ত থাকলে রাষ্ট্রকে গণমুখী রাখা যায়। আর চতুর্থ স্তম্ভ নড়বড়ে হলে রাষ্ট্রব্যবস্থা গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, রাষ্ট্র বিপদগ্রস্ত হয়।
আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব আশাবাদী মানুষ। আঁধার কেটে নিশ্চয়ই আলো আসবে। কিন্তু সেটা কি প্রকৃতির নিয়মে হবে? কাউকে না কাউকে ভূমিকা পালন করতে হয়।
সাংবাদিকতায় ঝুঁকি থাকবেই। সজাগ ও সচেতন থাকলে সৎ ও নিষ্ঠাবান সাংবাদিকরা হারিয়ে যাবেনা। সাংবাদিকতার ডিকশনারি থেকে সততা ও পেশাদারিত্ব শব্দ দুটি কখনই বিলীন হবে না। সেখানে অসৎ আর হলুদ সাংবাদিকতার স্থান নেই। একটু খেয়াল করলে দেখবেন, হলুদ সাংবাদিকতার ভয়ে মানুষ তটস্থ।
হলুদ সাংবাদিকদের কারণে এখন প্রবাদটির নতুন সংস্করণ হয়েছে। এখন বলা হচ্ছে, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, হলুদ সাংবাদিকরা ছুঁলে ৭২ ঘা। কেউ বিশ্বাস করুন বা না করুন পরিস্থিতিটা এমনই দাঁড়িয়েছে।
অনেকে বলেন, হলুদ সাংবাদিকদের দাপট অনেক বেশি। যদিও পেশাদার ও সৎ সাংবাদিকরাই সবচেয়ে বেশি মর্যাদাবান ও আদর্শিক।
পেশাদার ও সৎ সাংবাদিকরাই টিকে থাকবেন। যারা টিকে আছেন তাদের অভিবাদন জানাই। তারা সত্যি সত্যিই এই পেশাকে ব্রত হিসেবে নিয়েছেন।
আমার মনে হয়, সৎ ও পেশাদার সাংবাদিকরা সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে টিকে থাকবে।
যারা নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে সাংবাদিকতার মতো মহান পেশাকে ব্রত হিসেবে নিতে চান তারাই টিকে থাকবেন। সবাইকে দিয়ে এই কাজ হবে না।
এ কথা এ কারণে বলছি যে, সততা, নিষ্ঠা ও পেশাদারিত্ব ছাড়া সুসাংবাদিকতা হয় না। আগে মনেপ্রাণে এই তিনটি বিষয় ধারণ করতে হবে। সাংবাদিকতা পেশার সামগ্রিক স্বার্থেই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে।
কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেলেই লিখে দিতে হবে তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। ভালোভাবে যাচাই করতে হবে। একজন রিপোর্টারের কলমের খোঁচায় অনেক বড় ক্ষতি হতে পারে। আবার অনেক বড় উপকারও হতে পারে। মানুষের উপকারের বিষয়টিই আমাদের মাথায় রাখতে হবে। দেশ ও দেশের মানুষের মঙ্গল সাধনই তো সাংবাদিকদের কাজ।
নাগরিক সাংবাদিকতার ধারণা-
স্বতস্ফূর্ত ও স্বপ্রণোদিত হয়ে গণমানুষের খবর ও তথ্য সংগ্রহ, পরিবেশন, বিশ্লেষণ এবং প্রচারে অংশগ্রহণ করাই হচ্ছে সিটিজেন জার্নালিজম বা নাগরিক সাংবাদিকতা। এ সাংবাদিকতায় প্রাতিষ্ঠানিক কোনো স্বীকৃতি, পরিচয় এবং প্রশিক্ষণ ছাড়াই আধুনিক প্রযুক্তি ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে সাধারণ জনগণ নিজেরা বা অন্যের সহায়তায় তথ্যের আদান প্রদান করে থাকে। নাগরিক সাংবাদিকতার ধারণায় মূল ধারার গণমাধ্যমে যারা পাঠক, দর্শক ও শ্রোতা হিসেবে বিবেচিত হন তারাই মূলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরস্পরের তথ্য-উপাত্ত আদান প্রদান করে থাকেন।
বিজ্ঞাপন নির্ভর বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালিত মূল ধারার গণমাধ্যমের একাংশের আধেয় তৈরি ও প্রচারের বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব যুক্ত নাগরিক সাংবাদিকতা আজ সাধারণ মানুষের কাছে প্রকৃত মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত। ক্ষেত্রবিশেষে মালিক পক্ষের স্বার্থ, বহুজাতিক কোস্পানিসহ বিভিন্ন বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠান এবং সংবাদমূল্য ও এজেন্ডা সেটিং এর মতো প্রচলিত ধারার গেটকিপারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা পালনের সুযোগ অপেক্ষাকৃত কম থাকায়, নাগরিক সাংবাদিকতার মাধ্যমে সত্যিকার অর্থে গণমানুষের স্বার্থে কাজ করার অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
৯০’র দশকের শেষের দিকে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব ধারণার আর্বিভাব মূল ধারার গণমাধ্যমের আধেয় উপস্থাপনের ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করে। জ্য রোসেনস্ এর মতে প্রচলিত মূলধারার গণমাধ্যমে যারা পাঠক, দর্শক ও শ্রোতা তারাই হচ্ছে নাগরিক সাংবাদিকতার নীতি-নির্ধারক তথা সাংবাদিক, মালিক ও সম্পাদক। এক সময় যারা শুধু গণমাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত তথ্য-উপাত্তের ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতো, তথ্য প্রযুক্তির অপার সম্ভাবনার এই সময়ে তারাই সংবাদ তৈরি ও প্রচার করছে।
নাগরিক সাংবাদিকতার একটি গুরত্বপূর্ণ দিক হলো এটা নির্দিষ্ট ভৌগলিক কোনো সীমারেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ না। নির্দিষ্ট ভাষাভাষির সকলেই বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে বসে তার চারপাশের ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহ তুলে ধরতে পারেন, প্রতিবাদ জানাতে পারেন কিংবা একাত্মতা ঘোষণা করতে পারেন।
সিটিজেন জার্নালিজমের মাধ্যমে একজন সচেতন নাগরিক তার নিজের জ্ঞান ও সৃজনশীলতা সমাজের প্রয়োজনে নিয়োজিত করতে পারেন। আর তাই, সাংবাদিকতার কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা পরিচয় ছাড়া অনলাইন ভিত্তিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে যখন কেউ তার চারপাশের ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা, বিষয় সম্পর্কে নিজস্ব মতামত কিংবা সঠিক তথ্য-উপাত্ত লেখনী, তথ্যচিত্র, ইনফোগ্রাফিক্স, ক্ষুদেবার্তা, অডিও, ভিডিও বা অন্য কোনো ভাবে জনস্বার্থে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসমূহে প্রচার বা প্রকাশ করে, তাহলে তাকে নাগরিক সাংবাদিকতা বলা যেতে পারে।
নাগরিক সাংবাদিকতার উদ্ভব ও বিকাশ:
নব্বই’র দশকে ইন্টারনেট ভিত্তিক world wide web এর আর্বিভাবকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উদ্ভব। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি’র ছাত্র ক্রিস অ্যান্ডারন্স বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সিয়াটলে গৃহীত বিতর্কিত সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ১৯৯৯ সালে ‘ইন্ডিমিডিয়া’ (Indy media) নামে নাগরিক সাংবাদিকতার (সিটিজেন জার্নালিজম) প্রথম স্বীকৃত প্লাটফরম প্রতিষ্ঠা করেন।
বহুল ব্যবহৃত সার্চ ইঞ্জিন গুগলের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৮ সালে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ফেজবুক ২০০৪ সালে, টুইটার ২০০৬ সালে এবং অ্যাপলে-আই ফোন ২০০৭ সালে। এদের আর্বিভাব ও উদ্ভাবন নাগরিক সাংবাদিকতার ধারণা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। একইসাথে সহজ প্রযুক্তি নির্ভর স্মার্টফোনের আর্বিভাব নাগরিক সাংবাদিকতার অগ্রযাত্রাকে আরো ত্বরান্বিত করছে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ক্ষুদে বার্তা প্রেরণ, ছবি, ভিডিও ধারণ ও আপলোড করার সুবিধা নাগরিক সাংবাদিকতা আরও সহজতর করেছে।
তবে স্বীকৃত না হলেও নাগরিক সাংবাদিকতার ধারণা একেবারেই নতুন কিছু নয়। আব্রাহাম জ্যাপ্রুডার জন এফ কেনেডি’র হত্যাকান্ডের ভিডিওচিত্রটি ধারণ করেছিলেন একটি সাধারণ ক্যামেরা দিয়ে। অনেকেই তাকে নাগরিক সাংবাদিকতার জনক বলে মনে করেন।
ম্যাট ড্রাডজ ১৯৯৬ সালে হলিউডের নায়ক নায়িকাদের মুখরোচক নানা ঘটনা এবং মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের রেটিং সংক্রান্ত তথ্য ও উপাত্ত ই- মেইলের সাহায্য নির্দিষ্ট কিছু গ্রাহকের কাছে পাঠাতেন। ১৯৯৮ সালের জানুয়ারিতে ড্রাডজ জানতে পারেন যে, বিল ক্লিনটন ও মনিকা লিউনিস্কি নামে হোয়াইট হাউজের একজন শিক্ষানবীশের যৌন কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রভাবশালী গণমাধ্যম ‘নিউজউইক’ জানা সত্বেও এড়িয়ে যাচ্ছে। নিউইয়র্কের একজন এজেন্টের সাথে কথা বলে তিনি ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হন এবং তার ই-মেইল গ্রাহকদের কাছে প্রকাশ করেন। এই ঘটনাটি প্রচলিত মূল ধারার গণমাধ্যম সম্পর্কে মানুষ কিছুটা হলেও সন্দিহান করে তোলে এবং বিকল্প মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ভিত্তিক নানা মাধ্যমের আর্বিভাব ঘটতে থাকে। অন্যভাবে বললে ইন্টারনেটসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসমূহ নাগরিক সাংবাদিকতার উদ্ভব ও বিকাশকে ত্বরান্বিত করেছে। বিল ক্লিনটনের এই ঘটনাটি সাংবাদিতার ইতিহাসে ই-ওটারগেট কেলেঙ্কারি নামে পরিচিত। পরবর্তী সময়ে মূল ধারার গণমাধ্যমসমূহ এ ব্যাপারে বিস্তারিত সংবাদ প্রচার শুরু করে।
এখন সিএনএন, বিবিসি, আল জাজিরা, অারপি নিউজ ও বিডিনিউজের মতো মূল ধারার গণমাধ্যম অনেক ক্ষেত্রেই নাগরিক সাংবাদিকতার ওপর নির্ভর করছে। সংবাদ সূত্র হিসেবে নাগরিক সাংবাদিকদের ব্যবহারের পাশাপাশি অনলাইনে প্রকাশিত প্রতিটি প্রতিবেদনের শেষাংশে ঘটনাস্থলের আশেপাশের পাঠকদের তাঁদের মতামত বা মন্তব্য তুলে ধরতে অনুরোধ করছে। আর সাম্প্রতিক এই ধারা থেকে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি যে মূল ধারার গণমাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত অনেক সংবাদই প্রথম ছড়িয়ে পড়েছিলো বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
বিভিন্ন নামে নাগরিক সাংবাদিকতা:
প্রান্তিক সাংবাদিকতা (Grassroots Journalism), নেটওয়ার্ক সাংবাদিকতা (Network Journalism), ওপেন সোর্স সাংবাদিকতা (Open Source Journalism), নাগরিক মাধ্যম (Citizen Journalism), অংশগ্রহণমূলক সাংবাদিকতা (Participatory Journalism), হাইপার লোকাল সাংবাদিকতা (Hyper local Journalism), বটম-আপ সাংবাদিকতা (Bottom-up Journalism), স্ট্যান্ড অ্যালন সাংবাদিকতা (Stand alone Journalism), ডিস্ট্রিবিউটেড সাংবাদিকতা (Distributed Journalism)।
নাগরিক সাংবাদিকতার বৈশিষ্ঠ্য:
প্রত্যেকেরই সাংবাদিক হিসেবে ভূমিকা পালনের সুযোগ রয়েছে। স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে পরিচালিত হওয়ার প্রবণতা লক্ষ্যণীয়।
প্রকাশিত অডিও, ভিডিও ও প্রতিবেদন সম্পর্কে আগ্রহী যে কারো মতামত প্রদানের সুযোগ থাকে।
যে কেউ মন্তব্য, বিতর্ক বা আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে পারে। সামাজিক দায়বদ্ধতা প্রবল থাকে বিবেকপ্রসূত শুভবুদ্ধি নাগরিক সাংবাদিকতার নৈতিকতার একমাত্র মাপকাঠি।
নাগরিক সাংবাদিকতার রকমভেদ:
মানবিক আবেদনধর্মী বা ফিচারধর্মী ব্লগ, কোনো বিষয়ের ওপর মন্তব্যধর্মী ব্লগ, তাৎক্ষণিক ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নিয়ে ব্লগ, ভিডিও ব্লগ, অডিও ব্লগ, ফটোব্লগ, মাইক্রোব্লগ, মম ব্লগ, পলিটিক্যাল ব্লগ, ট্রাভেল ব্লগ।
নাগরিক সাংবাদিকতার তিন মডেল
Slashdot-Ohmynews মডেলের নাগরিক সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে নিবন্ধিত ব্যবহারকারিদের মতামতের ভিত্তিতে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
Indymedia মডেলের নাগরিক সাংবাদিকতায় যে কেউ মন্তব্য এবং প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারে। এক্ষেত্রে পাঠকের ওপর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার ছেড়ে দেওয়া হয়, সে কোনটা গ্রহণ বা বর্জন করবে।
Wiki based মডেলের নাগরিক সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে আপলোড করা যে কোনো প্রতিবেদন চাইলে যে কেউ সম্পাদনা বা তথ্য-উপাত্ত যোগ করতে পারে, এতে করে কোনো একটা প্রতিবেদন বিশেষ কোনো ব্যক্তির একার নয়, বরং অনেকের অবদান থাকে তাতে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনের কিছু উদাহরণ:
২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ভয়বহ সন্ত্রাসী হামলার ভিডিও চিত্র ধারণ করেছিলেন যারা তারা কেউই কিন্তু পেশাদার সাংবাদিক ছিলেন না।
২০০৪ সালে সুনামির আঘাতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার লক্ষ্যে ক্ষয়ক্ষতির গুরুত্ব বিবেচনায় ত্রাণ তৎপরতা পরিচালায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
২০০৫ সালের ৭ জুলাই লন্ডনের ভয়াবহ বোমা হামলার ঘটনাটি একজন সাধারণ নাগরিক মোবাইল ফোনে ধারণ করেছিলেন, যা পরবর্তী সময়ে বিবিসি, সিএনএন ও এমএসএনবিসিসহ অন্যান্য মূল ধারার গণমাধ্যমসমূহ প্রচার করেছে।
২০০৫ সালে আমেরিকার হ্যারিকেন ক্যাটরিনা ও রিতা আঘাত হানলে সাধারণ জনগণই স্বপ্রনোদিতভাবে স্থানীয় খবরাখবর সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করায় দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়েছিলো।
পাকিস্তানের আবোটাবাদে বিন লাদেনের গোপন আস্তানায় মার্কিন বিশেষ বাহিনীর সিক্রেট মিশন চলাকালীন সময়ে ঘটনাস্থলের ২ থেকে ৩ কিলোমিটারের মধ্য থেকে সোয়াইব আতাহার নামে একজন নাগরিক সাংবাদিক লাইভ টুইট করেছিলেন। যা সত্যিকার অর্থে ঐদিন কী ঘটেছিল তার সঠিক বিবরণ বলে মনে করা হয়।
২০০৬ সালে বিষাক্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং আইসল্যান্ডের ব্যাঙ্কিং খাতের অব্যবস্থাপনার নানা দিক নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে উইকিলিকস এর জন্ম। কিন্তু ২০১০ সালে বাগদাদে মার্কিন বিমান হামলার ঘটনায় বেশ কয়েকজন বেসামরিক ইরাকিসহ রয়টার্সের দু’জন সাংবাদিক নিহত। মূল ধারার অনেক গণমাধ্যমই প্রকৃত সত্য ঘটনাকে এড়িয়ে যায় এবং উইকিলিকস Collateral Murder শিরোনামের ভিডিও ফুটেজ প্রচারের মাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে চলে আসে। পরবর্তী সময়ে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার দু’লাখ পঞ্চাশ হাজার গোপন নথি ফাঁস করে দিয়েছে। সম্প্রতি পানামা পেপারস নামে পরিচিত মোজেস ফনসেকার মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত গোপন নথি প্রকাশ হওয়াতে . . .. . . অনেক দেশের সরকার প্রধান থেকে শুরু করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের পদত্যাগ পর্যন্ত করতে হয়েছে।
২০১০ সালের আরব বসন্ত এবং ২০১১ সালের লন্ডনের দাঙ্গার ঘটনায় নাগরিক সাংবাদিকতার প্রতি মানুষের আস্থা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।
নাগরিক সাংবাদিকতা: বাংলাদেশ
২০০৫ সালে ‘সামহোয়ারইনব্লগ’ বাঁধ ভাঙার আওয়াজ শিরোনামে বাংলাদেশে নাগরিক সাংবাদিকতার সূচনা করে। এরই ধারাবাহিকতায় ‘মুক্তমনা’সহ আরো অনেক জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত ব্লগ এর আর্বিভাব হয়েছে। এছাড়া মূল ধারার গণমাধ্যম ‘বিডিনিউজ’ ও অারপি নিউজসহ অনেকেই এখন পাঠকের মতামতকে গুরুত্বের সাথে তুলে ধরার লক্ষ্যে সিটিজেন জার্নালিজম কর্নার চালু করেছে। পাশাপাশি ইন্টারনেট ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেজবুক তরুণ প্রজন্মের পছন্দের শীর্ষে অবস্থান করায় নাগরিক সাংবাদিকতা বিস্তারের অবারিত সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩ কোটি ১৯ লাখ ৪৯ হাজার এবং ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন ৬ কোটি ৪ হাজার জন (বিটিআরসি, এপ্রিল ২০১৬)। সার্বিক বিবেচনায় যা নাগরিক সাংবাদিকতা বিকাশের অপার সম্ভাবনার দিক নির্দেশক। আগ্রহ, সচেতনতা ও জনকল্যাণমূলক বিবেককে পাথেয় করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একজন নাগরিক সাংবাদিক হিসেবে যাত্রা শুরু করা এখন সময়ের দাবি। তবে এরই মধ্যে আমাদের সামনে নাগরিক সাংবাদিকতার কিছু দৃষ্টান্ত হিসেবে রয়েছে- বিডিয়ার বিদ্রোহের ঘটনা, রাজন হত্যাকান্ড, গণজাগরণ মঞ্চ, মেহেরজান বিতর্ক, তেল-গ্যাস চুক্তি, ভিকারুনন্নেসা নুন স্কুলের ছাত্রী নির্যাতন।
নাগরিক সাংবাদিকতার ইতিবাচক দিক: সম্পূর্ণ বিকল্প একটি মাধ্যম, যা বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের মতামত প্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি করে গণতন্ত্রকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সাহায্য করবে।
প্রাকৃতিক বা মানব সৃষ্ট যে কোনো দৃর্যোগ-দুর্বিপাকে প্রত্যক্ষদর্শীর মতামত ও বর্ণনা প্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি করে।
এলিট বা সমাজের প্রভাবশালীদের প্রভাব থেকে মুক্ত। সমাজের প্রান্তীক জনগোষ্ঠীর মূখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ। মূলধারার গণমাধ্যমে অপ্রকাশিত বা গুরুত্বহীন বলে বিবেচিত বিষয় এখানে তুলে ধরার সুযোগ রয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানি ও সরকারের প্রভাবমুক্ত। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ।
নির্দিষ্ট কোনো ভৌগলিক সীমানার মধ্যে আটকে না থেকে একজন বিশ্ব নাগরিক হওয়ার সুযোগ তৈরি হয় অংশগ্রহণমূলক সাংস্কৃতিক ভাবধারার বিকাশ। সার্বজনীন কল্যাণে ভূমিকা রাখার সুযোগ সৃষ্টি করে। নাগরিক সাংবাদিকতার নেতিবাচক দিকসমূহ: ধর্মান্ধ, উগ্রপন্থী বা সন্ত্রাসীদের কার্যকলাপ প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
প্রচলিত মূলধারার গণমাধ্যমের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হতে পারে। বিষয়াশ্রিত এবং স্বার্থের দ্বন্দ্ব প্রভৃতি প্রকট হয়ে উঠতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নাগরিক সাংবাদিকতা ‘সফট নিউজ’ বা ফিচারধর্মী লেখা প্রচারের প্রবণতা লক্ষ্যণীয়।
নাগরিক সাংবাদিকতায় নীতি নৈতিকতা: মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কোনো তথ্য-উপাত্তের প্রচার ও প্রকাশ থেকে বিরত থাকা।
জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণি নির্বিশেষে প্রত্যেকের নিজস্ব বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা।
ইচ্ছাকৃত বা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে জন-গুরুত্বপূর্ণ নয় এবং ব্যক্তির মর্যাদাহানীকর কোনো বিষয়ের প্রকাশ ও প্রচার থেকে বিরত থাকা। নিজের বিবেকের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ করা।
শেষকথা: জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় নাসির হোসেন তার ছোট বোনের সাথে তোলা একটি সেলফি তার অফিসিয়াল পেইজে পোস্ট করেন। একপর্যায়ে কিছু মানুষের নোংরা মন্তব্যের কারণে নাসির হোসেন সেই পোস্ট মুছে দিতে বাধ্য হন। নায়করাজ রাজ্জাক মারা গেছেন বলে, ফেইজবুকে প্রচারণা চালানো হয়। এ খবরে প্রবীন এই শিল্পী মানসিকভাবে আঘাত পেয়েছিলেন। ভালো বা খারাপ ঘটনা ঘটাতে মাধ্যমের নিজস্ব কোনো ভূমিকা থাকে না, বরং যে বা যারা যে উদ্দেশ্যে এটা ব্যবহার করেন, তার মাধ্যমেই খারাপ বা ভালো নির্ধারিত হয়। তথ্য-প্রযুক্তির অপার সম্ভাবনার এই যুগে সামাজিক যোগাযোগোর মাধ্যমসমূহ ব্যবহার করে অনেক অসাধ্য সাধন করা সম্ভব। এক্ষেত্রে মাধ্যমসমূহের একটু সচেতন ব্যবহারই আমাদের সমাজের কাঙ্খিত পরিবর্তন ঘটাতে পারে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, আজ থেকে ৫৩ বছর আগে একটি রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে। আর সেই বিজয়ের ৫৩ বছর পূর্তিতে আমরা নতুন ভাবনা, নতুন পরিকল্পনা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু করেছি। আমাদের চেতনায় সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতা। হৃদয়ে আমাদের সমতা-ন্যায্যতার চেতনা-আদর্শ ও সামগ্রিক মুক্তির প্রশ্ন এবং ‘৭২-এর সংবিধান।
আমরা বিশ্বাস করি, জনগণের সামগ্রিক মুক্তির প্রয়োজনেই মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনা বুকে ধারণ করে আমরা সামনে এগিয়ে যেতে চাই। সমাজতন্ত্র অভিমুখী অসাম্প্রদায়িক জনগণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রত্যয়ে সমতা-ন্যায্যতার প্রশ্নে বাংলাদেশকে উন্নয়নের অভিযাত্রায় এগিয়ে নিতে গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে চাই। আমরা অবহেলিত, শোষিত-বঞ্চিত আর নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের পাশে থাকতে চাই। আমরা সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে চাই। আমরা কোনো অন্যায়ের কাছে কিংবা কোনো অপশক্তির কাছে মাথানত করতে চাই না।
আমাদের স্লোগান হচ্ছে, সততাই শক্তি, পেশাদারী সুসাংবাদিকতায় মুক্তি। এটিই আমাদের বিশ্বাস, আমাদের আদর্শ। এর বাইরে আমাদের অন্য কোনো নীতি-আদর্শ নেই।
আমরা জানি, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পথ আমাদের পাড়ি দিতে হবে। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমরা প্রস্তুত আছি। আমরা ভাঙবো কিন্তু মচকাব না। আমরা হোঁচট খাব কিন্তু আমরা থেমে যাব না। আমাদের এই অভিযাত্রায় সংগ্রামী মানুষের সহযোগিতা চাই।
আমার বিশ্বাস, এই দেশকে যারা ভালোবাসেন, এই দেশের যারা মঙ্গল চান, তারা নিশ্চয় আমাদের পাশে থাকবেন।
সৈয়দ আমিরুজ্জামান
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট;
বিশেষ প্রতিনিধি, সাপ্তাহিক নতুনকথা;
সম্পাদক, আরপি নিউজ;
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, জাতীয় কৃষক সমিতি;
সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, মৌলভীবাজার জেলা;
‘৯০-এর মহান গণঅভ্যুত্থানের সংগঠক ও সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী।
সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ খেতমজুর ইউনিয়ন।
সাধারণ সম্পাদক, মাগুরছড়ার গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ আদায় জাতীয় কমিটি।
প্রাক্তন সভাপতি, বাংলাদেশ আইন ছাত্র ফেডারেশন।