দূরদর্শী জাতি গঠনে যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম ও যোগ্যতাসম্পন্ন টিচার জরুরি
মুহাম্মদ আল্-হেলাল
গন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ৫ ই আগস্ট, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর তৎকালীন সরকার কর্তৃক ২০২৩ সালে গৃহীত শিক্ষাক্রম বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্পূর্ণ রূপে বাতিল করার ঘোষণা ইতোমধ্যে দিয়েছে। তবে ২০২৩ সালের পূর্বের শিক্ষাক্রমে সম্পূর্ণরূপে ফিরে না গিয়ে বৈশ্বিক চাহিদার গুরুত্ব দিয়ে যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করার সকল ব্যবস্থা বর্তমান জনগণের আকাঙ্ক্ষার সরকার গ্রহণ করবে এটি সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা।
কোয়ালিটি অ্যান্ড অ্যাক্সেস এনহান্সমেন্ট প্রজেক্ট (সেকায়েপ) এর প্রশিক্ষণ চলাকালে একজন প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষক বলছিলেন টিচার্স গাইড স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। প্রতিউত্তরে প্রকল্প পরামর্শক সেলিনা পারভীন বলছিলেন, এটা হলো ইশারায় কাফিয়া। বাকিটুকুর জন্য সরকার আপনাদের নিয়োগ দিয়েছেন। আমি সেকায়েপ-এর কৌশলগত প্রশিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালনকালে ময়মনসিংহ বিভাগের সর্ববৃহত্তম জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার সানন্দবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন গণিত শিক্ষক বলছিলেন গণিত নিজেই একটি সৃজনশীল বিষয় গণিতে আবার কিসের সৃজনশীলতা?
২০২৩ সালে গৃহীত শিক্ষাক্রম বিষয়ে উদয়ন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষকদের মতো অধ্যক্ষ জহুরা বেগমও বললেন নতুন শিক্ষাক্রম খুবই ভালো। তবে পরামর্শ হলো মূল্যায়ণ কাজটি কিভাবে আরো সহজ করা যায় সেটি চেষ্টা করতে হবে। (তথ্যসূত্র: অন্যরকম পরীক্ষায় শিক্ষার্থী, প্রথম আলো; ১৪ই নভেম্বর ২০২৩)
একবার প্রথম শ্রেণির শিশুদেরকে নির্দিষ্ট দিনে পরীক্ষা হবে জানানো হলো। পরীক্ষার দুশ্চিন্তায় একটি শিশুর জ্বর হয় এবং ধীরে ধীরে গুরুতর অসুস্থ হতে থাকে। নির্দিষ্ট দিনে ক্লাসে বর্ণমালা লেখানোর মাধ্যমে পরীক্ষা সম্পন্ন হয়। শিশুটি তখনও জানে না পরীক্ষা কেমন। পরীক্ষার শেষে উক্ত শিক্ষার্থী টিচারের কাছে জানতে চেয়েছিল পরীক্ষা কখন? টিচার জানান- তোমাদের বর্ণমালা লিখতে দিলাম সেটিই হলো পরীক্ষা। স্যার পরীক্ষা এত সহজ আগে কেন বলেননি?
রয়ীছা আল্-ইসলাম ২০২৩ সালে নড়াইল জেলাধীন লোহাগড়া উপজেলার অন্তর্গত এসএইচবিআর আলিম মাদ্রাসার ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। ঐ বছর সেপ্টেম্বর মাস থেকেই তাকে আত্মীয় বাড়ি যাওয়া, পারিবারিক কাজ বা অনুষ্ঠান, খেলাধোলা সব বন্ধ করতে হয়েছিল। কারণ সে নভেম্বর মাসের প্রান্তিক মূলায়ণের পড়াশোনার জন্য দূঃশ্চিন্তায় ছিল।
কিন্তু মূল্যায়ণ শুরু হলে তার দুঃশ্চিন্তা দূর হয়ে গিয়েছিল। আনন্দের সাথে মূল্যায়ণে (পরীক্ষায়), পারিবারিক কাজ বা আড্ডায় অংশগ্রহন করছে, খেলাধুলাও করছে কারণ সেখানে মুখস্থ করার বিষয় ছিলনা বরং মস্তিষ্কের ব্যবহার করে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়েছে।
ঢাকার সাভার এবং কেরানীগঞ্জে অবস্থিত জিএফটিসি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও খুব খুশি কারন তাদের এখন আর কষ্ট করে লেখা পড়া মুখস্থ করতে হয়না বরং উপস্থিত বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে। বিষয়টি জানা যায় প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা মোঃ বাকী বিল্লাহর ফেসবুকে আপলোড কৃত এক ভিডিও ক্লিপের মাধ্যমে।
দীর্ঘদিন পরে এদেশে পাঠ্যক্রম পরিবর্তন শুরু হয়। ১৯৯৮ সাল থেকে পাটিগণিতের বদলে সম্পূর্ণ বীজগণিত, মুখস্ত নির্ভর ইংরেজির পরিবর্তে কমিউনিকেটিভ ইংরেজি। তারপর ফলাফল বিভাগ পদ্ধতির পরিবর্তে জিপিএ পদ্ধতি ২০০১ সালে। ২০১০ সালে সৃজনশীল পদ্ধতি সর্বশেষ ২০২৩ সালে ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণি থেকে শুরু হয় নতুন শিক্ষাক্রম। যেটিকে বলা হচ্ছে পরীক্ষার পরিবর্তে মুল্যায়ণ ভিত্তিক শিক্ষাক্রম যার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল ত্রিভূজ, চতুর্ভূজ বা বৃত্তের মাধ্যমে। এবং এই শিক্ষাক্রমে শতকরা ৯০ ভাগ মুসলিম জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশের মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক ও বিতর্কিত অনেক কন্টেন্ট যুক্ত করা হয়েছে যার অন্যতম সপ্তম শ্রেণীর শরীফ-শরীফার অধ্যায়। শিক্ষা বিষয়ক একটি সেমিনারে প্রকাশ্যে এই অধ্যায়টি ছিঁড়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ মেহতাব চাকরিচ্যুত হন এবং আলোচিত সমালোচিত হয়ে তৎকালীন স্বৈরশাসকের রোষানলে পড়ে জেলবন্দি হন।
শুনেছি অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের শিক্ষার্থীরা বই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই রেখে যায়। তাদের কোনো বাড়ির কাজ দেওয়া হয় না। যেন বাড়িতে তারা চাপমুক্ত থেকে আনন্দের সাথে পারিবারিক কাজ বা আড্ডা, বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করতে পারে। আমেরিকায় শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে শুয়ে বা বসে যে কোনোভাবে বন্ধুর মতো টিচারের ক্লাস উপভোগ করতে পারে।
কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের চাপের মধ্যে রাখাই যেন শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। যার ফলশ্রুতিতে দেখা যায় কোমলমতি শিক্ষার্থীদের অর্থ বোধগম্য করে গড়ে তোলার থেকে বড় বড় কবিতা, রচনা, দরখাস্ত, প্যারাগ্রাফ ইত্যাদি মুখস্থ করানো। অন্যদিকে স্টুডেন্ট-টিচার সম্পর্ক যেন চোর পুলিশের মতো। স্টুডেন্ট যদি টিচারদের ভয় পায় তাহলে তাদের মনের ভিতরে জানার আগ্রহ উদয় হয় না হলেও সেটি জানা তাদের জন্য কঠিন হয়। এদেশে যখনই কোনো নতুন শিক্ষাক্রম এসেছে তখনই অধিকাংশ টিচার সেটিকে স্বাদরে না গ্রহণ করে, বিরূপ মন্তব্য করেছেন এবং আনন্দ দূরে থাক অধিকাংশ টিচার সংশয়ের জ্বর নিয়ে ক্লাস পরিচালনা করেছেন। এর যৌক্তিক কারনও আছে সেটি হলো শিক্ষা যদি হয় কোন জাতি গঠনের ভিত্তি এবং মেরুদন্ড আর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা হলো সেই শিক্ষার ভিত্তি এবং মেরুদন্ড। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো এদেশের প্রায় সকল নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ থাকে No third class in any level of education can apply কিন্তু প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক টিচার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ থাকে Any third class can apply. আমরা যদি সংশ্লিষ্ট ডাটাবেজ লক্ষ্য করি সেখানে শিক্ষা জীবনে তৃতীয় শ্রেণী প্রাপ্তদের একটি বিশাল অংশ দেখতে পাই যেটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়াধীন প্রকল্পের দায়িত্ব পালন কালে উপলব্ধি করেছি। সেই তৃতীয় শ্রেণী প্রাপ্তদের পক্ষে একটি প্রথম শ্রেণীর শিক্ষা, গবেষণাবান্ধব, দূরদর্শী জাতি গঠনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখা নিঃসন্দেহে কঠিন কাজ।
আমাদের টিচারদের নতুন শিক্ষাক্রম দেখলে সংশয়ের জ্বর হবার আরো কারণ হলো প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে যারা শিক্ষা দেন তারা অধিকাংশ ৫ দিনে অনার্স এবং মাস্টার্স পাশের অর্ন্তভূক্ত। (তথ্যসূত্র: দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস, ৪ অক্টোবর, ২০২৩; জুম বাংলা নিউজ,৫ অক্টোবর, ২০২৩)
আর উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বর্তমান গুগল শিট এবং পাওয়ারপয়েন্ট স্লাইড দেখে দেখে ক্লাস পরিচালনা করা টিচার কিভাবে নিয়োগ হয় সেটি বলাই বাহুল্য। তবে শিক্ষাক্রম যাইহোক, নোটবই প্রস্তুতকারী কোম্পানি যে কোনোভাবেই হোক শিক্ষার্থীদের সামনে নোটবই হাজির করে। প্রয়োজনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সুবিধা দিয়ে শিক্ষার্থীদের নোট বই কিনতে বাধ্য করে। যদিও বিভিন্ন সরকার নোটবই প্রস্তুতকরণ, বাজারজাতকরণ এবং ক্লাসে নোটবই অনুসরণ নিষিদ্ধ করেও ব্যর্থ হয়েছে বার বার।
সরেজমিনে দেখা যায় ক্লাসে সরকার-প্রদত্ত বাংলা এবং ইংরেজি গ্রামারসহ অন্যান্য মূল বই অনুসরণ না করে টিচাররা বাজারের নোটবই অনুসরণ করেন। শিক্ষাক্রম নতুন বা পুরনো যাই হোক না কেন, আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে পরীক্ষার আগে জ্বর এবং মুখস্ত করতে করতে অসুস্থ হওয়া নতুন নয়। সেটি বিসিএস এর মতো নিয়োগ পরীক্ষার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের প্রথম সারির অংশীদার স্টুডেন্ট-টিচার। এবারই প্রথম এই দুই শ্রেণি জাতির মূল্যবোধ বিরোধী কন্টেন্ট ছাড়া শিক্ষাক্রমকে শুধু মুখস্থ বিদ্যার অনুপস্থিত থাকার কারণে স্বাদরে স্বাগতম জানিয়েছেন। যদিও টিচাররা এখনও বিষয়টি সম্পূর্ণ আয়ত্ব করতে পারেননি।
জনশ্রুতি আছে, কিছু শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে টিচার একজন শিক্ষার্থীর কানে কানে বললেন অমুকের একটি কালো সন্তান হয়েছে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে তার পাশের জনকে কথাটি বলতে বললেন। শেষ শিক্ষার্থী বলল যে, সে শুনেছে- অমুকের একটি কাক হয়েছে। শিক্ষাক্রমে নিযুক্ত হওয়ার পর প্রশিক্ষণকালে টিচাররাও কালোর পরিবর্তে কাক শুনতে পারেন তাই নিয়োগ দেওয়ার সময়ই যোগ্যতাসম্পন্ন টিচার নিয়োগ দিতে হবে দিতে হবে।
শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে জাতির মূল্যবোধ বিরোধী তথা দেশ বিরোধী কন্টেন্ট বিলুপ্ত এবং যোগ্যতাসম্পন্ন টিচার নিয়োগদান করত: বৈশ্বিক চাহিদার গুরুত্ব দিয়ে মুখস্থ বিদ্যা হীন শিক্ষাক্রম প্রনয়ন করতে হবে।
লেখক: এমফিল গবেষক(এবিডি), আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়