রোজা গ্রাম ও শহরে
অজপাড়া গাঁয়ে জন্ম আমার। তখন বিদ্যুৎ ছিলোনা, কেরোসিন তেলের কুপি বাতি আর হারিকেনেই ভরসা। অন্ধকার হয়ে সন্ধ্যা নামলেই মনে হতো মধ্যরাত উঁকি মারছে। কাছারি ঘরে থাকা লজিং মাস্টারের কাছে পড়তে গিয়ে অন্ধকারে বাড়ির বসত ঘর থেকে যাইতেই ভয় লাগতো।
এইচএসসি অবধি কেটেছে গাঁয়ে। ছায়া ঢাকা বন বনানী, পাখিদের কলরব, দূর মসজিদ থেকে টিনের তৈরী হরনে মুয়াজ্জিনের ডাকে ফজর ওয়াক্ত, মোরগের ডাক, ধানের ঘরে থাকা হাঁসগুলোর ভোর হতেই চিৎকার, বাড়ির মোরগ-মুরগি ঘরে গেলেই কিংবা কাঠের বাক্সের রেডিওতে খুব দ্রুত কোরআন পড়া, আমরা ছোটরা ইফতারে বড়দের সহযোগীতা, টিউবওয়েল অনেকক্ষণ চেপে পানি ফেলে দিয়ে নীচের ঠান্ডা পানি আনার ফরমায়েশ, জগ ভর্তি পানি আনা, মুড়ি মাখানো, চপ বানানোর জন্য সিদ্ধ করা আলু চিলা, ঘরের সামনের উঠানে কলাপাতা বিছিয়ে তরল খিচুড়ি ঠান্ডা হওয়ার জন্য আগেই বেড়ে রাখা, বাড়িতে পালা তিনটা কুকুরকে লাঠি হাতে পাহারা দেওয়া। চাটাই বিছিয়ে বাড়ির কর্তা মানে আব্বা বসতেন। এভাবে ইফতারের আয়োজন শুরু হতো।
গাছ কেটে করাত দিয়ে তক্তা, ঘর বাঁধার কাফ, কুড়ো, ধন্যা এসব বানাতে করাতি আসতো গ্রামে। গৃহস্থ বাড়িতে চার পাঁচ জনের একটা দল থাকতো। ধান কাটা, রোপন কাজের জন্য কামলা থাকতো কাছারি ঘরে, সবাইকে সেহেরীর সময় সেহেরী, ইফতারের সময় ইফতার খাওয়ানো, ঘরে মহিলারা, বাইরে পুরুষরা প্রচুর কাজ করতে হতো।
মুরুব্বিরা বলতেন ‘ অমুক দিন রোজার চাঁন উডবো, দেহিস তরা। ঐ অমুক দিনটা সাথে সাথে প্রচার, বিশ্লেষণ হয়ে যেতো আমরা সমবয়সী সবার মাঝে। পাড়ার বন্ধুদের নিয়ে দল বেঁধে দাড়িয়ে থাকতাম, কে আগে চাঁদ দেখবে। মুরুব্বিমতো কেউ যদি একবার চিৎকার দিয়ে বলতো, ‘ হেই যে চাঁন, দেখ দেখ….. কোনো সময় চাঁদ দেখা যেতো, কখনো আকাশ মেঘে ঢাকা থাকায় দেখতে না পারলেও সবার সাথে তাল মিলিয়ে বলতাম, ‘ হ, দেখছি, চিক্কন চাঁনডা।
আম্মা, বড়’পা সবাইকে বলে দিতাম সেহেরির সময় ডেকে দিতে। আম্মা বলতেন ‘ ছোডু মাইনসের রোজা লাগেনা, পইলা রোজা, মাইধ্যেরটা আর শেষের দিন রোজা থাকলেই রোজা বান্ধা অইয়া যাইবো। পরদিন রোজা রাখতাম। আপা ভাইয়ারা বলতেন, ‘ রোজা থাইক্কেয়া সেভ গিলবিনা ভাইঙ্গেয়া যাইবো। সারাদিন থুথু ফেলতে ফেলতে গলা শুকিয়ে যেতো। যে জায়গাটায় বসতাম, চারদিকে কেবল থু থু আর ময়লা। আম্মা ডেকে নিয়ে বলতেন ‘ কিরে পারবেনি থাকতে রোজা, হনেক লাম্বা দিন, ভাত আছে, খায়া লা। মন চাইতো খেয়েই ফেলি, পরে এটা নিয়ে সমবয়সীদের কাছে ছোট হয়ে যাবো, ক্ষ্যাপাবে, তাই ভাঙ্গতাম না।
দাদু ইফতারের সময় তার পানের বাটা, ছড়তা, খাওয়ার পাতা, খয়ার, জর্দা নিয়ে আসনের মতো বসতেন। আমাকে ডেকে বলতেন ‘ দেখছেনরে আলু , ঝিঙার ফুল ফোটছেনি? মোরগা মুরগী ঘরো গেলেই ইস্তারি খাওন যাইবো।
দৌড়ে গিয়ে দেখে এসে বলতাম ‘ নাগো দাদু, ঝিঙার ফুল অহনো ফোডে নাই, ‘ আর মোরগা মুরগী? ‘ মুরগীরা অহনো আঁডাগুডি করে দাদু, ঘরো যায়না। অবশেষে রেডিওতে আজান, মসজিদের আজান শোনে ইফতার করতাম। বাড়ির বছরী কাজের ছেলে এসে বলতো ‘ বাইর বাইত লোক আছে, ইফতার দেইন খালা। এটা আমাদের রেওয়াজ ছিলো।
বাড়ির কাজের বছরি মুনী ইফতারের সময় বাড়ির সামনে দিয়ে যারা যাবেন, তাদের ডেকে এনে ইফতার করানো। গ্রামে থাকলেও তিনবার নির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যান আব্বা অনেক পদ দিয়ে ইফতার করতেন সবসময়। মাটিতে বড় ছাটাই বিছিয়ে লেবু চিনির শরবত বানানো, চামচ দিয়ে নাড়া দেওয়া, মুড়ি চালুনি দিয়ে চালা, ডাল বড়া, প্লেটে প্লেটে দেওয়া কাজগুলোতে আমরা ছোটরা বড়দের সাথে কাজ করতে হতো।
আমরা ছোটরা তিনটা রোজা করতেই হতো, রোজাকে বেঁধে ফেলার জন্য। গ্রামে সেহেরি খাওয়ার জন্য মসজিদ থেকে হরণ ও পরে মাইক কিনা হলে মাইকে বলা হতো, ‘ সেহেরী খাওয়ার আর দশ মিনিট বাঁকি আছে। আজ আধুনিক শহরে পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থেকেও কেউ কাউকে চিনেনা। ঘড়ির কাঁটায় চলা, মোবাইলে এলার্ম দেওয়া, টাকায় কেনা সুখ এখানে। ইফতার সেহেরিতে কেউ ডাকেনা শহরে। তবে পুরাণ ঢাকায় মহল্লায় দল বেঁধে যুবকরা সেহেরীর সময় ডাকে, ” সেহেরী খাইতে বলি কেনযে তোমরা উঠোনা, আমারে নি লইয়া যাইবা সোনার মদিনা” –সুর করে জারী গাওয়ার মতো বলে চলে যায় ওরা।
শহরে থাকলেও বেলাশেষে বিছানায় ঘুম না হওয়া ছটফটানীতে গ্রামের, দূর তারাদের দেশে হারিয়ে যাওয়া জঙ্গলের পাশে বাবা মায়ের কবর, তাদের সাথে কাটানো স্মৃতি, কথা, আদেশ, নিষেধ আজ মনের রশি ধরে টানে।