প্রয়াণের ৪৮ বছর পেরোলেও বাঙালির অন্তরে চির-অম্লান নজরুল কণ্ঠের অনুরণন
‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই/যেন গোরে থেকে মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই!’— ইসলামী সঙ্গীতে উল্লেখ করা বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয় বাংলা ১৩৮৩ সালের ১২ ভাদ্র তাঁর প্রয়াণ ঘটার পর। এরপর ৪৮ বছর পেরিয়ে গেলেও জাতীয় কবির প্রেমময়, দ্রোহী ও সাম্যবাদী কণ্ঠস্বর আজও অনুরণিত হয় প্রতিটি বাঙালির অন্তরে অন্তরে।
শৈশবে ‘দুখু মিয়া’ বলে পরিচিতি পাওয়া নজরুলের জন্ম হয় ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ ব্রিটিশশাসিত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। বাল্যবয়সে পিতা কাজী ফকির আহমেদকে হারিয়ে আশৈশব দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হওয়া নজরুল বারো বছর বয়সেই যোগ দেন লেটো গানের দলে। সেখানে লেটো গান রচনা শুরুর মধ্য দিয়ে সৃজনশীল প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে এই বিদ্রোহী কবির।
এর কয়েক বছরের মধ্যে বেজে ওঠে প্রথম বিশ্ববযুদ্ধের দামামা। ১৯১৭ সালের শেষভাগে ৪৯ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধারণ সেনা কর্পোরাল পদে যোগদান করেন নজরুল। আড়াই বছর করাচির সেনানিবাসে থাকার পর ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটলে হাবিলদার পদধারী নজরুল করাচি থেকে ফিরে আসেন কলকাতায়। তবে তার আগে করাচি সেনানিবাসে বসেই তিনি লেখেন ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘মেহের নেগার’-এর মতো গল্পগ্রন্থ। এ ছাড়াও, তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘মুক্তি’-ও তিনি করাচিতে বসেই রচনা করেছিলেন।
কলকাতায় প্রত্যাবর্তনের পর নজরুল শুরু করেন সাংবাদিকতা। তাঁর আবাসস্থল হয়ে ওঠে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির দপ্তর। লেখালেখিতে আরও মনোনিবেশ করে নজরুল রচনা করেন উপন্যাস ‘বাঁধনহারা’ এবং ‘খেয়াপারের তরণী’ ও ‘বাদল স্রোতের শরাব’-এর মতো কবিতা। যা মোসলেম ভারত ও বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
১৯২০ সালের ১২ জুলাই প্রখ্যাত বাঙালি রাজনীতিবিদ শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের সম্পাদনায় নবযুগ নামে একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় কলকাতা থেকে। এ পত্রিকায় কাজ শুরু করার মাধ্যমে নজরুল নিয়মিতভাবে সাংবাদিকতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন।
সাংবাদিকতার সুবাদে তৎকালীন ভারতের সমাজব্যবস্থা ও রাজনৈতিক হালচাল বিশ্লেষণ করার সুযোগও পেয়ে যান তিনি। সে সময়ে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন শুরু হলে নজরুল ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কলম ধরেন। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা তুমুল জনপ্রিয় কবিতা ‘বিদ্রোহী’। যা তাঁকে সমগ্র ভারতের সাহিত্য সমাজে ‘বিদ্রোহী কবি’-র আসনে সমাসীন হতে ভূমিকা পালন করে। একইবছর, নজরুলের ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ শীর্ষক একটি ব্রিটিশবিরোধী কবিতা প্রকাশিত হয় তাঁর সম্পাদিত ধুমকেতু পত্রিকার সেপ্টেম্বর সংখ্যায়। পরে সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু সাম্যবাদ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে দ্রোহকারী নজরুল দমে না গিয়ে আবারও প্রকাশের উদ্যোগ নেন তাঁর প্রতিবাদী প্রবন্ধগ্রন্থ ‘যুগবাণী’। ফলে সরকার গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত করার পাশাপাশি গ্রেপ্তার করে নজরুলকে। ১৯২৩ সালের জানুয়ারিতে বন্দি অবস্থায় তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করে একটি জবানবন্দি দেন চিফ ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে— যা পরবর্তীতে প্রকাশিত হয় ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ রূপে গ্রন্থাকারে।
তবে সামগ্রিকভাবে সর্বদা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে সোচ্চার কাজী নজরুলের সৃষ্টিশীল সাহিত্যজীবন দুই যুগের বেশি স্থায়ী হয়নি। ১৯৪২ সালে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে আজীবনের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে যান তিনি। তবে এই ২৩ বছরের কালপরিসরে তিনি ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘সিন্ধুহিন্দোল’, ‘চক্রবাক’ কাব্যগ্রন্থ, ‘ব্যথার দান’, ‘রিক্তের বেদন’, ‘শিউলিমালা’ ত্রয়ী গল্পগ্রন্থ এবং ‘বাঁধনহারা’, ‘মৃত্যুক্ষুধা’ ও ‘কুহেলিকা’ ত্রয়ী উপন্যাস লেখেন। এ ছাড়া, রচনা করেন ‘রুদ্রমঙ্গল’ ও ‘যুগবাণী’ নামক দুটি প্রবন্ধের বই।
কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধের পাশাপাশি কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমৃদ্ধ পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে বাংলা সঙ্গীতও। রাগতাল মিশ্রিত অনন্য ঘরানার শ্যামা সঙ্গীত ও গজল লিখে এবং সুর করে তিনি বাংলা সঙ্গীতকে নিয়ে যান উৎকর্ষের শিখরে। বাংলা সাহিত্যভাণ্ডার হয়ে ওঠে অননুমেয় সমৃদ্ধির প্রতীক।
আর তাই, প্রয়াণের ৪৮ বছর পেরোলেও বাঙালির অন্তরে অদ্যাবধি চির-অম্লান হয়ে আছে বিদ্রোহী জাতীয় কবি নজরুলের ন্যায়বাদী কণ্ঠের অমোঘ অনুরণন।