রেভ্যুলিউশন কি ছোঁয়াচে?

আজ থেকে ১৪ বছর আগে ২০১০ সালের দিকে আফ্রিকা মহাদেশের উত্তরে অবস্থিত ক্ষুদ্র একটি দেশ তিউনিসিয়ার এক শিক্ষিত যুবক নাম বুওয়াজিজি, যিনি শিক্ষিত হলেও দেশটিতে চলমান বিভিন্ন অনিয়মের বেড়াজালে কর্মসংস্থানের অভাবে রাস্তায় ফেরি করে ফল বিক্রি করার পেশা বেঁছে নিয়েছিলেন। এজন্য সে সময়ে পুলিশের ধাওয়া কিংবা মারও খেয়েছিলেন তিনি। লাইসেন্স ছাড়া ফল বিক্রির জন্য পুলিশও তার থেকে বিভিন্ন অসুদোপায়ের মাধ্যমে অর্থ নিতে থাকে। তবুও পুলিশ তাকে রাস্তায় বিভিন্নভাবে হেনস্তা করতে থাকে পারমিট পেপার না থাকার কারণে। এজন্য তিনি পারমিট পেপার নিতে গেলে পুলিশ তাকে তিরস্কার ও হেনস্তা করে, একপর্যায়ে ডিউটিরত পুলিশ তার গালে চড় বসিয়ে দেয়। তার কাছে থেকে কেড়ে নেওয়া হয় ইলেকট্রনিক মাপযন্ত্র এবং তার গাড়িটিকে টেনে নিয়ে রাস্তার পাশে খাঁদে ফেলে দেওয়া হয়। রাগে-দুঃখে-অভিমানে তিনি তৎকালীন দেশের স্বৈরশাসক বেন আমিনের প্রশাসনের নিপীড়ন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ ২০১০ সালের ১৭ই ডিসেম্বর উন্মুক্ত ব্যস্ত রাজপথে সকলের সামনে নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। কিছুদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর ২০১১ সালের ৪ জানুয়ারি তিনি মারা যান। যার ফলশ্রুতিতে সেসময় জনগন প্রতিবাদে রাস্তায় বের হয়ে আসে।
শুরু হয় বেন আমিন ও তার প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লব। যা ভালো চোখে দেখে না বেন আমিন ও তার প্রশাসন। তারা জনগনকে ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ করে। তবুও জনগণ একে একে জড়ো হয় ও বুওয়াজিজির প্রদর্শিত পথে পা বাড়ায়। জনগণ বেন আমিনের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠে। তাই তারা দেশে চলমান বেকারত্ব, অর্থনৈতিক মন্দা, মূল্যস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধোগতি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সীমাহীন অন্যায়-অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। তাদের প্রতিবাদী কণ্ঠে প্রকম্পিত হয় সারা শহর। দেশে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বাঁধা হওয়া ও সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য ধীরে ধীরে এই ক্ষোভ বিক্ষোভে রূপ নিতে থাকে। প্রতিবাদী এই স্ফুলিঙ্গ এক শহর থেকে অন্য শহরে ছড়াতে থাকে। বেন আমিনের পুলিশ কিংবা প্রশাসন এই বিক্ষুব্ধ জনগনকে ও তাদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে শক্তি প্রদর্শন করেও দমাতে ব্যর্থ হয়। এক সময়ে তা সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
সরকার ও তার প্রশাসনের বিরুদ্ধে জনগন কথা বলা শুরু করে। যার ফলে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বেন আমিনের স্বৈরতান্ত্রিক সাম্রাজ্য টালমাটাল পরিস্থিতিতে পড়ে যায়। এক সময় জনগনের চাপে ১৪ জানুয়ারি বেন আমিন বাধ্য হয়ে তিউনিসিয়া ছেড়ে সৌদি আরবে আশ্রয় নেয়। এই যখন তিউনিসিয়ার পরিস্থিতি তখন আরববিশ্বের জনগণের নিকট একটি বার্তা পৌছয়, আর তা হচ্ছে স্বৈরশাসক কিংবা রাজতন্ত্র যত বড় ক্ষমতার অধিপতি হোক না কেন বা শাসক তার ক্ষমতাকে যতই কুক্ষিগত করে রাখুক না কেন, জনগনের ক্ষমতাই আসল ক্ষমতা ও তারাই প্রকৃত ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। জনগন চাইলেই আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের যেকোন অন্যায়-অনিয়ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হতে পারে, এমনকি সরকারকে পর্যন্ত ক্ষমতা থেকে অপসারণ করতে পারে। স্বৈরশাসক যেমন জনগনের কণ্ঠরোধ করতে রাষ্ট্রের সব উপাদান ব্যবহার করতেও কুণ্ঠাবোধ করে না, তেমনি জনগনের মনের ভয় একবার ভেঙে গেলে সেও আর প্রশাসন, পুলিশ কিংবা অস্ত্রশস্ত্র কিছুকেই পরোয়া করে না, ভয় পায় না। জনগণ যখন সাহসী হয়ে উঠে, তারা যখন একবার কথা বলা শিখে যায়, তখন নিজের জীবনও পেতে দেয় বুলেটের সামনে, কোনরূপ কুন্ঠাবোধ করে না। ঐক্যবদ্ধ জনগন মানে হচ্ছে সম্মিলিত সাহস যার জন্য মানুষ জীবন দিবে তবুও যেই প্রতিবাদী সুর, শ্লোগান তারা দেওয়া শুরু করেছে তারা তা বন্ধ করবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের দাবী বাস্তবায়ন না হবে। জনগণ বুঝে যায় যে মানুষকে হয়ত গ্রেফতার করা যাবে কিন্তু তাদের কণ্ঠকে কিভাবে আটকিয়ে রাখবে? এরই ধারাবাহিকতায় নিজেদের অধিকারের প্রশ্নে, গনতন্ত্রের দাবীতে বিভিন্ন স্বৈরতান্ত্রিক দেশের জনগণও রাস্তায় নেমে আসে। তারাও তিউনিসিয়ার জনগনের থেকে যে শিক্ষা লাভ করেছে তার প্রয়োগে সচেতন হয়ে উঠে। তাইতো আরব বসন্তের ঢেউয়ের কারণে একে একে তৎকালীন মিশরের স্বৈরশাসক হোসনী মুবারকের ৩০ বছরের অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক সাম্রাজ্যের পতন হয়েছে। হাজার হাজার জনগন রাস্তায় নেমে আসে ও তাহরীর স্কয়ারে মিলিত হয়। ফলশ্রুতিতে ১১ ফেব্রুয়ারি গণবিক্ষোভের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন মুবারক। সেই সময়ে লিবিয়াতেও শুরু হয়ে যায় গাদ্দাফির বিরুদ্ধে গণআন্দোলন। ফলে শঙ্কিত হয়ে পড়েন গাদ্দাফি। তবে তিনি বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করেন, অন্যদিকে পশ্চিমাবিশ্ব আবার এই আন্দোলনকে বেগবান করতে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। তারা অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করে। শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। অবশেষে দীর্ঘ ৯ মাস পর ২০ অক্টোবর পরাজিত ও নিহত হন মুয়াম্মার গাদ্দাফি। অবশেষে লিবিয়ায় গাদ্দাফির ৪১ বছরের সাম্রাজ্যের পতন হয়। একইভাবে এই আন্দোলনের ছোঁয়া গিয়ে পড়ে সিরিয়ায়।
সিরিয়ার বাসার আল আসাদের শিয়াপন্থি সরকারের প্রতিও জনগন আঙুল তুলে। সেও গাদ্দাফীর মত শক্তি প্রদর্শন করেই বিক্ষোভ দমাতে স্থিরপ্রতিজ্ঞ হয়। শুরু হয় সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ। তবে এখানে বাসার সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে অস্ত্র ও সামরিকভাবে সহযোগিতা করছে রাশিয়া, ইরান অন্যদিকে আন্দোলনকারীদের সহযোগিতা করে যাচ্ছে আমেরিকা ও পশ্চিমাবিশ্ব। ফলে দিনে দিনে ধ্বংসের পথে যাচ্ছে সিরিয়া। বাসার আল আসাদ টিকে গেলেও টিকতে পারে নি ইয়েমেনের স্বৈরাচার আব্দুল্লাহ সালেহ। ইয়েমেনেও স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয়। এদিকে আরব বসন্ত উঁকি দিয়েছিলো বাহরাইনেও। কিন্তু সৌদি আরবের সহযোগিতায় রক্ষা পায় বাহরাইনের রাজ পরিবার। যদিও এইসব আন্দোলনকে বেগবান করতে ইউএসএ ও পশ্চিমা দেশের ইন্ধন রয়েছে বলে জানা যায় তবুও আন্দোলন করতে তো নেমেছে সেইসব দেশের জনগণ। জনগনই যখন তাদের দেশের সরকারকে চাচ্ছে না তখন আর অন্যদেশকে দোষ দিয়ে লাভ কি? কিন্তু এই যে জনগণের রেভ্যুলেশনের শিক্ষা সমগ্র পৃথিবীর মানুষ পেলো তা যেমন ধ্রুব সত্য, তেমনি ঐতিহাসিক উদাহরণ হয়ে রইলো পরবর্তী প্রজন্মের নিকট।
একইভাবে তুমুল বিক্ষোভের মুখে ক্ষমতা ছাড়েন দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে। যদিও এই পাকসে পরিবারের শ্রীলঙ্কায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা ছিলো অনন্য, তবুও দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে এই পরিবারের স্বজনেরা ব্যাপক দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ভয়াবহ রকমের অর্থনৈতিক দুরবস্থা, বৈদেশিক ঋণে জর্জরিত হয়েও বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া, দেশটির রিজার্ভ তলানীতে নিয়ে আসা, জ্বালানি তেল ও নৈমিত্তিক পণ্য আমদানি করতে না পারা ও পাকসে পরিবারের স্বৈরাচারী মনোভাবের জন্য ধীরে ধীরে অগ্রহণযোগ্য হয়ে পড়ে দেশটির জনগণের নিকট। তারই ফলশ্রুতিতে একসময়ের শ্রীলঙ্কার তামিল টাইগার বিদ্রোহীদের নিশ্চিহ্ন করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নায়ক পাকসে পরিবার সময়ের পরিক্রমায় দেশটির সাধারণ জনগনের নিকট খলনায়কে পরিণত হয়। তাই পাকসে সরকারের বিরুদ্ধেই সাধারণ জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। শুরু হয় পাকসে পরিবারের সমর্থকদের সাথে সাধারণ জনগণের সংঘর্ষ। সরকার বিরোধী এই আন্দোলনকে বেগবান করতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে দেশটির তরুণ প্রজন্ম। সরকার এই আন্দোলনকে দমাতে দেশে জরুরী অবস্থা জারী করে, তবুও ছাত্রজনতা তা উপেক্ষা করে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে। আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে তাদের উপর টিয়ারসেল, জলকামানও ছোড়া হয় তবুও জনগণ পিছপা হয় না। সমস্ত বাঁধাকে পেছনে ফেলে আন্দোলনটি গণআন্দোলনে পরিণত হয়। অতঃপর  পদত্যাগ ও দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে (৯ মে ২০২২) ও প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ে রাজাপাকসে (১৩ জুলাই ২০২২)।
শ্রীলঙ্কার পাকসে পরিবারের ক্ষমতা ছাড়ার বছর দুই পরেই বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শেখ হাসিনা সরকারের দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনকালের অবসান ঘটলো গত ৫ আগস্ট ২০২৪ (সোমবার) শেখ হাসিনার পদত্যাগের মাধ্যমে। যদিও কোটা সংস্কার আন্দোলনের পটভূমি তৈরি হয়েছিল ২০১৮ সালের মার্চ মাসে শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করার মাধ্যমে। তাদের মূল দাবি ছিল, কোটার পরিমাণ ৫৬% থেকে কমিয়ে ১০% করা এবং মুক্তিযোদ্ধা কোটার সংস্কার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। আন্দোলনের ব্যাপকতা এবং শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের কারণে বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১১ এপ্রিল, ২০১৮ তারিখে সংসদে ঘোষণা দেন যে, কোটা ব্যবস্থা বাতিল করা হবে। এরপর সরকার কোটা সংস্কারের জন্য একটি কমিটি গঠন করে এবং পরবর্তীতে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের ঘোষণা দেয়। এরপর পরিস্থিতি স্বাভাবিকই ছিলো কিন্তু ২০২৪ সালে বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন পুনরায় শুরু হয় ৬ জুন থেকে।
৫ জুন হাইকোর্টের রায়ে ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করা হলে, ৬ জুন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ শুরু করে। আন্দোলনের প্রথম পর্যায় চলে ৬-১০ জুন পর্যন্ত, এবং দ্বিতীয় পর্যায় ৩০ জুন থেকে চলমান থাকে। এ আন্দোলনকে দমাতে সরকার নানারকম বিতর্কিত কর্মসূচি গ্রহন করে যা ছাত্রদের মনে তীব্র অসন্তোষের জন্ম দেয়। তারা আরো ক্ষুদ্ধ ও উত্তাল হয়ে পড়ে। এ সময়ে শেখ হাসিনা সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর বিতর্কিত মন্তব্য এবং ছাত্রলীগ ও প্রশাসনের দমন পীড়ন কর্মকাণ্ড এই আন্দোলনকে উষ্কে দেয় ও আন্দোলনকে বেগবান করে। আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন সড়ক যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের মন্তব্য, “এদের দমাতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট”, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্তব্য, “মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, নাতি-পুতিরা কোন মেধাবী না যত রাজাকারের বাচ্চারা, নাতি-পুতিরা মেধাবী, তাই না?”, “মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরাও পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?” ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের থেকে এরূপ মন্তব্য আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মনে তীব্র অসন্তোষের জন্ম দেয়। তারা নিজেদেরকে সেই মন্তব্যের জের ধরেই শ্লোগান দিতে থাকে, “তুমি কে, আমি কে/রাজাকার রাজাকার/কে বলেছে, কে বলেছে/স্বৈরাচার স্বৈরাচার।” ফলে আন্দোলন আরো ঘনীভূত হয়। সারাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে এই আন্দোলনের সাথে একাত্ততা প্রকাশ করে। ফলে সরকার আন্দোলন দমাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মাঠে নামায়। একদিকে ছাত্রলীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষার্থী মুখোমুখি অবস্থানে চলে আসে।
এতে করে আন্দোলন সহিংস রূপ ধারণ করে। সবচেয়ে বড় প্রভাবটা পড়েছে দেশজুড়ে আন্দোলনকারীদের উপর গুলি করা ও ছয় জন শিক্ষার্থীর প্রাণ চলে যাওয়ায়। তবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে গত ১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাইদের মৃত্যুর ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যা এই আন্দোলনকে আরো বেগবান করে। ছাত্র আন্দোলন ক্রমেই গণআন্দোলনে রূপ নেয়। ফলে সরকার দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে ও কারফিউ জারি করে। সেনাবাহিনীকেও রাস্তায় নামানো হয়। যার জন্য জনমনে তীব্র অসন্তোষ ও ক্ষোভের জন্ম হয়। সরকারের এই সিদ্ধান্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র সমালোচিত হয়। সরকারের এই কঠোর সিদ্ধান্ত সারাদেশের নিকট সরকারের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করে। ফলশ্রুতিতে সরকার সারাদেশের ইন্টারনেট সেবা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করে দেয়। দেশের জনগনের মধ্যে যা আরো ভীতির সঞ্চার করে। জনগনের কৌতুহলী মন জানতে চায় দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে। এ সম্পর্কে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের মন্তব্য, “ইন্টারনেট বন্ধ করিনি, ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেছে” ইত্যাদি জনগনকে শান্ত করার পরিবর্তে জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি করে।
জনগনের তীব্র নিন্দার ফলে সরকার আবার ইন্টারনেট পুনরায় সচল করতে বাধ্য হয়। এদিকে সাবেক ডিবিপ্রধান আবার আন্দোলনের সমন্বয়কদের তুলে নিয়ে গিয়ে আটক রাখে ও তাদের থেকে জোরপূর্বক আন্দোলন প্রত্যাহারের বিবৃতির ভিডিও ছড়িয়ে দেয় যা আগুনে আরো ঘি ঢেলে দেয়। তবে এরইমধ্যে সারাদেশে সরকার দলীয় সমর্থক ও নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে অনেক ছাত্র, শিশু ও জনতার মৃত্যু আন্দোলনকে সহিংস পর্যায়ে নিয়ে যায়। এমনকি আন্দোলন দমাতে প্রশাসনের হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোড়া হয়, এতে করে অনেক সাধারণ মানুষ ও শিশু পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করে। সরকারের এ ধরনের হটকারি সিদ্ধান্ত সমালোচনার জন্ম দেয়। যার ফলে দেশ অস্থিতিশীলতার পর্যায়ে পৌছে যায়। জনগন বিক্ষুব্ধ হয় ও সহিংস হয়ে উঠে। দেশ অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যায়। এ সহিংস কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থাপনা-গাড়িসহ সম্পদের ভাঙচুর ও অগ্নিকাণ্ডে যে ক্ষয়ক্ষতি হয় তা বর্ণনাতীত। আর এসবের প্রতি অনুভূতি প্রকাশ করলেও সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়। এমনটিই মনে হয় যেন জনগণের প্রাণের থেকেও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি সরকারের নিকট বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। আন্দোলন বন্ধ করতে সরকারের কোন কৌশলই কাজে দেয় না। কারন সরকার সমঝোতার পথ না মাড়িয়ে কঠোর দমন-পীড়ন নীতিতেই অবিচল থাকে। যার জন্য সরকার কিছুতেই উত্তাল জনগনকে সামাল দিতে পারে না।
সারাদেশের হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ মানুষ, সর্বস্তরের শ্রেণি-পেশার সাধারণ জনগণ ও অভিভাবকেরাও রাস্তায় বেরিয়ে আসে। ফলে আন্দোলনটি জনসমর্থন পায় ব্যাপকহারে। যদিও আন্দোলন সহিংস পর্যায়ে পৌঁছানোর পর সরকার ও হাইকোর্ট বিষয়টি আমলে নিয়ে ইতিমধ্যে ২৩ জুলাই ২০২৪ তারিখে শিক্ষার্থীদের দাবীর প্রেক্ষিতে ৯ম থেকে ২০ তম গ্রেডের সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে সকল চাকরিতে মোট ৭ শতাংশ কোটা বহাল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। কিন্তু সরকারের কোটার বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হলেও আন্দোলনকারীরা এতে সন্তুষ্ট হতে পারেনা। তাদের মতে তাদের দাবী এখন আর শুধু কোটার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তারা ক্রমে ৯ দফা থেকে ১ দফার ডাক দেয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে হাজার হাজার জনতার সামনে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা ১ দফা -শেখ হাসিনার পদত্যাগের ডাক দেয়। ফলে গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট ২০২৪ শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশত্যাগ করেন।
দীর্ঘ ১৫ বছর একটানা সরকারে থাকার পরেও কেন শেখ হাসিনা সরকারকে পদত্যাগ করতে হলো এই ব্যাপারে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শেখ হাসিনা সরকারের অতিরিক্ত পরিমানে প্রশাসননির্ভর হওয়া ও জনগনের পালস না বোঝার কারনেই এমনটা হয়েছে। সাধারণ জনগনের মানসিক অবস্থা তিনি ও তার রাজনৈতিক কর্মীরা অনুভব করতে পারে নি। আর জনগনের সাথে শাসকের এই দূরত্ব তৈরি হয়েছে দেশে দীর্ঘদিন স্বচ্ছ নির্বাচন ব্যবস্থা না থাকার জন্য। সুষ্ঠু নির্বাচন না থাকায় জনগন কি চায়, কাকে চায় তা জানা মোটেই সম্ভব হয় না। ফলে একব্যক্তিক সিদ্ধান্ত, স্বজনপ্রীতি ও পরিবারতন্ত্রের জন্য অনেক অযোগ্য ও অগ্রহণযোগ্য ব্যক্তি শুধুমাত্র দলীয় সমর্থন পেয়েই নির্বাচিত হয়। আর সরকারের এই দুর্বলতাকে ব্যবহার করে প্রশাসনে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে কলুষিত করে তোলে। এমনকি দেশের প্রশাসনে কিংবা এর বাইরের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অসংখ্য পরীক্ষার্থী প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে ও টাকার বিনিময়ে চাকরিতে নিয়োগপ্রাপ্ত হয় এবং একইসাথে এই সরকারের আমলে দলীয় সমর্থিত লোকদেরকেই বিভিন্ন বড় বড় নীতিনির্ধারণী পদে বসানো হয়। এর ফলে দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রশাসন দুর্নীতি রুখতে মানসিকভাবেই দুর্বল থাকে।
অন্যদিকে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী, এমনকি ভিন্নমতের রংবদলবাজ নেতারাও নিজেদের আদর্শকে বিকিয়ে দিয়ে এমপি হওয়ার খায়েসে ও নিজেদের ব্যাবসা টিকিয়ে রাখতে আওয়ামীলীগে যোগদান করে। এ সকল অসাধু শুধু টাকার বিনিময়েই দলীয় মনোনয়ন পায়। যা দলের জন্য অশনিসংকেতের নামান্তর হয়। ফলে দলের জন্য নিবেদিত কর্মীরা বঞ্চিত হয়। যার জন্য নিবেদিত কর্মীরা রাজনীতি থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এতে করে ক্রমেই দেশের সবচেয়ে বৃহৎ ও প্রাচীন রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগ দল প্রকৃত কর্মীবান্ধব দল থেকে হাইব্রিড দলে পরিণত হয় ও জনসমর্থন হারায়। এর প্রভাবে দেশের রাজনীতিতে ও সরকারে প্রকৃত রাজনীতিবিদ না এসে ব্যবসায়ীদের একটা সিন্ডিকেট গড়ে উঠে। যারা সরকারে থেকে নানারকম সুবিধা নিয়ে তাদের ব্যবসাকে শুধু ফুলিয়ে-ফাপিয়ে তোলে। আসলে রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতেই নিরাপদ, কারন প্রকৃত রাজনীতিবিদরাই জনগনের দুঃখ বুঝতে পারে। আর ব্যবসায়ীরা জনগনের দুঃখকষ্ট বোঝে না, তারা শুধু বুঝে মুনাফা! দেশে তাই এতদিনে তৈরি হয়েছে অর্থনৈতিক বৈষম্য। ধনী গরীবদের মধ্যে আয়ের ব্যবধান প্রকট আকার ধারণ করেছে। অবৈধ সুবিধা নিয়ে কিছু সংখ্যক লোকের কাছে পুঞ্জীভূত হয়েছে দেশের অর্থনীতি। আর এইসব পুজিবাদী ব্যবসায়িক শ্রেণি অধিক মুনাফার লোভে যখন তখন দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি করে জনমনে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি করে। অতিরিক্ত দাম নির্ধারণের ফলে ধনিক শ্রেণী বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করে তা বিদেশে পাচার করে। যা দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনে দেয়। কিন্তু এই সিন্ডিকেটকে ভাঙার মত পর্যাপ্ত নৈতিক শক্তি সরকার কিংবা প্রশাসনের থাকে না, ফলে জনগন যে প্রতিনিয়ত শাসকশ্রেণির উপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলছে তা জনবিচ্ছিন্ন সরকারও বুঝতে পারে না।
অর্থপাচারে দেশের অনেক এমপি-মন্ত্রী, আমলা ও মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরাও জড়িত হয়ে পড়ে। কিন্তু তাদেরকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনা হয় না। দেখা যায় এরা প্রত্যেকেই বিদেশে তাদের পাচারকৃত অর্থ দিয়ে রাজমহল তৈরি করে জীবনের এক পর্যায়ে সেখানেই স্থায়ী হয়, আর তাদের সেই অর্থ সেইদেশে বিনিয়োগ করার ফলে সেসব দেশ লাভবান হয়। দেশে জবাবদিহিতা না থাকার কারণে এতদিনে দেশে যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে যা জনগনকে আরো বিষিয়ে তোলে। সবকিছুতেই তাই জনগনের প্রধানমন্ত্রীর নিকট বিচার চাওয়া যে বিচার ব্যবস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তা শেখ হাসিনার সরকার বুঝতেই পারে না। হতে পারে তাকে বোঝানোর সাহসই কেউ করে নাই। কারন সমস্ত ক্ষমতা এক জায়গায় কুক্ষিগত থাকায় সবকিছুতেই দলের তোষামোদকারী হ্যা সূচক নেতাকর্মীদের সেইরকম শক্ত মনোবল তৈরি হয় না। আর হবেই বা কিভাবে? সঠিক নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হলে তার জোরই থাকে আলাদা। আর এই দুর্বল মনোবলের জন্যই তারা এই নৈতিক সাহসটুকুও অর্জন করতে পারে না। আর যারা এই সরকারের সমালোচনা করে সরকারকে সঠিক পথে পরিচালিত করবে সেইরকম জোরালো বিরোধী দলও তৈরি হয় নি কিংবা বিরোধী দলকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেওয়া হয় নি।
বিরোধী দলগুলোর কর্মীদেরকে অগণিত মামলা দিয়ে, গুম করে ও আইনি মারপ্যাচে ফেলে তাদেরকে প্রতিনিয়ত হয়রানি করাও ছিলো নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা। শাসকের যদি নিজেদের সমালোচনাকে হজম করার মত নৈতিক ও উদার মানসিকতা না থাকে তাহলে নিজেদের ভুল শুধরানোর স্কোপ হারিয়ে যায়। শেখ হাসিনা সরকারের আরেকটি মারাত্মক ভুল তাদের মতের বাইরের লোকদেরকে বিভিন্ন ট্যাগ দিয়ে হয়রানি করা। জনগণের বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে টেপরেকর্ডারে পরিণত করা যা তাদের প্রতি জনগণকে বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। দেশের প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ঘুষের সংস্কৃতি নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে যায়। জনগন এইসব নীতি বিবর্জিত আমলা ও রাজনীতিবিদদের এতদিনের লুটপাটের কর্মকাণ্ড দেখে বুঝে যায় যে, বড় বড় প্রকল্প যে বড় পরিমানের টাকা লুটপাটের ধান্দা! অর্থাৎ সরকারের প্রতিটি অঙ্গ-কাঠামোতেই যে দুর্নীতি ও ঘুষ বাসা বেঁধেছে তাতে জনগন অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে।
এই দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনামলে বিন্দু বিন্দু করে মানুষের মনে যে ক্ষোভ জন্মাতে জন্মাতে তা হিমশৈল আকার ধারণ করেছে তা জনবিচ্ছিন্ন সরকার বুঝতেই পারে না। ফলে শেখ হাসিনার পদত্যাগে সারাদেশের জনগন উল্লাসে ফেটে পড়ে। শেখ হাসিনা সরকারের অসংখ্য উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও জনগণের নিকট গৌণ হয়ে পড়ে, যার জন্য জনগণ তার পদত্যাগে বিজয় উদযাপন করে। তার কারণ জনগণের মনে দীর্ঘদিন যাবৎ পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে ছাত্রদের আন্দোলনে। এছাড়া ছাত্রদের উপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গুলি ও হত্যা করা দেশের আপামর সাধারণ মানুষ নৈতিকতার জায়গা থেকে মেনে নিতে পারে না। ফলে দল-মত নির্বিশেষে সকল জনগণই এর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে। কোটা সংস্কার বিরোধী আন্দোলন ক্রমান্বয়েই বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন ও পরবর্তীতে সরকার পতনের গণআন্দোলনে রূপ নেয়। ফলশ্রুতিতেই শেখ হাসিনার পদত্যাগ অবধারিত হয়ে যায়।
পাকিস্তানেও আন্দোলনের ডাক দিয়েছে পাকিস্তান ইনসাফ স্টুডেন্টস ফেডারেশন। যদিও বিক্ষোভের শুরুটা বেলুচিস্তানে সরকার বিরোধী আন্দোলনের মধ্যদিয়ে শুরু হলেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ছাত্রসংগঠন ও সমর্থকেরা এ আন্দোলনকে আরো গতিশীল করে। বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের ছাত্র শাখা গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় আন্দোলনের ডাক দেয়। আগামী ৩০ আগষ্টের মধ্যে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে মুক্তি দেওয়ার লক্ষ্যে বর্তমান সরকারকে আল্টিমেটাম দেয়। এর আগে ইমরান খান কারাগারে থেকেই বলেছিলেন, “বর্তমান সরকারের হাতে আর মাত্র ২ মাস আছে। এর পরেই এই সরকারের পতন নিশ্চিত।” বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ছে পাকিস্তানের পথে পথে। বিক্ষোভ চলাকালে দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানীদের হাতে হাতে বাংলাদেশের পতাকা, মুখে মুখে বাংলাদেশী গান ও শ্লোগান! এ যেন এক বিশাল পরিবর্তনের জানান দিচ্ছে।
বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করার সেই শ্লোগান শোনা যাচ্ছে পাকিস্তানের আন্দোলনে সম্পৃক্ত জনগন ও ছাত্রদের মুখে, “তুমি কে আমি কে/বাংলাদেশ বাংলাদেশ।” বাংলাদেশের ছাত্ররা যেভাবে দোর্দন্ড প্রতাপশালী আওয়ামী সরকারকে উৎখাত করতে সক্ষম হয়েছে সেভাবে পাকিস্তানের সরকারকে উৎখাত করতে সেদেশের ছাত্রজনতা আজ বদ্ধপরিকর। তাদের মুখে মুখে বাংলাদেশের জনগনকে ভাই বলারও ভিডিও ছড়িয়ে পড়ছে। পাকিস্তানে দেদারছে বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশের পতাকা। এর মাধ্যমেই বোঝা যাচ্ছে তরুণদের রেভ্যুলিউশনের মাধ্যমেই দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনে এক বিশাল পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। যা ভবিষ্যতে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কূটনীতিক সম্পর্ক তৈরিতেও হয়ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
অন্যদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আরজি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক নারী ডাক্তারকে ধর্ষণ ও হত্যার পর বিচার চেয়ে শুরু হয় আন্দোলন। ৩১ বছর বয়সী ওই ডাক্তারের দেহের ময়নাতদন্তে চরম যৌন লাঞ্ছনার প্রমাণ মিলেছে। কিন্তু অভিযোগ উঠে কর্তৃপক্ষ পুরো ঘটনাই ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। আর এ অভিযোগ ওঠার পর সমাজের সর্বস্তরের মানুষ কার্যত ফুঁসে উঠে। কলকাতার বিক্ষোভকারীদের দাবী, “আমরা ন্যায়বিচার চাই। ধর্ষককে ফাঁসি দাও, নারীদের বাঁচাও।” নৃশংস এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে সেখানে আন্দোলন চলছে। আন্দোলনটি ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে দিল্লী, হায়দরাবাদ, মুম্বাই, পুনেসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। রাস্তায় রাস্তায় মানুষের বিক্ষোভ চলছে। বিপাকে আছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এমনকি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে নিয়েও কথা বলা হচ্ছে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগের পর ভারতে আশ্র‍য় প্রদান করার জন্যও ভারতের ও বাংলাদেশের মিডিয়া পালে হাওয়া দেওয়া শুরু করেছে। বিষয়টি বাংলাদেশ ও ভারতের জন্য খুবই স্পর্শকাতর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আসলে পৃথিবীর যেখানেই বৈষম্য, অপসংস্কৃতি ও অগণতান্ত্রিকতার চর্চা হচ্ছে, সেখানেই সেসবের বিরুদ্ধে কথা বলার ও প্রতিবাদ করার এক অপরূপ শক্তি পাচ্ছে সাধারণ মানুষ ও ছাত্র জনতা। এক বিপ্লব অন্য বিপ্লবকে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে। এক দেশের জনগন অন্য দেশের জনগন থেকে অনুপ্রানিত হচ্ছে। সাধারন জনগনও কথা বলার সাহস-শক্তি-অনুপ্রেরণা পাচ্ছে। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের রেভ্যুলিউশনের বার্তা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বৈরাচারী শাসকের মনে অশনিসংকেতের বার্তা দিচ্ছে। স্বৈরশাসকদের মনের আশংকা ও দুর্বলতা এই রেভ্যুলিউশনের উত্তাপ কি তাদের দেশেও ছড়িয়ে পড়বে? অর্থাৎ রেভ্যুলিউশনের আশংকা স্বৈরাচারদের মনে ভীতির সঞ্চার করছে। মোটকথা প্রতিষ্ঠিত পুরাতনের দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার তীব্র স্পৃহায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ আজকের পৃথিবীর তরুণ প্রজন্ম; অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সৎ ও নৈতিক সাহস তৈরি হয়েছে পৃথিবীর তরুণ প্রজন্মের; রাষ্ট্রকে পুনর্গঠন ও পরিচালনা করারও যোগ্যতা তৈরি হয়েছে পৃথিবীর তরুণ প্রজন্মের তথা জেনারেশন জেডের।
এ থেকেই প্রশ্ন জাগে, “রেভ্যুলিউশন কি ছোঁয়াচে?”
এন ইউ প্রিন্স
সহকারী শিক্ষক
হাওলাদার ডাঙ্গী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

সর্বশেষ সংবাদ