দিনভর রোগীদের দুর্ভোগ

messenger sharing button
whatsapp sharing button
twitter sharing button
linkedin sharing button

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে চিকিৎসকদের ওপর দফায় দফায় হামলার জেরে সারা দেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। পরে তাদের দাবি পূরণে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার আশ্বাসে কর্মবিরতির প্রায় ২২ ঘণ্টা পর রোববার রাত ৮টা থেকে জরুরি বিভাগে চিকিৎসা সেবা দেওয়া শুরু করেন তারা।

সাত দিনের মধ্যে চিকিৎসক সুরক্ষা আইন না করলে রুটিনওয়ার্কেও ফিরবেন না বলে শর্ত জুড়ে দেন তারা। এছাড়া যত চিকিৎসক তত নিরাপত্তাকর্মী দেওয়াসহ চার দফা বাস্তবায়নের দাবি জানান। রোববার বিকালে আন্দোলনরত চিকিৎসকদের সঙ্গে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং ঢামেক কর্তৃপক্ষ বৈঠক করে।

শনিবার দুই রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে স্বজনরা পৃথক সময়ে কর্তব্যরত চিকিৎসকের ওপর হামলা করে। এছাড়া শনিবার রাতে দুষ্কৃতকারীদের দুই গ্রুপ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ঢুকে নিজেদের মধ্যে মারামারি করে। এ সময় তারাও চিকিৎসকদের গায়ে হাত তোলে এবং জরুরি বিভাগ ভাঙচুর চালায়। এরপর রাতেই ইন্টার্নরা কর্মবিরতি শুরু করেন।

রোববার সকালে তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন অন্য চিকিৎসকরা। এসবের প্রতিবাদে দুপুরে তারা দেশব্যাপী কমপ্লিট শাটডাউন ঘোষণা করেন। এতে বন্ধ হয়ে যায় চিকিৎসাসেবা। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোগীদের ফিরে যেতে হয়। হাসপাতালের অনেক রোগীকে বেরিয়ে যেতে দেখা গেছে। এভাবে দিনভর সীমাহীন দুর্ভোগের ভেতর কাটে সেবাপ্রার্থীদের।

ঢামেক হাসপাতালে আন্দোলনরত চিকিৎসকদের সঙ্গে রোববার বিকালে বৈঠক করেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। বৈঠক থেকে বেরিয়ে সন্ধ্যা ৬টার দিকে তিনি বলেন, চিকিৎসকদের দাবিদাওয়া যত দ্রুত সম্ভব পূরণ করা হবে। এ সময় ঢামেকের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জমান জানান, তারা জরুরিসহ কিছু সেবা এখনই চালু করবেন। কিন্তু আন্দোলনকারী চিকিৎসকরা বেঁকে বসেন।

তারা বলেন, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কর্মবিরতি অব্যাহত থাকবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগের আবাসিক সার্জন আবদুল আহাদ বলেন, এখন দাবি পূরণ হলে এখনই আমরা কাজে ফিরব। চিকিৎসকদের আরেকটি পক্ষ জানিয়েছে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আসামিদের গ্রেফতারের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তাই সোমবার রাত ৮টা পর্যন্ত কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে।

এর আগে বিকাল পৌনে ৪টায় ঢাকা মেডিকেলের পরিচালকের কক্ষে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সঙ্গে আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের বৈঠক হয়। সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহ উপস্থিত ছিলেন। আন্দোলনকারী চিকিৎসকরা উপদেষ্টার কাছে কর্মস্থলের নিরাপত্তা, হামলাকারীদের গ্রেফতার, স্বাস্থ্য পুলিশ ইউনিট গঠন, সুরক্ষা আইন প্রণয়নসহ বেশকিছু দাবি তুলে ধরেন। বৈঠকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধীদের গ্রেফতারের আশ্বাস দেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা। তিনি বলেন, চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। শনিবার রাতের হামলাকে ন্যক্কারজনক বলেও জানিয়েছেন উপদেষ্টা। তিনি জানান, চিকিৎসকদের সুরক্ষার জন্য যা যা দরকার, সবই করা হবে।

স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বলেন, চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনায় সিসিটিভি ফুটেজ দেখে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চিকিৎসায় গাফিলতি হলে সুষ্ঠু তদন্তের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা না শুনে ডাক্তারদের গায়ে হাত তোলা হয়েছে, এটা ঠিক হয়নি। নূরজাহান বেগম বলেন, ঢাকা মেডিকেলের পর আরও দুটি জায়গায় এমন ঘটনা ঘটেছে, যা খুবই দুঃখজনক। ডাক্তাররা তাদের যথাসাধ্য দায়িত্ব পালন করেছেন।

এভাবে কথায় কথায় ডাক্তারদের গায়ে হাত তোলা যাবে না। স্বাস্থ্য উপদেষ্টা জানান, আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের দাবির সঙ্গে আমরা একমত। ইতোমধ্যে তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ঢামেক হাসপাতালে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। পাশাপাশি সেনাবাহিনী, পুলিশ ও আনসার রয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে চিকিৎসকদের ওপর হামলাকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে।

এদিকে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বৈঠকে বসার পরপরই ঢামেক হাসপাতালে ডাক্তারদের ওপর হামলার ঘটনায় শাহবাগ থানায় একটি মামলা হয়। মামলায় চারজনের নাম উল্লেখ করে ৪০ থেকে ৫০ জনকে আসামি করা হয়। আসামিদের মধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিইউবিটির এক শিক্ষক ও তিন শিক্ষার্থী রয়েছেন।

সূত্র জানায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগী মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে শনিবার রাতে রোগীর স্বজনরা চিকিৎসকদের মারধর করেন। অভিযোগ ওঠে, রোগীর স্বজনরা ওটিতে ঢুকে ডা. ইমরান ও ডা. মাশরাফিকে মারধর করেছেন। স্বজনদের দাবি, চিকিৎসকদের অবহেলায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে। ডাক্তারদের দাবি, রোগী পথেই মারা গেছেন।

এ হামলার পর থেকেই নিরাপত্তাহীনতার অভিযোগ তুলে ঢামেকের জরুরি বিভাগের ডাক্তাররা চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দেন। তাদের কর্মবিরতিতে অন্য চিকিৎসকরা সংহতি জানালে রোববার সকাল থেকে হাসপাতালের সব বিভাগে চিকিৎসাসেবা বন্ধ হয়ে যায়। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত রোগীরা। এরপর রোববার দুপুর ১২টার দিকে হামলাকারীদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার, কর্মস্থলে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা, চিকিৎসকদের সুরক্ষা আইন, স্বাস্থ্য পুলিশ ইউনিট গঠনসহ বিভিন্ন দাবি তুলে সারা দেশে সব ধরনের চিকিৎসাকেন্দ্রে সেবা বন্ধের ঘোষণা দেন চিকিৎসকরা। এ কর্মসূচিকে তারা বলেছেন, ‘কমপ্লিট শাটডাউন’।

কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে ঢাকা মেডিকেলের রেজিস্ট্রার (নিউরো সার্জারি গ্রিন ইউনিট) আব্দুল আহাদ বলেন, আমরা সারা দেশে কর্মবিরতির কর্মসূচি ঘোষণা করছি। চিকিৎসকদের এ আন্দোলনে একাত্মতা জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেলের নার্স ও কর্মচারীরাও। নার্সদের পক্ষ থেকে জামাল উদ্দিন বাদশা বলেন, আমরা চিকিৎসকদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছি। আমাদের দাবি, সব কর্মস্থলে নার্সদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

ডা. আহাদ বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় যেসব ঘটনা ঘটেছে, আমরা নিজেদের জীবন বাজি রেখে, সারা বাংলাদেশে কী পরিমাণ সার্ভিস দিয়েছি! ডাক্তাররা চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে ওষুধ কিনে দিয়েছেন, খাবার দিয়েছেন, ২৪ ঘণ্টা, ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ডাক্তাররা মানবতার সেবক, আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেরই পার্ট।

শনিবার রাতের ঘটনার বিবরণ দিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, প্রথম ঘটনা আমাদের নিউরো সার্জারি বিভাগে। একজন আবাসিক ডাক্তার অপারেশন করার জন্য অপারেশন থিয়েটারে যান। রোগীর লোক তাকে বের করে তার সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু করেন, ডাক্তারকে মারধর করেন। তাকে সেভ করার জন্য আরেক ডাক্তার ওখানে যান, তখন তার ওপরও অতর্কিতে আক্রমণ করে। কলার ধরে তাকে ২০১ নম্বর অপারেশন থিয়েটারের সামনে থেকে ডিরেক্টর স্যারের সামনে নিয়ে আসে। মারতে মারতে নিয়ে এসে এখানেও তারা ক্ষান্ত হয়নি।
স্যারের অফিসে পিএর চেয়ারে তিনি বসেন। এখানেও তার ওপর আক্রমণ করা হয়। তিনি বলেন, আমরা যারা ইমারজেন্সি সার্ভিস দিই, আপনারা দেখেছেন, সেখানে কত লোক থাকে। ইমারজেন্সি সার্ভিস দেওয়ার জন্য আমাদের যথেষ্ট আর্মি, পুলিশ এবং অন্যান্য ফোর্স এখানে থাকবে। সশরীরে উইথ আর্মস সেখানে উপস্থিত থাকবে। কিন্তু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রশাসন এটা করতে ব্যর্থ হয়েছে।

সদ্য বিলুপ্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের সাবেক সহসভাপতি সোহেল রানা রনি জানান, তাদের কর্মবিরতি শুরু হয়েছে শনিবার রাত থেকে। তিনি বলেন, হাসপাতালে যে পরিস্থিতি চলছে, তাতে আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। আমাদের দাবি, যারা এ ঘটনায় জড়িত, সিসি ক্যামেরার ভিডিও দেখে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

তিনি জানান, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শুক্রবার রাতে আহতাবস্থায় ভর্তি হন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। শনিবার ভোরে তার মৃত্যু হয়। ওই ঘটনায় রোগীর স্বজনরা দায়িত্বরত ইন্টার্ন চিকিৎসকদের মারধর করেন। চিকিৎসক রনি বলেন, শনিবার এক কিডনি রোগী মারা গেলে তার স্বজনরাও ইন্টার্ন চিকিৎকদের মারধর করেন।

এছাড়া শনিবার মধ্যরাতে হাসপাতালের ওয়ার্ডে ঢুকে দুই সন্ত্রাসী গ্রুপ নিজেদের মধ্যে মারামারি করেছে। তারা জরুরি বিভাগে ভাঙচুর করেছে। এ পরিস্থিতিতে কর্মবিরতি শুরু করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রায় দুইশ শিক্ষানবিশ চিকিৎসক। ফলে শনিবার রাতেই অনেক বিভাগে সেবা বন্ধ হয়ে যায়। তাদের এই কর্মসূচিতে অন্য চিকিৎসকরা সংহতি জানানোয় রোববার সকাল থেকে জরুরি বিভাগ, ইনডোর, আউটডোরসহ সব বিভাগে সেবা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়েন দেশের সবচেয়ে বড় এই হাসপাতালে আসা রোগী ও স্বজনরা।

সমন্বয়ক সারজিসের কঠোর হুঁশিয়ারি : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, আমাদের পক্ষ থেকে স্পষ্ট বার্তা এভাবে কোনো চিকিৎসককে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ এনে গায়ে হাত তোলা যাবে না। স্পষ্টভাবে বলছি, বিষয়টি আমরা মেনে নিতে পারি না।

তিনি বলেন, চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওই রোগীর মৃত্যুর জন্য যদি কারও গাফিলতি থেকে থাকে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি চিকিৎসকের গায়ে যারা হাত দিয়েছে তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। আমাদের স্পষ্ট বার্তা, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার মতো কিছু যদি আপনি করেন তাহলে আপনার পক্ষে কোনো দিন আমাদের অবস্থান থাকবে না।

বিজিবি মোতায়েন : ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা বিধানে ২ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। রোববার বিকালে যুগান্তরকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম।

ধারালো অস্ত্রসহ গ্রেফতার ৪ : ঢামেক পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বাচ্চু মিয়া জানান, শনিবার রাতে খিলগাঁওয়ের সিপাহিবাগ এলাকায় দুই গ্রুপের সংঘর্ষের একটি ঘটনা ঘটে। পরে এ ঘটনায় আহত এক গ্রুপ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসে। পরে অন্য আরেকটি গ্রুপ চাপাতি নিয়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ভেতরে ঢুকে যায়। এ সময় চারজনকে আটক করে সেনাবাহিনীর কাছে সোপর্দ করা হয়। আটকরা হলেন-বাপ্পি মিয়া (২৪), আদিব (২৩) নাসির (২৫) নাবিল (২৭)। তারা সবাই খিলগাঁও থানার বাসিন্দা।

দীর্ঘ অপেক্ষায়ও মেলেনি চিকিৎসাসেবা : চিকিৎসকদের কর্মবিরতি চলায় বিপাকে পড়েন শত শত রোগী ও তাদের স্বজনরা। অনেকেই কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করে ফিরে যান। আবার কিছু রোগীকে জরুরি বিভাগের সামনে যন্ত্রণা, হতাশায় শুয়ে পড়তেও দেখা গেছে। চিকিৎসাসেবা না পেয়ে অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন।
অ্যাম্বুলেন্সে জরুরি চিকিৎসার জন্য আনা রোগীদের নিয়ে কী করবেন, কোথায় যাবেন-বুঝতে পারছিলেন না স্বজনরা। সেবা না পেয়ে আহাজারিও করতেও দেখা গেছে অনেককে। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত আশরাফুল ইসলামকে সকাল ৯টার দিকে হাসপাতালে নিয়ে আসার পর কোনো চিকিৎসা পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ করেন তার বাবা রিপন মিয়া।

তিনি বলেন, ভোরবেলা ছেলেটা ট্রাক্টর নিয়ে বের হয়, একটি বাইক বাঁচাতে গিয়ে আহত হয়। মাথায় আঘাত লাগে। রক্ত ঝরছে। ৩ ঘণ্টা ধরে বসে কোনো ডাক্তার পাচ্ছি না। গাছ থেকে পড়ে মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙেছে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার ফিরোজ মিয়ার। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মূল ভবনের নিচ তলার ১০০নং ওয়ার্ডের ২৬ নম্বর বেডে ভর্তি আছেন তিনি।

ফিরোজের স্ত্রী বলেন, সকাল থেকে কোনো ডাক্তার আসেননি, কী করব কিছু বুঝতে পারছি না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে দায়িত্বরত এক নার্স বলেন, আমরা তো আছি, উনারা (ডাক্তার) যে নাই সেটা তো দেখছেনই। রুমা আক্তারের বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। মায়ের চিকিৎসার জন্য সকাল সকাল এসেছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

চিকিৎসকদের শাটডাউন কর্মসূচি সম্পর্কে কিছুই জানা ছিল না তাদের। ফলে সকাল ৭টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও পেলেন না চিকিৎসাসেবা। হবিগঞ্জ থেকে চিকিৎসা নিতে ঢামেকে এসেছিলেন ৬ মাসের গর্ভবতী রহিমা বেগম (ছদ্মনাম)। হঠাৎ পেটে ব্যথা অনুভব করতে থাকেন তিনি। তাই দ্রুত স্বজনরা তাকে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে আসেন। কিন্তু চিকিৎসকদের শাটডাউন কর্মসূচির কারণে তারা পড়েন চরম বিপাকে।

দিনভর অপেক্ষা করেও চিকিৎসা না পেয়ে বাধ্য হয়ে ফিরে যান তারা। রহিমা বেগমের স্বজনরা বলেন, শনিবার রাতে আমরা তাকে নিয়ে ঢামেক হাসপাতালে আসি। ৬ মাসের গর্ভবতী হলেও হঠাৎ করে তার যন্ত্রণা শুরু হয়। প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাই, পরে হবিগঞ্জ থেকে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে আসি। আমরা জানতাম না যে এত ঝামেলা হয়ে গেছে। রাত থেকে চিকিৎসা পাইনি। আজ দিনের প্রায় শেষ, কোনো চিকিৎসার খবর নেই। এদিকে রোগীর অবস্থা ক্রমান্বয়ে খারাপ হচ্ছে, কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না। তারা আরও বলেন, এখন প্রাইভেট মেডিকেলে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।

চমেকে সেবা বন্ধ রেখে চিকিৎসকদের কর্মসূচি : চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে অপ্রীতিকর ঘটনাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালেও চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন চিকিৎসকরা। রোববার আড়াইটার দিকে জরুরি বিভাগ ও বহির্বিভাগের গেটে তালাবদ্ধ করে চিকিৎসকদের বিক্ষোভের খবর পেয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা সেখানে ছুটে যান। গেটের তালা ছাত্ররা ভেঙে ফেলেন ও গেট খুলে দেন।

পাশাপাশি সেনাবাহিনীও দ্রুত ঘটনাস্থলে আসে। ছাত্ররা হাসপাতালে রোগী ভর্তিতে সহযোগিতা করেন। তখন ইন্টার্ন চিকিৎসকদের পাশাপাশি নিয়মিত চিকিৎসক ও নার্সরাও এসে যোগ দেন। তবে, চিকিৎসকদের কর্মবিরতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা। সাতকানিয়া থেকে আসা রোগীর স্বজন আবদুল কাদের বলেন, ‘আমার ভাই সড়ক দুর্ঘটনায় পা ভেঙে গেছে। হাসপাতালে কোনো রকমে ভর্তি করাতে পারলেও চিকিৎসা পাচ্ছে না।

রামেক হাসপাতালে ‘সীমিত পরিসরে’ শাটডাউন: রাজশাহী ব্যুরো জানায়, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে রোববার দুপুর থেকে ‘সীমিত পরিসরে’ শাটডাউন কর্মসূচি শুরু হয়েছে। সোমবার সকালের মধ্যে ৪ দফা দাবি আদায় না হলে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে যাবেন বলে জানিয়েছেন ইন্টার্ন চিকিৎসকরা।

হাসপাতালে এখন শুধু জরুরি সেবা এবং নতুন রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা চালু রয়েছে। আপাতত ওয়ার্ড সামলাচ্ছেন নার্সরা। চিকিৎসকরা পুরোনো রোগী দেখছেন না। তবে হাসপাতাল পরিচালকের দাবি, প্রতিটি ওয়ার্ডে চিকিৎসক আছেন এবং স্বাভাবিক রয়েছে সেবা কার্যক্রম। রোববার বিকালে ক্যানসারে আক্রান্ত বোনের রক্তের চাহিদাপত্র নিতে হন্যে হয়ে চিকিৎসক খুঁজছিলেন আইনজীবী সহকারী হাসান মৃধা। তিনি বলেন, ব্লাড ব্যাংক থেকে রক্ত নিতে হলে ডাক্তারের চাহিদাপত্র নিতে হবে। এটার জন্য একজন ডাক্তারও পাচ্ছি না। তবে, ইন্টার্ন চিকিৎসক ডা. আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আমরা এখনও পুরোপুরি কর্মবিরতি শুরু করিনি। সীমিত পরিসরে শাটডাউন কর্মসূচি চলছে।

ধর্মঘটে যাননি শেবাচিম হাসপাতালের চিকিৎসকরা : বরিশাল ব্যুরো জানায়, ঢাকায় চিকিৎসকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে সারা দেশে কমপ্লিট শাটডাউনে গেলেও বরিশাল শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় (শেবাচিম) হাসপাতালের চিকিৎসকরা রোগীদের সেবা দিয়েছেন। তাদের এভাবে সেবা দেওয়ার বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসাবে দেখছেন দূর-দূরান্ত থেকে চিকিৎসা নিতে আসা সেবাপ্রার্থীরা ও নগরবাসী। পটুয়াখালী থেকে শেবাচিম হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রহিম খান বলেন, রোগীর সেবার জন্যই চিকিৎসক। জরুরি মুহূর্তে তাদের সেবা না পেলে অনেক রোগী মৃত্যুবরণ করবে। রোগীদের যে কোনো পরিস্থিতিতে মানুষের চিকিৎসক দরকার।

ডাক্তারদের চার দফা : ১. অপরাধীদের চিহ্নিত করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার ও দ্রুত বিচার আইনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ২. অবিলম্বে দেশের সব স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্য পুলিশের মাধ্যমে নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিত করতে হবে। ৩. হাসপাতালে রোগীর কার্ডধারী ভিজিটর ছাড়া বহিরাগত কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। ৪. হাসপাতালে রোগীর সেবা ক্ষেত্রে অবহেলা দেখা গেলে লিখিত আকারে কর্তৃপক্ষের কাছে জানাতে হবে। কোনো ভাবেই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া যাবে না।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

সর্বশেষ সংবাদ