কাউখালী প্রতিনিধি, রাঙামাটি:
২৬শে মার্চ ১৯৭১ সাল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙ্গালী জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে এবং গোটা দেশকে পশ্চিম পাকিস্তানীদের কবল থেকে রক্ষার্থে এই শেষ ভাষনে বললেন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম। এই শ্লোগানে শ্লোগানে পুরো বাঙালী জাতি মুখরিত হয়ে তথা জাতি-ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তৎকালীন ১৯৭১ সালে ২৬ শে মার্চ থেকে শুরু হয় দীর্ঘ ৯ মাস স্বাধীনতার রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। ৯ মাস যুদ্ধ করে পশ্চিম পাকহানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় চিনিয়ে নেয় পৃরো বাঙ্গালী জাতি।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান আজীবন চিরস্মরণীয় ও রাষ্ট্রীয় ভাবে সম্মাননা দেয়া হয়। তৎকালীন স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করেছেন সকল মুক্তিযোদ্ধাদের বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার বিশেষভাবে এই সম্মাননায় ভুষিত করেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় রাঙামাটি জেলার কাউখালী উপজেলাধীন ৩নং ঘাগড়া ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডের অর্ন্তগত ঘাগড়া এলাকার কৃতিসন্তান প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা অনিল সেন-কে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখায় স্বীকৃতি স্বরূপ বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মাননা প্রদান কর হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত অনিল সেন বিগত ২৬শে জানুয়ারী ২০২৪ সালে পরলোকগমন করেন। তার মৃত্যুতে ঘাগড়া এলাকাসহ পুরো কাউখালীবাসী শোকাহত ও মর্মাহত। কিন্তু এই বীর মুক্তিযোদ্ধা পরলোকগমনের ৪ মাস যেতে না যেতে ঘাগড়া এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা কাউখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ সম্পাদক এবং ঘাগড়া শ্রী শ্রী গীতা মন্দিরে সভাপতি কাঞ্চন কর বীর মুক্তিযোদ্ধার শ্মাশান দখল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত অনিল সেনকে সনাতনী শাস্ত্রীয় মতে স্থানীয় মহাশ্মাশনে সৎকার করা হয়েছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধার অনিল সেন এর ছেলে বিপ্লব সেন সিএইচটি বার্তা ডট কম এ প্রতিবেদককে জানান, বাবা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশের জন্য অকুতভয় এক বীর সৈনিক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। বিগত ২৬শে জানুয়ারী ২০২৪ সালে বাবার মৃত্যুর পর সনাতনী শাস্ত্রীয় মতে ও সামাজিক রীতিনীতিতে স্থানীয় মহাশ্মাশানে সৎকার করা হয়। বাবার মৃত্যুর ৪ মাস অতিবাহিত না হতে বাবার সৎকার সম্পন্ন করা ঘরটি ভেঙ্গে দিয়েছে কাউখালী উপজেলা আওয়ামীলীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক এবং ঘাগড়া শ্রী শ্রী গীতা মন্দিরের সভাপতি কাঞ্চন কর। সে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ দলের প্রভাব খাটিয়ে ও টাকার ক্ষমতা দেখিয়ে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার শ্মাশান কিভাবে ভেঙ্গে দিতে পারে। তবে বাবা জীবিতকালীন কোন সাহস পায়নি। এব্যাপারে বীর মুক্তিযোদ্ধা শ্মাশান ভেঙ্গে ফেলার বিষয়ে রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অংসুইপ্রু চৌধূরী কাছে অভিযোগ করেন বিপ্লব সেন। পরে চেয়ারম্যান নির্দেশে বীর মুক্তিযোদ্ধার শ্মাশানটি যেভাবে ছিল, সেভাবে থাকবে। কিন্তু কোন কর্ণপাত না করে ক্ষমতার অপব্যবহার করে তা ভেঙ্গে ফেলা হয়। এই অভিযোগের জেরে পরিবারটির উপর ক্ষিপ্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী ও ছেলেকে কাঞ্চন কর তার দলবল নিয়ে রাতে আঁধারে অর্তকিত হামলা চালায়। এতে আমার মা ও আমি আহত হই।
বিপ্লব সেন আরো জানান, বাবার শ্মাশান ঘরটি ভেঙ্গে ফেলার প্রতিবাদ জানালে কাঞ্চন কর তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে ঘাগড়া বাজারে গতকাল রবিবার (১৯ মে) রাত আনুমানিক ১০ ঘটিকায় আমাকে এলোপাতাড়ী মারধর করে। আমার মা আমাকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে এলে মাকেও স্বজোড়ে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। পরে আহত অবস্থায় আমি ও মা সহ রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎিসা নিই। আমাকে ও মাকে জখম করার দায়ে রবিবার রাতে এ ঘটনার বর্ণনা দিয়ে কাউখালী থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করি। বর্তমানে বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারটি অনিরাপত্তা হীনতায় ভুগছেন। পুনরায় যেকোন সময় মারধরের ঘটনা পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে বলে আশংকা করছেন। এজন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারটিকে আইনগত সহায়তার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে রাতের আঁধারে মারধর ও হেনস্তার ব্যাপারে কাঞ্চন কর এর সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি সিএইচটি বার্তা ডট কম এ প্রতিবেদককে জানান, মহাশ্মশানে সনাতন পদ্ধতিতে সৎকার করার পর এভাবে ঘর রাখা যায় না। তাছাড়া সনাতন রীতিনীতিতে মৃত ব্যক্তিকে গোসল করানোর জন্য শ্মাশানে একটা ঘরের প্রয়োজন। সেজন্য এই ঘরটি তৈরীর সার্বজনীন পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের উপর লাঠিসোটা দিয়ে মারধর ও আঘাত করার এক প্রশ্নের উত্তরে জানান, তাদেরকে মারধর করা হয়নি, কথা কাটাকাটি ও তর্কবিতর্ক হয়েছে। ইচ্ছে করে তারা চালাকি করতে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেছেন। কেন মারধর করা হয়েছে এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি মারধরের ব্যাপারে এড়িয়ে যান এবং আগামীকাল মঙ্গলবার (২১ মে) ৩নং ঘাগড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এর কার্যালয়ে সমস্যার সমাধানের জন্য বসবেন বলে জানান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিবারবে রাতের আঁধারে এভাবে মারধর করা ঠিক হয়নি। আজ মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানে পুরো দেশ ও জাতি মুক্ত। তাদের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সমস্যা থাকতে পারে তাই বলে মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে এই জঘন্য ঘটনা ঘটাতে পারে তিনি কল্পনা করতে পারেননি। বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে মারধরে তীব্র নিন্দা ও ঘটনার জড়িতদের আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তির দাবি জানান এই আওয়ামীলীগ নেতা।
এদিকে ঘাগড়া এলাকাাবাসীদের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানায়, ঘাগড়া এলাকার একজন নামিদামি ব্যক্তি ছিলেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত অনিল সেন। সে সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলেন। সবাই তাকে এলাকার সাধারন লোকজন খুবই ভালোবাসতেন। তার মৃত্যুতে পুরো ঘাগড়াবাসী শোকাহত হয়েছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের উপর এভাবে এলোপাতাড়ি মারধরের ঘটনা পুরো রাষ্ট্রদ্রোহীর সামিল বলে উল্লেখ করেছেন ঘাগড়া এলাকার সচেতন নাগরিক সমাজ। সুতরাং এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে ঐ ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ নেতা ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনে দোষীদের বিরুদ্ধে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের জোর দাবি জানিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, ৩নং ঘাগড়া ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ নাজিম উদ্দিনের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে রাতের আঁধারে পরিকল্পিত ভাবে মারধরের ঘটনায় কাউখালী থানা কর্মকর্তা (ওসি) জানান, মারধরে ঘটনার বিষয়টি জেনেছি। গতকাল রাতে মা ও ছেলে থানায় এসে মারধরের ঘটনার লিখিত অভিযোগ করেছেন। তবে প্রাথমিক ভাবে বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে মারধরের ঘটনাটি তদন্ত সাপেক্ষে দোষী সাব্যস্তদের আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন নেয়া হবে।