কুরবানী যেন না হয় লোক দেখানোর জন্য

মহান আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা মানব ও জীন জাতিকে শুধু তার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। যেমন তিনি ঘোষণা করেছেন “আমি জ্বীন ও মানব জাতিকে শুধু আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি” সূরা জারিয়াত-৫৬

অন্য দিকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছেন দুনিয়ার কাজ এমনভাবে কর যেন তুমি সারাজীবন বেঁচে থাকবে আর আখিরাতের কাজ এমনভাবে কর যেন তোমার আগামীকালই মৃত্যু হবে। সুতরাং দূনিয়ার কাজ কর্ম থেকে বিরত থাকার সুযোগ নেই। বরং মুসলিমদের কাজ আল্লাহর বিধান অনুযায়ী হবে যেন প্রত্যেকটি কাজই ইবাদতে গন্য হয়।
যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন “সালাত সম্পন্ন হলে দুনিয়ার বুকে বিচরণ কর এবং আল্লাহর অনুগ্রহ অনুসন্ধান কর এবং আল্লাহকে (বিধানকে) অধিক পরিমাণ স্বরণ কর। সম্ভবত তোমরাই সফল হবে।” সূরা জুমআ-১০
বছর ঘুরে আবার এসেছে আমাদের সামনে পবিত্র জিলহজ মাস। এই মাসে পবিত্র ঈদুল আজহা, কুরবানী, হজ্জ তথা সারা বিশ্বের মুসলিমদের সর্ববৃহত্তম সম্মেলনের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত বা কর্মসূচি রয়েছে। সামর্থবানদের জন্য আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা হজ্জ ফরজ করেছেন এবং সামর্থ থাকা সত্ত্বেও হজ্জ পালন না করলে সতর্কতা জারি করেছেন।
‘‘আর আল্লাহর জন্য মানুষের উপর পবিত্র ঘরের হজ্জ করা (অবশ্য) কর্তব্য; যে লোকের সামর্থ্য রয়েছে এ পর্যন্ত পৌঁছার। আর যে লোক তা অস্বীকার করে (তাহলে সে জেনে রাখুক) আল্লাহ্ সারা বিশ্বের কোন কিছুরই পরওয়া করেন না’’। (সূরা আল-ইমরানঃ ৯৭)
অর্থাৎ যিনি হজ্জের উদ্দেশে রওয়ানা দেওয়া থেকে শুরু করে হজ্জ সম্পাদন করে নিজ বাড়িতে ফিরে আসা পর্যন্ত হজ্জের যাবতীয় খরচ এবং পরিবারের খরচ বহন করতে সক্ষম তার জন্য আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা হজ্জ ফরজ করেছেন।
হজ্জ পালনকারী এবং যিনি জিলহজ মাসের ১০ ১১ ১২ তারিখের সূর্যাস্ত পর্যন্ত মালিকে নিসাব হন অর্থাৎ যার অধীনে উক্ত সময়ে সাড়ে ৭ তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে ৫২ তোলা রৌপ্য বা তার সমপরিমাণ সম্পদ থাকে তার ওপর আল্লাহ সকলের কল্যান নিহিত রেখে উম্মাহর জন্য ত্যাগ তথা কুরবানীর বিধান নাযিল করেছেন।
‘আর হজ ও উমরা আল্লাহর জন্য পূর্ণ কর। এরপর যদি তোমরা আটকে পড় তবে যে পশু সহজ হবে (তা জবেহ কর)। আর তোমরা তোমাদের মাথা মুন্ডন করো না, যতক্ষণ না পশু তার যথাস্থানে পৌঁছে। আর তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ কিংবা তার মাথায় যদি কোনো কষ্ট থাকে তবে রোজা কিংবা সদাকা অথবা পশু জবেহ এর মাধ্যমে ফিদয়া দেবে। আর যখন তোমরা নিরাপদ হবে তখন যে ব্যক্তি ওমরার পর হজ সম্পাদনপূর্বক তামাত্তু করবে, তবে যে পশু সহজ হবে, তা জবেহ করবে। কিন্তু যে তা পাবে না তাকে হজে তিন দিন এবং যখন তোমরা ফিরে যাবে, তখন সাত দিন রোজা পালন করবে। এই হল পূর্ণ দশ। এই বিধান তার জন্য, যার পরিবার মাসজিদুল হারামের অধিবাসী নয়। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রাখো! নিশ্চয়ই আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৯৬)
এই কুরবানী শুধু উম্মতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য বা উম্মতে ইব্রাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য নয় আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা যুগে যুগে সকল উম্মাহর জন্য বিধান করেছেন।
‘প্রত্যেক জাতির জন্য আমি কোরবানির নিয়ম করে দিয়েছি; যাতে তারা আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে, যেসব জন্তু তিনি রিজিক হিসেবে দিয়েছেন তার উপর। তোমাদের ইলাহ তো এক ইলাহ; অতএব তাঁরই কাছে আত্মসমর্পণ কর; আর অনুগতদেরকে সুসংবাদ দাও, যাদের কাছে আল্লাহর কথা উল্লেখ করা হলে তাদের অন্তর কেঁপে ওঠে, যারা তাদের বিপদ-আপদে ধৈর্যধারণ করে, যারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে এবং আমি তাদেরকে যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে।’ (সুরা হজ : আয়াত ৩৪-৩৫)
বিভিন্ন উম্মাহর জন্য কুরবানীর বিধান থাকলেও ইব্রাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য ছিল এক বিশাল পরীক্ষা। ‘এরপর যখন সে তার (ইবরাহিম) সঙ্গে চলাফেরা করার বয়সে পৌঁছলো, তখন সে বললো, ‘হে প্রিয় ছেলে!, আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে জবেহ (কোরবানি) করছি, অতএব দেখ (এতে) তোমার কী অভিমত’; সে (ইসমাঈল) বললো, ‘হে আমার বাবা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, আপনি তাই করুন। ইনশাআল্লাহ, আপনি আমাকে অবশ্যই ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।’ (সুরা আস-সাফফাত : আয়াত ১০২)
ইব্রাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য বিশাল পরীক্ষা থাকলেও তিনি মহান আল্লাহর ইচ্ছায় সফলতার সাথে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ‘নিশ্চয় এটা সুস্পষ্ট পরীক্ষা’। আর আমি এক মহান জবেহের (কোরবানির) বিনিময়ে তাকে মুক্ত করলাম। আর তার জন্য আমি পরবর্তীদের মধ্যে সুখ্যাতি রেখে দিয়েছি। ইবরাহীমের প্রতি সালাম। এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি।’ (সুরা আস-সাফফাত : আয়াত ১০৬-১১০)
কুরবানী আল্লাহর বিধান এবং আল্লাহর জন্য হলেও সেটি আমরাই ভোগ করি এবং আল্লাহর কাছে তাক্বওয়া ব্যতিত আর কিছুই পৌঁছায় না।
‘কিন্তু মনে রেখো! কোরবানির গোশত বা রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, আল্লাহর কাছে পৌঁছায় শুধু তোমাদের নিষ্ঠাপূর্ণ আল্লাহ সচেতনতা। এই লক্ষ্যেই কোরবানির পশুগুলোকে তোমাদের অধীন করে দেওয়া হয়েছে। অতএব আল্লাহ তোমাদের সৎপথ প্রদর্শনের মাধ্যমে যে কল্যাণ দিয়েছেন, সেজন্যে তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করো। হে নবি! আপনি সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ দিন যে, আল্লাহ বিশ্বাসীদের রক্ষা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো বিশ্বাসঘাতক, অকৃতজ্ঞকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা হজ : আয়াত ৩৭-৩৮)
আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার সৃষ্টির প্রথম মানব হযরত আদম আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উম্মাহর ওপর কুরবানীর বিধান ছিল এবং তখন কুরবানী কবুল হলে মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে জানতে পারত যেমন আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন।
’আর তুমি তাদের কাছে আদমের দুই ছেলের (হাবিল-কাবিল) সংবাদ যথাযথভাবে বর্ণনা কর, যখন তারা উভয়ে কোরবানি পেশ করলো। এরপর তাদের একজন থেকে (কোরবানি) গ্রহণ করা হলো আর অপরজন থেকে গ্রহণ করা হলো না। সে বললো, ‘অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করবো’। অন্যজন বলল, ‘আল্লাহ কেবল মুত্তাকিদের থেকে (কোরবানি) গ্রহণ করেন’।’ (সুরা মায়েদা : আয়াত ২৭)
আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা পবিত্র কোরআনে আমাদের তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য সালাত এবং কুরবানী আদায় করার আদেশ দিয়েছেন। ‘অতএব আপনার রবের উদ্দেশ্যেই নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন।’ (সুরা কাউছার : আয়াত ২) সালাত এবং কুরবানীর আদেশ দিয়ে উক্ত বিষয়ে পবিত্র কুরআনের অন্যত্র দোয়া করাও শিক্ষা দিয়েছেন।
‘বলুন, নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু আল্লাহর জন্য, যিনি সব সৃষ্টির রব’। ‘তাঁর কোনো শরিক নেই এবং আমাকে এরই নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। আর আমি মুসলমানদের মধ্যে প্রথম’। (সুরা আনআম : আয়াত ১৬২-১৬৩)
আল্লাহ কুরবানীর আদেশ দিয়েই ক্ষ্যান্ত বন্টনের নিয়মও বাতলে দিয়েছেন।
‘আর কাবার জন্য উৎসর্গীকৃত উটকে আমি তোমাদের জন্যে আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন করেছি। এতে তোমাদের জন্যে মঙ্গল রয়েছে। সুতরাং সারিবদ্ধভাবে বাঁধা অবস্থায় তাদের জবাই করার সময় তোমরা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করো। এরপর যখন তারা কাত হয়ে পড়ে যায় তখন তা থেকে তোমরা আহার করো এবং আহার করাও; যে কিছু চায় না তাকে এবং যে চায় তাকেও। এমনিভাবে আমি এগুলোকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছি, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো।’ (সূরা: হজ, আয়াত ৩৬)।
সুতরাং কুরবানীকৃত পশুর গোস্ত ৩ ভাগ করে একভাগ নিজের আহারের জন্য, আরেক ভাগ ফকির-মিসকিনদের আহারের জন্য অর্থাৎ যারা যাঞ্চা করে বা যারা অভাব থাকা সত্ত্বেও যাঞ্চা করেনা তাদের জন্য অন্যভাগ আত্মীয়-স্বজনদের আহারের জন্য বন্টন করতে হবে।
কুরবানী এবং কুরবানীর পশুর গোস্তে দুঃস্থ-অভাবগ্রস্থদের হকের বিষয়ে তিনি আরো বলেন-
 
‘যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থান পর্যন্ত পৌছে এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করে তাঁর দেওয়া চতুস্পদ জন্তু যবেহ করার সময়। অতঃপর তোমরা তা থেকে আহার কর এবং দুঃস্থ-অভাবগ্রস্থকে আহার করাও।’ (সূরা: হজ, আয়াত ২৮)।
পর্যবেক্ষণে পরিলক্ষিত হয় আমাদের দেশে মানুষ কুরবানীর পশুর সাথে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম শেয়ার করে বা বিভিন্ন মহলে তার বড় দামি পশু কুরবানীর বিষয়ে গল্প করে। এর দুটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে তা হলো- ১. সাওয়াব ও ২. সামাজিক মর্যাদা কারো কারো ক্ষেত্রে বিপরীত ক্রম ও দেখা যায়। সামাজিক মর্যাদা পাওয়ার জন্য কুরবানী করা হলে সেটি ‘রিয়া’ হয় আর ‘রিয়া’কারীদের জন্য আল্লাহ তায়ালা ধ্বংসের কথা ঘোষণা করেন ‘৪. ধ্বংস ঐ সব সালাত আদায়কারীদের জন্য ৫. যারা তাদের সালাত সম্বন্ধে নির্বোধ ৬. যারা তা লোক দেখানোর জন্য করে।’ (সূরা মাউন : ৪-৬)।

বিশ্বনবী (সা.) দান-সদাকাকে গোপনে করার জন্য তাকিদ দিয়ে বলেছেন, ‘দান এমনভাবে করবে যেন ডানহাত দ্ধারা দান করবে, কিন্তু বাম হাত জানতে পারবে না।’
কুরবানীও সদাকার অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং কুরবানী করতে হবে আল্লাহর শিখিয়ে দেওয়া আয়াত থেকে শিক্ষা নিয়ে যেটি পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে ‘বলুন, নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু আল্লাহর জন্য, যিনি সব সৃষ্টির রব’। ‘তাঁর কোনো শরিক নেই এবং আমাকে এরই নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। আর আমি মুসলমানদের মধ্যে প্রথম’। (সুরা আনআম : আয়াত ১৬২-১৬৩)
লেখক: মুহাম্মদ আল্-হেলাল , এমফিল গবেষক (এবিডি),আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

বিষয়: * ঈদুল আজহা * কুরবানী
সর্বশেষ সংবাদ